মদনদাকে চেনে না এমন লোক এ তল্লাটে নেই বললেই চলে। যারা চেনো না তাদের অবগতির জন্য বলি, গাঁয়ে ঢুকে বড় পুকুরটার পূর্বপাড়ে একজোড়া তালগাছ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরানো দিনের ধ্বংসপ্রায় জমিদার বাড়ি। ওই বাড়িতে শ্যামলা রঙের ঢ্যাঙা-পালতা, তোবড়ানো মুখমণ্ডল, নাকের নিচে অর্ধচন্দ্রের মতো বাঁকা এক চিলতে সরু গোঁফ, মাথার পিছনদিকে দু-তিন গাছি কাঁচাপাকা চুল নিয়ে যে লোকটা একমাত্র বউকে নিয়ে বসতি করেন, তিনি-ই আমাদের মদনদা। এমনিতে লোকটা মন্দ নয়। তবে মাঝে মাঝে এমন সব কান্ড করে বসেন যে, নিজে তো নাকানিচোবানি খায়-ই, গাঁ সুদ্ধ লোককে ভোগান্তিতে ফেলে দেন।
মদনদা কম করে হলেও বয়সে তিনগুণ বড়। তবু তার সাথে আমার সম্পর্ক খুব মধুর। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁর বাড়িতে যায়। গল্পগুজব করি, বৌদির হাতের র-চা খেয়ে বাড়ি ফিরি। সেদিনও গিয়েছিলাম। তবে একটু সকাল সকাল, সুর্য ডোবার পরে পরেই তাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। হাতে কাজকাম নেই, মদনদার সাথে লুডো খেলে কিছুটা সময় কাটাব।
আমাকে দেখেই তিনি প্রায় অনুযোগের সুরে বলে উঠলেন, বল দিকিনি পেঁচো মনের ভাব প্রকাশ করা কি অপরাধ?
আমার একটা গালভরা ভালো নাম থাকলেও আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী পেঁচো বলেই ডাকে। শোনা কথা, ছোটবেলায় আমি নাকি রাতে একদম ঘুমাতাম না। সারারাত রাতচোরা পেঁচার মতো জেগে থেকে ঠাম্মাকে জ্বালাতন করতাম। তাই ঠাম্মা আদর করে আমাকে পেঁচা বলতেন। ক্রমে পেঁচা থেকে পেঁচো হয়ে গেছি। ভালো নামটা রয়ে গেছে শুধু খাতাকলমে।
যাইহোক, আগেপিছে না ভেবে মদনদার জিজ্ঞাসার উত্তরে বললাম, তা কেন হবে দাদা। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সকলের বাক স্বাধীনতা আছে। – এ্যাই পেঁচো মুখ সামলে কথা বল। বৌদি রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে দৌড়ে এসে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরলেন, স্বাধীনতা আছে বলে কী যা খুশি তাই বলা যায়, যা খুশি তাই করা যায়?
– না, না। সবকিছুর একটা লিমিট আছে।
– বুঝেছো সবকিছুর একটা লিমিট আছে। বেশি বাড়াবাড়ি করবা তো নাক ভোতা করে দেব। বৌদি দু’ কদম এগিয়ে গিয়ে মদনদার নাকের ডগায় খুন্তি নাড়তে শুরু করলেন।
মদনদাও তেমনি। সজোরে নিজের উরুতে চপেটাঘাত করে বললেন, মোটেই আমি লিমিট অতিক্রম করিনি। যা বলেছি, হক কথা বলেছি। তুমি এখন….
– তবে রে নচ্ছার! আজ তোমার একদিন কি আমার। বৌদি হাতের খুন্তি ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাঁর দাদার মুখ টিপে ধরে আরও বললেন, আমি যদি ওই হই, তবে তুমি কে? তুমি একটা….। ক্ষণেকর জন্য থামলেন বৌদি। তারপর বললেন, তুমি একটা শুকনো পটল।
ততক্ষণে মদনদা বৌদির হাত ছাড়িয়ে নিয়েছেন। হাপাতে হাপাতে বললেন, শুকনো পটল তবু আলুর সাথে মিক্সড করে রান্না করা যায়। কিন্তু ও জিনিস কোন কাজের না, ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয়।
এ কোন ধাঁধা, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এ কেমন বিটকেল বিতণ্ডা? খেই খুঁজে না পেয়ে আমি উভয়ের মাঝ দাঁড়িয়ে হাতজোর করে বললাম, প্লিজ আপনারা চুপ করুন। কেন অশান্তি করছেন?
