গল্পবাজে মুহাম্মদ সেলিম রেজা

অর্ডার অর্ডার

সেদিন কথায় কথায় নলিনীদাদু বললেন, পেঁচো তুমি কী জানো মদন একবার মার্ডার কেসে জড়িয়ে পরেছিল।
– বলেন কী! মদনদার মতো মানুষ….
আমার দেখা মদনদা নিতান্ত ভীতু মানুষ। জীবনে একটি মৎস‍্য শিকার করেছে কিনা সন্দেহ আছে। সেই তিনি মানুষ খুন করেছেন শুনে নিজের কান-কে বিশ্বাস করতে অবিশ্বাস হচ্ছিল। পরক্ষণে নলিনীদাদু আমার মানসিক অস্থিরতা নিরসন করে বললেন, ওহে তুমি যা ভাবছ ঘটনা তা নয়। মদন নিজ হাতে খুন করেনি।
– তাইতো বলি মদনদার মতো মানুষ….
– বল বল! আমার মতো মানুষ কী? আমার কথা কেড়ে নিয়ে মুখঝামটা দিয়ে উঠলেন মদনদা।
যা বলতে চাচ্ছিলাম তা আর বলার সাহস হল না। ঢোক গিয়ে বললাম, আপনি খুন করতেই পারেন না।
– কেন পারি না?
– খুন করতে বুকের পাটা লাগে চাঁদু! তোমার তা নেই। এমন কথা বলতেই পারতাম। কিন্তু….
কিচেন থেকে ভেসে আসছে পিঁয়াজি ভাজার সুঘ্রাণ। মদনদার মটকা গরম হলে এক ধাক্কায় আড্ডার অক্কাপ্রাপ্তি ঘটবে শুধু তাই নয়, হাতেগরম পিঁয়াজি ভাজার সাথে গাঢ় দুধের চা থেকেও বঞ্চিত হতে হবে। এতটা লোকসান হজম করার হিম্মত আমার কোনকালেই ছিল না। আজও হল না। বাচ্চারা যেমন নাকের ডগায় এসে যাওয়া সিকনি সরাত জোরে টেনে নেয়, তেমনি ঠোঁটে আসা কথা ঢক করে গিলে চুপ করে গেলাম।
ওদিকে দাদা নির্বিচারে বাক‍্যবর্ষণ করে চলেছেন, খুনদের বুঝি চারটে করে হাত-পা থাকে, ওরা বুঝি বাঘের দুধ খেয়ে বড়ো হয়? শ্লা এই শরীরে একদিন মোষের মতো জোর ছিল। কুস্তির আখরায় কতো বড়ো বড়ো পালোয়ানকে চুটকিতে চিৎ করেছি। সেই আমাকে কিনা তুই….
হঠাৎ করে টেবিলের উপর কনুই গেঁড়ে ডাক দিলেন, আয় দেখি কেমন মরোদ তুই আমাকে চিৎ করে দেখা।
ওইতো পাটকাঠির মতো অস্থিচর্মসার লিকলিকে হাত।একটা মোচড় দিলে ভেঙে দু’-টুকরো হয়ে যাবে। তাঁর সাথে লড়ব কী? কিন্তু তিনি যেভাবে বলছেন, সাড়া না দিলে নিজের বেইজ্জতি। অপরদিকে তাঁকে গুরুদেব মানি, তাঁর এতটুকু অসম্মান হোক চাই না। ‘শ‍্যাম রাখি না কুল’ – মানসিক দ্বন্দ্বে দীর্ণ আমি করুন দৃষ্টিতে নলিনীদাদুর দিকে তাকালাম। বুড়ো বসে বসে দিব‍্যি মোচে তা দিচ্ছেন। দেখেশুনে পিত্তি জ্বলে উঠল চিরচির করে।
এমনসময় বৌদি ট্রে হাতে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। ডুবন্ত শিশু যেমন জলে ভেসে থাকা খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, আমিও তেমনি বৌদিকে অবলম্বন করে আত্মসম্মান রক্ষার্থে উৎগ্রীব হয়ে উঠলাম। ট্রে থেকে একটা কাপ তুলে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলাম, দাদা চা খান।
– হার স্বীকার করে নিচ্ছিস তবে?
– গুরুদেব মানুষ আপনি। আমি চ‍্যালাচামুণ্ডা। আপনি জিতবেন সেটাইতো স্বাভাবিক দাদা।
– কিসের হারজিত ঠাকুরপো?
আমি কিছু বলার সূযোগ পেলাম না। দাদাই উত্তর দিলেন, ওকে পাঞ্জা লড়াতে ডাকলাম। শ্লা চ‍্যালেঞ্জ নিতে পারল না। ওর বয়সে আমি….
– দারা সিংকে হারিয়েছিলে, গিনেস বুকে লেখা আছে। একথা বলে বৌদি নলিনীদাদুর হাতে কাপ ধরিয়ে দ্রূত বেরিয়ে গেলেন। তাঁর চলার পানে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মদনদা। অতঃপর তাঁর কন্ঠ বেয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ল, শুনলে নলি বুড়ির কথার ছিরি!
