|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় নির্মাল্য বিশ্বাস

মাহাত্ম্য


  • ‘কাট কাট কাট’
    মাথাটা বাড়িয়ে গদগদ হয়ে রজনীগন্ধার সুগন্ধি মালাটা গলায় পরতে যাচ্ছিল হারাধন মল্লিক।হাততালির শব্দও পড়তে শুরু করেছিল।আচমকাই সেই শব্দ ছাপিয়ে এমন উৎকট চিৎকারে সবাই হতচকিত।সবারই দৃষ্টি রসভঙ্গকারীর দিকে।হারাধনও ভুরুজোড়া কাছাকাছি এনে বিরস বদনে তাকাচ্ছে সেদিকে।অনুষ্ঠানের মাঝে বিঘ্ন ঘটায় আমার চোখেমুখেও বিরক্তি।অনেক খরচ করে জমকালো এক অনুষ্ঠান করে হারাধন মল্লিককে সংবর্ধনা দেবার বন্দোবস্ত হয়েছে।তার মাঝে এ আবার কেমন রসিকতা!
    এমন এক নামজাদা লেখককে হাতের কাছে পাওয়া কী চাট্টিখানি কথা? সেই লেখক আবার নিজের থেকেই ধরা দিয়েছেন আমাদের কাছে।সেদিন হঠাৎই আমাদের পত্রিকার অফিসে আচমকা উপস্থিত হারাধন মল্লিক।স্বনামধন্য লেখক।লেখালিখির জগতে যারা আছেন কিংবা যারা নেই তারাও হারাধন মল্লিকের নাম শোনেননি এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম।বাংলার সব কটা বাণিজ্যিক পত্রিকায় ওর লেখা গল্প নিয়মিত ছাপা হয়।এমন গুণী মানুষ অথচ কী প্রচারবিমুখ! সাহিত্যসভায় যান না।পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন।সাক্ষাৎকারও দেন না কোথাও।চিরকাল আড়ালেই থেকেছেন।আড়ালে মানে পাতার আড়ালে- গাছের নয় বইয়ের।লেখালিখিই ওর হয়ে কথা বলে।
    তা সে যাই হোক হারাধন মল্লিক যখন রবিবার সাতসকালে মালকোঁচা বেঁধে আমাদের পত্রিকার অফিসে পা রাখে তখন একটু অবজ্ঞা ভরেই তাকালাম ওর দিকে।নিশ্চই লেখা জমা দিয়ে খোঁজ নিতে এসেছে কবে ছাপা হবে।কিংবা তাগাদা।লেখা ছাপানোর অনুরোধ নিয়েও হাজার লোক ভিড় করে পত্রিকার অফিসে।ইনিও তেমনি কেউ একজন হবেন হয়তো।আমাকে বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন- চেনা গেল?
    কথা বলার ধরনে বেশ চমকেই উঠলাম।এমন তাচ্ছিল্যভরে কেউ আমার সাথে কথা বলে না।একমাত্র গিন্নি ছাড়া পত্রিকার সম্পাদক বলে একটু বাড়তি সম্মান সবার কাছেই পেয়ে থাকি।তাই আমিও দ্বিগুণ তাচ্ছিল্য ফিরিয়ে দিয়ে বললাম- না, গেল না।
  • আমি হারাধন মল্লিক।
  • হারা ধন মল্ লিক মানে…
  • এবারের ভিনদেশ পত্রিকায় আমার গল্পটা পড়েছ?
    আমার কপালটা হারাধন বাবুর পায়ের পাতায় ঠুকে বললাম- স্য স্য স্যর আপনি হারাধন বাবু মানে সেই ‘হারানো গুপ্তধন’ যিনি লিখেছিলেন!