বলার সময় আমার মুখ, দৃষ্টি ছিল বৌদির দিকে। তাই তিনি কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছি ভেবে নিয়ে রণচণ্ডী রূপধারণ করে আমার উপর বর্ষণ শুরু করলেন, কী! আমি অশান্তি করছি? আমি ঝগড়ুটে, অশান্তিকামী? ওর হয়ে ওকালতি, তোমাকেও মজা চাখাচ্ছি দাঁড়াও।
অনেকদিন এ বাড়ি আসা-যাওয়া করছি। বৌদিকে কখনও এতটা রাগতে দেখেনি। খুন্তি কুড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলেন তিনি। বেগতিক বুঝে খপ করে তাঁর হাত চেপে ধরে বললাম, বৌদি আমি আপনার ছেলের মতো। ছেলে কখনও মা-কে খারাপ কথা বলতে পারে? দাদা নিশ্চয় খুব খারাপ কথা বলেছেন, তা নাহলে আপনার মতো শান্ত, নিরীহ….
আমার কথা শেষ হতে না হতে মদনদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চৌকি থেকে নেমে এসে, এক ঝটকায় আমাকে তার দিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে রীতিমতো ধমকের সুরে বললেন, এ্যাই, এ্যাই পেঁচো! শালা তোর কি মনে হয় আমি….
– তবে কী আমি? পাঁজরের কাঠিতে খোঁচা মেরে বললেন বৌদি। স্প্রীং লাগানো পুতুলের মতো আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে মদনদার দিক থেকে আর একটা খোঁচা উড়ে আসতে তার দিকে ঘুরে গেলাম। এইভাবে একবার বৌদি, একবার দাদা খোঁচা মারতে থাকেন। আর আমি এদিক ওদিক করতে থাকি। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, ওরা স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া করছে না আমার তেজ যাচাই করছে?
হাটে গরু কেনাবেচা করতে দেখেছেন তারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, ক্রেতা-বিক্রতা উভয়পক্ষ গরুর তলপেটে খোঁচা মারে, কখনো লেজে মোচর দেয়। আসলে ক্রেতা কেনার আগে দেখে নিতে চান পশুটা চাষের উপযুক্ত কি না? তেমনি বিক্রেতা খুঁচিয়ে প্রমাণ করতে চান তার পশুটা খুব তেজী। দাদা-বৌদির মাঝে পড়ে আমার অবস্থা অনেকটা সেরকম দাঁড়িয়েছে, মনে হচ্ছিল যেন আমি হাটের গরু। দাদা বেচবেন, বৌদি কিনবেন। অবলা পশু কথা বলতে পারে না, বাঁধা থাকায় পালিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু আমি মানুষ, তরতাজা যুবক। কত আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অত্যাচার সহ্য করব? একসময় ওদের কাছ থেকে সরে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, আপনারা দু’টোতেই….
– কী?
– কী আমরা?
প্রথমে দাদার, তারপর বৌদির জিজ্ঞাসা ছুটে এল। কোনরকমে সামলে নিয়ে বললাম, আপনারা এভাবে চেঁচামেচি করবেন না প্লিজ। কি হয়েছে বলুন? বৌদি আপনিই বলুন কী ব্যাপার।
– ছিঃ, ছিঃ! আমি ওকথা মুখে আনতে পারব না ঠাকুরপো। ওকেই বলতে বল। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে একপাশে সরে গেলেন বৌদি।
আমি দাদার দিকে তাকালাম। তিনি এটুকুতেই হাপিয়ে উঠেছেন। চৌকিতে বসে মস্তবড় হাঁ করে এক গ্রাস বাতাস গলাধকরণ করে বললেন, দু’-দিন আগে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম।
– গিয়েছিলেন জানি। কিন্তু কলকাতা যাবার সাথে আজকের ঘটনার সম্পর্ক কী?
– আছে রে আছে। থামলেন মদনদা। দম নিয়ে পুনরায় বললেন, কলকাতা থেকে ফেরার পর তোর বৌদি জানতে চাইল কি দেখে এলাম।
– একথায় দোষ কোথায়? বৌদি কলকাতা দেখেননি, না হয় আপনার চোখ দিয়ে দেখতে চেয়েছেন।
– শালা তুই বকবক করবি না আমাকে বলতে দিবি?
– বেশ, বেশ! আমি মুখ বন্ধ করলাম। বলুন আপনি, তারপর কি হল?
– আমি আসি ভাই। ও কথা আমি কানে নিতে পারব না। বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে মদনদা ভেঙচি দিয়ে উঠলেন, ওকথা কানে নিতে পারব না! ওরে আমার লজ্জাবতী লতা রে।
– নয়তো কি তোমার মতো বেহায়া! বুড়ো বয়সে…। ছ্যা, ছ্যা। বৌদি এমন মুখ বিকৃত করলেন যে আমারই গা গুলিয়ে উঠল। দাদার তাহলে কি হয়? তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে লাফিয়ে উঠলেন। আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললাম, শান্ত হোন দাদা। এই বয়সে আপনার….
– এই বয়স মানে! বলতে চাইছিস আমি বুড়ো হয়ে গেছি?
