ক্যাফে এক মাসের গল্পে নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

অহিংসা পরমো ধম্ম

(লেখাটি সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসুত। ঐতিহাসিক নয়। )

জয়সেন কে এমন কিছু অস্ত্র নিতে হবে যা দেখে বোঝা যায় না যে সেটি কার। তার নিজের সব অস্ত্রেই নিজস্ব একটি চিনহ্‌ আছে। পশুচিকিৎসালয়ের কাছে একটি ছোট ছেলে অনেক ধরণের পশু বেঁধে নিয়ে যাবার দড়ি কাঁধে ঘুরছে। চমকে উঠল জয়সেন। একজন শীর্ণ, অহিংস মানুষ কে মারবার এর চাইতে ভালো অস্ত্র আর কি আছে! বাছুর বাঁধার সরু আর নরম দড়ি কিনল ছেলেটির কাছে। ছেলেটি খুব উচ্ছসিত হয়ে জানাল এতে নাকি বাছুরের একটুও লাগে না। তাকে একটু বেশী মুদ্রা দিল জয়সেন। সে আরও উচ্ছসিত হয়ে জানাল,আজ সে প্রভু বুদ্ধের জন্যে দীপ জ্বালাবে। আরও অনেক কথা সে বলতে লাগলো। নিগ্রোধ কুমার কে সে অনেক বার দেখেছে। জয়সেন আবার চুপ করে একটা গাছের নীচে বসে রইল। দাক্ষায়নের বিশেষ সহায়ক তার কাছে এল। খুব নিচু স্বরে জানাল তাদের শিকার উপবনে আছে। আর একদম একা। অতএব যাত্রা শুরু করল জয়সেন। বহুকাল পরে খুব উত্তেজিত সে।একজন ছটপট করে মরে যাবে। বহু মানুষের মৃত্যু সে পূর্বে ঘটিয়েছে।বেঁচে থাকার জন্যে শেষ মুহূর্তে মানুষের কি তীব্র ক্ষমতা তৈরি হয় সেটার অভিজ্ঞতা থেকে ভেতরে ভেতরে নিজেকে শান্ত করে জয়সেন।

প্রায় শুষ্ক জলধারা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে জয়সেন।দড়িটি কোমরে বেঁধে নিয়েছে সে। বিরাট শ্যাওলা ধরা হলুদ রঙের পাথর এর জন্যে সামনের যাত্রা পথ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জলধারা একটি দিকে ঘাস নুড়ির ওপর উঠে এল জয়সেন। একটু এগিয়ে যেতেই নিজেই অবাক হল। হলুদ পাথরের জন্যে দৃষ্টির বাধা সরতেই সামনে সবুজ জমিতে ভিক্ষুর দেখা পেল জয়সেন।কিশোর চেহারা শান্ত ভাবে ধ্যানে মগ্ন। উন্নত শির, যেন প্রদীপের শিখা।স্থির হল জয়সেন। কোমর থেকে দড়ি খুলে দু হাতের মুঠিতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। গলাতে পেঁচিয়ে চাপ দিলেই কাজ শেষ হবে। খুব ধীর পায়ে এগোতে থাকে জয়সেন। আচমকা পায়ে একটা টান।জয়সেন মুহূর্তের মধ্যে তাকিয়ে একটি বিরাট শরীরের মানুষ কে দেখতে পায়।পাথরের মত তার শরীর। হতচকিত জয়সেন মাথার পেছনে প্রবল ব্যাথা অনুভব করল।

সমস্ত প্রহরীরা ছুটে চলেছে ।উত্তরের উপবনে দাবানল লেগেছে। এই শুষ্ক আবহাওয়াতে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। ভোর হবার আগেই কি ভয়ানক অবস্থা । পাখীরা সারা আকাশ জুড়ে বিলাপ করছে। কয়েক ঘর শবর উত্তরের উপবনের পাশে থাকে। তারা অনুদ্বিগ্ন ভাবে আগুন দেখছে। প্রহরীরা দেখল, একজন বেশ দীর্ঘকায় ভিক্ষু, আর এক ভিক্ষুকে পিঠে করে নিয়ে আসছে। কাছে চলে এলে বুঝতে পারলো নিগ্রোধ কুমার আর তার একান্ত সেবক কনাদ। সকলে নত হল। নিগ্রোধ কুমার কিঞ্চিৎ আছন্ন।