    হারাধনবাবু সলজ্জ হেসে বললেন- হ্যাঁ ভায়া আমিই সেই হারাধন।এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম।তোমরা তো অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা পত্রিকা নিয়ে বেশ ভালো কাজ করছ।বেশ নাম হচ্ছে তোমাদের ‘হলুদ পাখি’ পত্রিকার।তাই ভাবলাম যাচ্ছি যখন একবার ঢুঁ মেরেই আসি। দেখে আসি তোমাদের পত্রিকার অফিস।
  • ভালো করেছেন স্যর।এতো আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আপনার মতো দেবদূতকে ঈশ্বর আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
    আমার দেখাদেখি অন্য বন্ধুরাও এক এক করে হারাধনবাবুর পায়ে মাথা ঠুকেছে।ঈশ্বর দর্শন যে এত সহজ সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
  • স্যর আপনাকে যখন একবার পেয়েছি তখন আর ছাড়ছি না।
  • না না ছাড়ো ছাড়ো।আমার পা ছাড়ো।
  • না স্যর- ইয়ে মানে আমরা ওই ছাড়ার কথা বলছি না।বলছিলাম আপনি এত বড় লেখক, জানি বাণিজ্যিক কাগজ ছাড়া অন্য কোথাও লেখেন না।তবু যদি আমাদের মতো লিটল ম্যাগকে একটা লেখা দেন…
    হারাধন মল্লিক ভুঁড়ি নাচিয়ে বললেন- হে হে আমি জানতাম, তুমি ঠিক এই আবদারটাই করবে।আসলে জানো কী ভায়া সব্বাই লেখা চায়।আমি তো আর লেখার ফ্যাক্টরি খুলে বসিনি।এত লেখা কোথায় পাব? তবে তোমরা ভালো কাজ করছ বলে পকেটে একটা লেখা নিয়েই বেরিয়েছি, যাতে তুমি চাইলে ফিরিয়ে দিতে না পারি।
    লেখাটা ছোঁ মেরে তুলে বুকে রাখলাম থুড়ি বুক পকেটে রাখলাম।
    বললাম- আপনার আশীর্বাদ ভেবে লেখাটা নিলাম।আগামী সংখ্যাতেই এই গল্পটা থাকবে।
  • একবার পড়ে নিও।
  • সেটার আর প্রয়োজন হবে না।আপনার নামটুকুই যথেষ্ট।আর একটা রিকোয়েস্ট আছে স্যর।
  • আবার কি?
  • ওই সামনের মাসে আমাদের এনুয়াল প্রোগ্রামে আপনাকে একটু সম্মানিত করতে চাই।
    হারাধন মল্লিক একটু নড়েচড়ে বসে বললেন- ওসব আবার কেন?আমি তো চট করে কোথাও যাই না।আর সম্মান টম্মান আবার কেন বুড়ো বয়সে?
  • বেশি কিছু নয় স্যর।ওই মাল্যদান আর স্মারক প্রদান।ভক্তের ভালবাসা ভেবে গ্লহণ করবেন।আমাদের লোকজন আপনাকে গাড়ি করে নিয়ে আসবে।
  • তা তোমরা যখন এত করে চাইছ তখন আসব না হয়।তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না কিন্তু, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিও।
    সেদিনের কথামতোই হারাধন মল্লিককে আমাদের ছেলেরা বাড়ি থেকে তুলে এনেছে।গাড়ি থেকে নামতেই একেবারে পাঁজাকোলা করে স্টেজে বসিয়েছে যাতে অতিথির মর্যাদা সামান্যতম ক্ষুণ্ণ না হ্য়।
    ওদিকে সেই রসভঙ্গকারীকে আমাদের ছেলেরা এই মারে তো সেই মারে।আমি ভিড় ঠেলে সেদিকে যেতেই তার মুখশ্রীর দর্শন পেলাম।পরনে ময়্লা জামাকাপড়।চোখ দুটো কোটরে ঢোকা।মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো যেন কাকের বাসা।
    আমাকে দেখে বলল- স্যর ফুলগুলো ভুল জায়গায় চলে এসেছে।
    আমি মনে মনে তার বাপান্ত করে বললাম- গুল মারার জায়গা পাওনি ব্যাটা?আমি নিজে এই খুচরোর আকালেও কড়কড়ে একশো টাকার নোট গচ্চা দিয়ে এসেছিলাম, যাতে মালা পড়ানোর সাথে সাথে রজনীও ফুলের গন্ধে ম-ম করে।সেই ফুলের মালাই তো আমার এখানে পৌঁছেছে।এখন বলে কিনা ভুল জায়গায় এসেছে!
    পিছন থেকে কেউ একজন বলল- মার ব্যাটাকে তাহলেই ওর পাগলামি ছুটে যাবে।ঘা কতক পড়লেই সব চুল রান্নাঘরের ঝুল হয়ে যাবে।তখন আর ভুল বকবে না।
  • স্যর দুটো মালা দেখতে একইরকম।তবে এটা হানিকারক।
    আমি চোখ দুটো গোল গোল করে বললাম – মানে?