– বুড়ো নাতো কী? ফোড়ন কাটলেন বৌদি।
একথায় দাদার মাথায় আগুন চড়ে গেল। চৌকিতে তাল ঠুকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ আমি বুড়ো হয়ে গেছি। এখন তুমি একটা জোয়ান ধরে…
– শুনছো ঠাকুরপো ওর মুখের ভাষা। কেঁদে ফেললেন বৌদি।
– না দাদা এ আপনার অন্যায়। বৌদিকে এভাবে কথা বলা আপনার উচিত হয়নি।
– আমার বেলায় উচিত হয়নি, আর ও যখন বলছে? আমার বুঝি খারাপ লাগে না। হঠাৎ করে অভিমানী হয়ে উঠলেন মদনদা।
তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বৌদিকে অনুযোগ করে বললাম, বৌদি আর কখনও ওভবে কথা বলবেন না।
বৌদি কিছু বললেন না, শুধু ঠোট বাঁকালেন। যদিও তা মদনদার গোচরে আসেনি। আমার ঠোটে হাসি এসে গিয়েছিল। কোনরকমে সামলে নিয়ে মদনদার পাশে বসে বললাম, কলকাতায় কি কি দেখেছেন বৌদি জানতে চাইলেন, তারপর….
– সবই তাজা পাঁপড়, বাসি নেই বললেই চলে।
– সেকি দাদা!কলকাতায় যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, পাতাল রেল, নিক্কোপার্ক, এয়ারপোর্ট, কতকিছু দেখার আছে। আপনি সে সব না দেখে শুধু কোথায় কোথায় টাটকা পাঁপড় ভাজছে তাই দেখে বেড়ালেন?
– প্রজাপতির মতো ফুরফুর করে উড়ে বেড়াচ্ছিল তারা। যেদিকে তাকাই শুধু মচমচে তাজা পাঁপড়।
– আঃ মরণ! রসিকতা দেখে গলায় দড়ি দিতে মন করছে। টিপ্পনি কাটলেন বৌদি।
– দাদা আমিও অনেকবার কলকাতা গেছি, এমন কাণ্ড ঘটতে দেখিনি কোনদিন। সেদিন কী পাঁপড়ের ফেস্টিভেল ছিল?
একরাশ বিস্ময় নিয়ে মদনদার দিকে চেয়ে দেখি তিনি মিচিক মিচিক হাসছেন। হাসতে হাসতে বললেন, সে কিরে পেঁচো! তুই দেখিসনি?
– না দাদা, আমার চোখে কোনদিন পড়েনি।
– পড়বে কী করে? তোর ভিতরে সেই ফিলিংস-ই নেই।
পাঁপড় খেতে ফিলিংস! এ কোন হেঁয়ালি? আগাপাশতলা ভেবে তরা খুঁজে না পেয়ে করুন দৃষ্টিতে বৌদির দিকে তাকালাম। দেখলাম তিনিও মিচিক মিচিক হাসছেন। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আর্তনাদ করে উঠলাম, বৌদি!
– আমি ততক্ষণ দু’কাপ চা করে আনি। হাসতে হাসতে পালিয়ে গেলেন বৌদি।
– তাজা পাঁপড় আর বাসি পাঁপড়ের তফাৎ বুঝিস না? এই ছেলেকে যে মেয়ে দেবে সে একটা আহাম্মক। বৌদি চলে যেতে মদনদার দিকে তাকালে ক্রূর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন তিনি।
ইতিমধ্যে পাত্রী খোঁজা শুরু হয়েছে। আমারও আগ্রহ আছে। আমি যথেষ্ঠ শিক্ষিত, বড় কোম্পানিতে চাকরি করি। মাসে মাসে মোটা টাকা মাইনে তুলি। নিশ্চয় পাত্র হিসাবে একেবারে ফেলনা নই। তাহলে কেন এমন কথা বলছেন মদনদা? তবে কি এর বাইরে আরও কিছু যোগ্যতা থাকতে হয় বিয়ে করতে গেলে। কনফিউজড হয়ে গেলাম, কিছুটা বিমর্ষও।
আমি কথা বলছি না দেখে মদনদাই আবার বললেন, তাজা পাঁপড় খেতে কেমন বল দেখিনি?
– সুস্বাদু, মচমচে। একবার খেলে আবার খেতে ইচ্ছা করে। খানিকটা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আর বাসি পাঁপড়?
– ফালতু। মুখে তোলা যায় না। জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে মদনদা আমার উরুতে চটাং করে একটা চাপড় মেরে বললেন, কাল থেকে এই কথাটা তোর বৌদিকে বোঝাতে পারছি না। আঠারো থেকে পঁয়ত্রিশের মেয়েরা হলো গিয়ে তাজা ভাজা, তার পরের গুলো….
– বাসি! আমার অজান্তে শব্দটা মুখ ফসকে বেরিয়ে এল। অমনি আর একখানা চাপড় আমার উরুতে আছড়ে পড়ল।
– তাহলে বল তোর বৌদি তবে কী?
সর্বনাশ! একথা কী মুখে আনা যায়? দাঁতে জীভ কেটে দ্রূত মদনদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগালাম। শুনতে পেলাম বৌদি চিৎকার করছেন, পেঁচো। পেঁচো। ও ঠাকুরপো চা খেয়ে যাও।