মাধব ঘুম থেকে উঠে জয়সেনের খোঁজ পাচ্ছে না। অশ্বটিও নেই। বিশ্রামাগারের বাইরে এসে জানতে পারলো উত্তরের উপবনে দাবানল। বেলা হতে আগুন নিভু নিভু।প্রহরীরা সকলে কৌতূহলী উপবনের ভেতরে যাওয়া শুরু করল। মাধব ও তাদের সাথে যাত্রা করল। শুকনো নদীর ধারের ওপারে কিন্তু আগুন যায়নি। আচমকা সেখানে একটি দেহ দেখে অবাক হল তারা। উত্তেজিত সকলে গিয়ে দেখল একজন রাজপুরুষ। ভিড় ঠেলে মাধব হতবাক হয়ে গেল। জয়সেন ভূলুণ্ঠিত হয়ে আছেন, ঘাড়টা একটু বাঁকা। শ্বাস পড়ছে না। গা এখনো গরম।

বুকে কান দিয়ে বুঝতে পারে মাধব ‘সব শেষ’।সারা রাজধানী জুড়ে খবর রটে যায়। রাজার একান্ত সহায়ক বীর জয়সেন রহস্য জনক ভাবে মৃত।প্রবল বৈভবের সাথে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হল। মাধব খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করল। দীর্ঘবাহুকে বারংবার তিরস্কার করল।

নিগ্রোধ কুমার সত্যের খোঁজ পেয়েছেন। ‘ক্ষমা’ ,একমাত্র ক্ষমা হল আসল সত্য। মা তাঁকে ধ্যানের মধ্যে আশীর্বাদ করে গেছেন। প্রকৃষ্ট ক্ষমা ছাড়া আর কোন কিছুই সত্য নয়। রাজা বারংবার নত হলেন বৌদ্ধভিক্ষুর প্রতি।ভ্রাতুষ্পুত্র কে তিনি সব সমর্পণ করেছেন। বড় শান্তি নিয়ে তিনি আজ ফিরে যাবেন। ভিক্ষু কনাদ কে কাছে ডাকলেন।আশেপাশে কেউ নেই।কনাদ মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন। “ তোমার ওপর আমার পরম বিশ্বাস ,কনাদ। তুমি না থাকলে একটা অনর্থ ঘটে যেত। এভাবে তুমি সমাধা করেছ তার জন্যে ধন্যবাদ।” রাজা দীর্ঘকায় কনাদের দিকে তাকালেন। কনাদ ধীর কণ্ঠে বললেন, “ আপনি বিশ্বাস রাখুন। আমার দেহে প্রান থাকাকালীন কারো ক্ষমতা হবে না নিগ্রোধ কুমারের গায়ে হাত দেবার।ছায়ার মতো আমি তাঁর পাশে ছিলাম।” রাজা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ তোমার কোন অস্ত্র লাগবে?” কনাদ অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলে,“আমি কাউকে নৃশংস ভাবে হত্যা করি না।খুব দ্রুত আর তীব্র আঘাতে যে কোন মানুষ মারা যাবে। অস্ত্রের কোন দরকার নেই।” মহারাজ অশোক তার পিঠে হাত রাখলেন।“কিন্তু দাবানল? সেটা কি করে ঘটালে? কনাদ”। কনাদ মাথা নিচু করলেন, “ওসব আমাদের প্রিয় শবর রা করেছে। আপনি তাদের কে উচ্চ বর্ণের সমান বলে শিলালেখতে জানিয়েছেন। ভগবান বুদ্ধকে ওরা নিজেদের মানুষ বলে মনে করে।”

মাধব ধর্ম্যামাত্য হল।রাজা প্রিয়দর্শী অশোকের শিলালেখ সে গ্রামে গ্রামে মানুষ কে পাঠ করে শোনায়। দাক্ষায়নের দল একবার তাকে ভয় দেখিয়েছিল। তাদের ধারণা জয়সেনের মৃত্যুর জন্যে সেই দায়ী। কিন্তু তার কান্না আর একজন শবরের কথায় তাকে আর কেউ বিরক্ত করে না।

মাধব সেই নাম না জানা গ্রামে এসে হৈমবতীর খোঁজ করে। কেউ বলতে পারে না। তবে সে যখন জানায় যে তার প্রভু মারা গেছে, সকলেই দুঃখ পায়। মাধব কে উৎকৃষ্ট খাদ্য,পানীয় দান করে। ভোরবেলা অশ্ব নিয়ে নিজের দেশে ফেরার সময় নদীর ধারে একজন নারীকে সে দেখতে পায়। সদ্য বৈধব্যের পোশাকে। বড় কুৎসিত এক মহিলা। সারা দেহে পুড়ে যাওয়া ক্ষতের দাগ। হৈমবতী এত খারাপ দেখতে নয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।