  • হানিকারক মানে মধুমাখানো স্যর।
    বিরক্ত হয়ে বললাম- যতোসব পাগলের উৎপাত।একে চ্যাংদোলা করে বাইরে নিয়ে গিয়ে আড়ং ধোলাই দে।রাঁচি থেকে নির্ঘাৎ ছাড়া পেয়ে এখানে অনুষ্ঠান পন্ড করতে এসেছে ব্যাটা।
    হঠাৎই দেখি সেই ফুলের দোকানের মালিক হন্তদন্ত হয়ে হাজির।হাত দুটো জোড় করে বলল- ওর দোষ নয় দাদা।ওকে মারবেন না।ও একটু মাথা পাগল আছে ঠিকই কিন্তু ভুল কথাও কিছু বলছে না।ওই মালাটায় সত্যিই মধুমাখানো আছে।ওটা অন্য একজনের অর্ডারের মাল।ভুল করে আপনাদের এখানে চলে এসেছে।আপনাদের মালাটা আমি নিয়ে এসেছি।ওটা দিয়ে এটা নিয়ে নিন।
    আমি মাথা চুলকে বললাম- কিন্তু এই মালাটায় মধুমাখানো কেন?
    আর বলবেন না দাদা।পাড়ার কিছু দুষ্টু ছেলে ওদের স্কুলের এক মাস্টারমশাইকে জব্দ করবে বলে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে এটা বানিয়েছি, যাতে মালা পড়ানোর সাথে সাথে ঝাঁকেঝাঁকে মৌমাছি নয়তো লাল পিঁপড়ে ছুটে আসে মধুর লোভে।
  • হুম সবই বুঝলাম কিন্তু তোমার কর্মচারী ছেলেটা এসে ‘কাট কাট’ করছিল কেন?
  • ছেলেটা দারুণ ব্রিলিয়ান্ট ছিল।পড়াশোনাতেও হেব্বি মাথা।সেবার ডেঙ্গু হবার পর থেকেই স্মৃতিশক্তিটা একটু বিগড়েছে; সেই সাথে মাথাটাও।ফিল্ম ডিরেক্টর হবার খুব শখ ছিল।কোন কাজ উল্টোপাল্টা হচ্ছে দেখলেই ওর মাথার ব্যামোটা নড়াচড়া করে।তখনই ওরকম ‘কাট কাট’ করে।
  • এরকম মাথা পাগল লোককে কাজে রাখেন কেন?
  • সেরকম পাগল নয় দাদা।সব কাজ তো ঠিকঠাকই করে।শুধু ওই ফিল্মের ভূতটা মাথাচাড়া দিলেই ওরকম পাগলামি করে।হারাধন মল্লিকের নাম শুনেছেন তো? খুব বড় লেখক।উনি ওর বাবা।হারাধনদাই আমাকে বললেন, ছেলেটাকে তোমার কাছে কাজে রাখো।পড়াশোনা তো হল না।এখন কাজকর্ম করলে যদি ফিল্মের ভূতটা মাথা থেকে নামে।
    মনে মনে আওড়ালাম নামটা।তারপর নিজের কানের ওপরে বিশ্বাস রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম- কি নাম বললেন যেন ওর বাবার?
  • আজ্ঞে হারাধন মল্লিক।
    ভুরু জোড়া নাচিয়ে চোখের ইশারায় প্রধান অতিথির আসন অলঙ্করণ করে বসে থাকা মানুষটাকে দেখিয়ে বললাম- এই ভদ্রলোকই তো হারাধন মল্লিক?