ততক্ষণে দাদু চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন। সুড়ুত করে একটা ঢোক গিলে বললেন, দাম্পত‍্য জীবনের এটাইতো মজা হে। কখনও সে তোমাকে, কখনও তুমি তাকে খোঁচা দেবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যত অম্লমধুর, ভালোবাসা ততই মজবুত।
– ভালোবাসা! সে আর জীবনে পেলাম কই? বুড়ি আমাকে কোনদিনই ভালোবাসেনি। মদনদার অন্তঃস্তল তোলপার করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
– অনায‍্য কথা বললে ভায়া। ভালো না বাসলে দীর্ঘদিন কেউ কারো কাছে থাকতে পারে? অতঃপর দাদু একখণ্ড পিঁয়াজি মুখে নিলেন। চিবোতে চিবোতে আবারও বললেন, ওসব কথা থাক এখন! সেদিন কোর্টে কি হয়েছিল শোনাও আমাদের।
নলিনীদাদু চা পানে মনোনিবেশ করলেন। মদনদা ও। আমার কাপ অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে। কাপটা একদিকে সরিয়ে রেখে চেপে বসলাম। চা-পান শেষ করে মদনদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গলখাকারি দিয়ে শুরু করলেন, ল-পুকুরের একখণ্ড ডাঙাজমি নিয়ে ঘোষেদের সাথে হালদারদের বিবাদ তিনপুরুষের। উভয়পক্ষের দাবি জায়গাটা তাদের। এই নিয়ে আদালতে মামলা চলছিল। দীর্ঘদিন বিচার পর্ব চলার পর আদালত হালদারদের পক্ষে রায়দান করেন। কিন্তু ঘোষেদের তা মনঃপুত হয়নি। হালদাররা জমির দখল নিতে গেলে বাধা দেয় তারা। পরিনতি, নিমু হালদারের বড় ছেলে চিন্ময় মারা যায় বোমার আঘাতে।
থামলেন মদনদা। এই অবসরে নলিনীদাদু বললেন, তখন আমি মুজফ্ফনগর রেল স্টেশনে কর্মরত। মাস খানেক বাদে দূর্ঘটনার সংবাদ পায়।
– ঘটনার সময় আমিও গ্রামে ছিলাম না। সংবাদ পেয়ে ফিরলে হালদাররা এফআইআর লিখে দিতে বলল।
– তারপর?
– নিমুকাকা যেমন যেমন বললেন আমি লিখে গেলাম। তখন কি আর জানতাম এই কারণে কাঠগড়ায় উঠতে হবে। ওফ! সে একটা দিন গেছে। উকিল ব‍্যাটার সেকি হম্বিতম্বি! এমন জেরা করছিল যেন খুনটা আমিই করেছি। কিন্তু ও ব‍্যাটার জানা ছিল না আমি….
– মদন চক্কোতি! কে না জানে তোমার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। বৌদি কখন দরজার ওপারে অবস্থান নিয়েছেন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। তাঁর মন্তব‍্যে বিরক্ত মদনদা দপ করে জ্বলে উঠলেন, তবে নাতো কি তোমার মতো….
– আঃ মদন থামতো। জল অন‍্য খাতে প্রবাহিত হচ্ছে অনুধাবন করে দাদু মাঝখানে মদনদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমিতো এমন বেরসিক ছিলে নাহে! বৌঠান তোমাকে তাতাচ্ছে বুঝতে পারছ না?
দাদা কি বুঝলেন তিনিই জানেন। ওই প্রসঙ্গে আর উচ্চবাচ‍্য করলেন না। খানিকটা পানি ঢেলেলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলে, আদালত কক্ষ লোকে লোকারণ‍্য। ভিড় ঠেলে গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম। ঘোষেদের উকিলসাহেব লয়লয় করে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর….
সেদিন আদালত কক্ষে যা যা ঘটেছিল এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন মদনদা। আমি পেঁচো নিজ বয়ানে তা আপনাদের শোনাচ্ছি মাত্র। বিশ্বাস করা না করার দায়ভার আপনাদের।
উকিলসাহেব এক তা মদনদার হাতে দিয়ে জানতে চাইলেন, এই লেখা আপনার?
মদনদা এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, হ‍্যাঁ! চিন্ময় মার্ডার কেসের এফআইআর আমিই লিখেছি।
– লিখেছেন জয়ন্ত ঘোষের ছোড়া বোমায় চিন্ময় হালদার মারা গেছে। আপনি কি জয়ন্ত ঘোষকে বোমা ছুড়তে দেখেছিলেন?
– না দেখিনি। ঘটনার সময় আমি গ্রামে ছিলাম না।
– তার মানে আপনি দেখেননি কে বোমা ছুড়েছে?
– ঠিক তাই।
– তাহলে লিখেছেন কেন?
– যে কারণে আপনি জয়ন্ত ঘোষের হয়ে আদালতে সওয়াল করছেন।
– কী বলতে চাইছেন আপনি?
– আইনের মারপ‍্যাঁচ ঘোষমশাইয়ের জানা নেই। আপনি আইন বিশারদ, তাই তিনি আপনাকে তাঁর হয়ে আইনি লড়াই করার অধিকার দিয়েছেন। তেমনি নিমু হালাদার লিখতে পড়তে জানেন না। আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন।
– তাই বলে অসত্য লিখবেন?
– কোনটা অসত‍্য?
– জয়ন্ত ঘোষ বোমা ছোড়েনি।
– আপনি কী করে জানলেন? ঘটনার সময় আপনি কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন?
– না মানে! আপনি….
বেকায়দায় পরে উকিলসাহেব কি বলবেন ভেবে পান না। একবার জজসাহেবের দিকে তাকান, একবার মদনদার দিকে। একজদ দুঁদে আইনজীবীকে সাক্ষীর কাছে নাস্তানাবুদ হতে দেখে আদালত কক্ষে উপস্থিত লোকজন হাসি চেপে রাখতে পারে না। বিরক্ত হয়ে জজসাহেব জোরে জোরে হাতুড়ি ঠুকতে লাগলেন, অর্ডার। অডার।
বলাবাহুল‍্য মনদাকে আর কোন প্রশ্ন করার সাহস হয়নি উকিলসাহেবের।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।