সুযোগটা এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে যাবে ভাবতেও পারেনি তন্ময়। কি যেন একটা ফিরিয়ে দেওয়ার ছিল। সেটা ফিরিয়ে দিতে না পারার যন্ত্রণাটা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে কুড়িটা বছর।
সেই দিনটার কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠে তন্ময়। শুভেন্দুর পাঁচ আঙুলের চড়ে গালটা লাল হয়ে গেছিল তন্ময়ের।
শুভেন্দু আজ মৃত্যুসজ্জায়; মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। বাঁচবার কোন আশ্বাসই দিতে পারেননি ডক্টর সেন। দুটো কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে ওর। সহায় সম্বলহীন শুভেন্দুর মৃত্যুর দিন গোনা ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় রাস্তা নেই।
তন্ময় ঘরে ঢুকেছে। বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে চেয়েছে। শক্তসামর্থ্য মানুষটা অসুখের ভারে কেমন যেন নুয়ে পড়েছে। তন্ময়কে দেখে চোখের ইশারায় ডাকল শুভেন্দু। কাছে আসতেই বলল- আমায় ক্ষমা করে দিস ভাই,আমি তো আর বেশী দিন বাঁচব না।
কিসের ক্ষমা , কি জন্য ক্ষমা সেসব ভেবে দেখার সময় নেই তন্ময়ের। সশব্দে একটা চড় আছড়ে পড়ল শুভেন্দুর গালে।
– মারলি আমায়?
– মারব না তো কি পুজো করব তোকে? মরার কথা বললি না? দ্যাখ আমি আগেই মেরে দিচ্ছি।
– কি করব বল? ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে চান্স নেই। তুই কবে থেকে ধরেছিলিস আর আমি শুধু ঘুরিয়েই যাচ্ছিলাম। তবে এবার সত্যিই তোকে কথা দিয়েছিলাম ভজাদাকে ধরে দিন সাতেকের ছুটিটা ম্যানেজ করে তোর সাথে দার্জিলিংটা ঘুরে আসব। ভজাদা রাজীও হয়ে গিয়েছিল। চা দোকানটা কদিন একাই সামলে দেবে বলেছিল। কিন্তু যাওয়াটা আর হবে না রে।
তন্ময় আনমনে ভেবে চলেছে। শুভেন্দুর সাথে পরিচয়ের দিনটার কথা। একই পাড়ায় থাকত দু’জনে। সেই হিসেবে মুখ চেনা ছিল।তবু সামনাসামনি কথা হয়নি কখনো। শুভেন্দু ওর থেকে তিন বছরের বড়। তন্মেয়ের সাত আর শুভেন্দুর দশ তখন। বড় রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালটা লাল থেকে সবুজ হয়ে গেছে। তবু ঝুঁকি নিয়ে একছুটে রাস্তা পার হতে গেল তন্ময়। নাহলে পাক্কা পাঁচ মিনিট রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আর লেট লাইনে দাঁড়ানোর জন্য হেড স্যারের কাছে বকুনি খেতে হবে।
বাইপাসের চওড়া রাস্তায় সারি সারি গাড়ি তখন স্টার্ট দিতে শুরু করেছে। ছুটতে ছুটতে মাঝ রাস্তায় এসে থমকে দাঁড়াল তন্ময়। একটা লরি তীব্র বেগে সামনে চলে এসেছে। এগোবে না পিছোবে ভেবে না পেয়ে হতচকিতের মত মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল। বোধহয় ভবিতব্যের হাতে নিজের সবটুকু ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে।আচমকাই কোথা থেকে উড়ে আসা একটা হাত ওর হাতের মুঠোটা ধরে হিড়হিড় করে রাস্তাটা পার করে দিল। তারপর সজোরে একটা চড় মেরে বলল – এভাবে কেউ রাস্তা পার হয় ইডিয়ট!
বিশ বছর আগের সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়লেই এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তন্ময়ের। অতীতের সরণী বেয়ে ধীরে ধীরে বর্তমানে ফিরে আসে। হাতে রাখা প্যাকেট থেকে একটা কাগজ বার করে বলে – এই দ্যাখ, কি লেখা আছে এতে?
উৎসুক চোখে শুভেন্দুর প্রশ্ন – কি লেখা আছে?
– তোর আর আমার ব্লাড গ্রুপ আর এইচ এল এ মানে হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন্ট সব মিলে গেছে।
– তাতে কি হবে?
– এবার পাছায় এক লাথ মারব তাতেই বুঝতে পারবি কি হবে। ইডিওট একটা! আমার একটা কিডনি তোকে দিতে পারব। ডঃ সেনের সাথে কথা হয়ে গেছে।
চোখের কোণদুটো আচমকাই ভারী হয়ে উঠল শুভেন্দুর। সেটা চাপা দেবার জন্যই বলল – আমাকে শান্তিতে মরতেও দিবি না হতভাগা! শত্রু কোথাকার!