  • ধ্যাৎ, কি যে বলেন ? ইনি কেন হতে যাবেন? আমি যার কথা বলছি তিনি গৃহবন্দীই থাকেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোন না। আমার সাথে ওনার ভাল পরিচয় আছে। আমাকে ওনার বই ‘ হারানো গুপ্তধন’ও দিয়েছিলেন। স্টেজে যিনি বসে আছেন তিনি অন্য হারাধন মল্লিক হবেন।
    মুহূর্তে সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। মনে হল ঘরে এখুনি অন্ধকার নেমে এল। অন্ধকারেই আমার মস্তিষ্কের টিস্যু গুলো একটু একটু করে সক্রিয় হতে শুরু করল। পুরো বিষয়টা আস্তে আস্তে জলের মত পরিষ্কার হল এবার। লেখক হারাধন মল্লিকের নাম ভাঁড়িয়ে এই লোকটা এসেছে যদিও এর নামও হারাধন মল্লিকই। লেখালিখি একটু আধটু করে নিশ্চই। নাম ডাক হয়নি সেভাবে। লেখাপত্রও বোধহয় কোন পত্রিকা ছাপায় না। তাই এই ছলনা। লেখক হারাধন মল্লিক সেজে আমাদের পত্রিকার দপ্তরে এসেছে। জানে এই নাম শুনেই ওর লেখা ছাপা হয়ে যাবে। পত্রিকায় লেখা প্রকাশের কী ভীষণ লোভ ! উপরি পাওনা হিসেবে এই সম্মাননাও জুটে গেল। একটা ঢিল ছুঁড়েছিল। লেগে গেল দুটোতে। বাড়ি ফিরে সম্মাননার ছবি যে ফেসবুকে পোষ্ট করবে সেটা এখনই হলফ করে বলে দেওয়া যায়। সাত পাঁচ না জেনে আমিও তাড়াহুড়ো করে সব আয়োজন করে ফেলেছি। নিজের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য নিজেরই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মরবই বা কোথায়? হয় চৌবাচ্চার জলে ডুবে মরতে হয়, নয়ত উচ্ছে গাছের ডালে গলায় দড়ি দিতে হয়। কাছাকাছি আর কোন অপশান নেই।
    ভাবছি । ভাবছি। চারিদিকে এবার সত্যিই আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনের লোককেও আর চেনা যাচ্ছে না। হঠাৎই স্টেজের মধ্যে ” উঃ মাগো” বলে প্রচন্ড জোরে এক চিৎকার। পরক্ষণেই সেই শব্দ ছাপিয়ে জলদ গম্ভীর স্বরে কে যেন বলে উঠল ” লাইট- ক্যামেরা- একশান” । মুহূর্তে স্টেজের সব আলো জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দেখা গেল হারাধন মল্লিক ডিম্বাহত হয়েছেন। মানে কোন অজ্ঞাতকুলশীল দর্শক ধৈর্যচ্যুতির কারণে ডিম ছুঁড়েছেন আর সেই ডিমের আঘাতে হারাধন মল্লিক টেবিলের ওপরেই লুটিয়ে পড়েছেন। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে চেয়ার থেকে তুললাম। ঝাঁ চকচকে সাদা পাঞ্জাবীতে ডিম্ব কুসুম সূর্যমুখী ফুলের মতো বিকশিত হয়েছে।- পাষন্ডের দল সব।আমার সাথে মস্করা!
    রাগে ফুঁসছে হারাধন।
    পরিস্থিতি সামাল দিতে একছুট্টে স্টেজে উঠে বললাম- ঘোর অন্যায় স্যর।মালা পড়াতে বিলম্ব ঘটাতেই এই বিপত্তি।দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে।তারা সবাই যে আপনাকে মাল্যভূষিত হয়ে দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।চলুন স্যার মুখ হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি মালাটা গলায় নিন।
  • নিকুচি করেছে তোমার মালা! ওই মালা পড়ার চক্করে আমার বুকটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে।এখন মানে মানে পালাতে পারলে বাঁচি।
  • চলে যাবেন বলেই যখন মনস্থির করেছেন তখন কি আর বলি?
    আমার ইশারায় বন্ধুরা ধরাধরি করে ওকে স্টেজ থেকে নামাচ্ছে। আর সেই দিকে তাকিয়ে আমার পেটের নাড়ি গুলো প্রবল উচ্ছাসে কলকলিয়ে উঠছে। মনের ভিতর অট্টহাস্য চলছে, অথচ বাইরে তার প্রকাশ নেই। শান্ত, স্তিতধী এক সম্পাদক যেন তার স্বীয় কার্য সম্পন্ন করছে। আসলে কেউ জানেই না স্টেজের আলোটা কার ইশারায় নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দর্শক আসন থেকে কোন ডিম উড়ে আসেনি। আসতে পারেই না। ওই ডিমটা যে ছুঁড়েছিল তার পেটের ভিতর এক নিঃশব্দ অট্টহাসি চলছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।