গল্পেসল্পে মৃদুল শ্রীমানী

কোহিনূর আর যুদ্ধ আর রাজা রাজড়া

রাজা একটি বালিকা চাইল। পাঠিয়ে দিল তার তীর আর ধনুক। ওই হল রাজপ্রতিনিধি। তীর আর ধনুক নিয়ে এল মেয়ে। সতেজ সুন্দরী কিশোরী জিন্দ কৌর আউলাখ। ১৮১৭ সালে জন্ম জিন্দ এর। ১৮৩৫ এ বিয়ে। আঠারো বছরের সুদেহিনী হয়ে উঠলেন তিনগুণ বয়স্ক রাজা রণজিৎ সিংহের চোখের মণি। হ‍্যাঁ, রাজার বয়স তখন চুয়ান্ন বৎসর। তিনি পাণিগ্রহণ করলেন অষ্টাদশীর।
তার মানে এই নয় যে রাজার ঘরে রাণী ছিল না। শিখ মহারাজা রণজিৎ সিংহ ( ২ নভেম্বর ১৭৮০ – ২৭ জুন ১৮৩৯) আটান্ন বৎসর বেঁচেছিলেন। জিন্দ নামের কিশোরীটির পাণিগ্রহণ করার আগে তাঁর ঘরে চার চারটি রাণী, মেহতাব কৌর, দাতার কৌর, রাণী হর দেবী, আরো কে যেন, আর সাত সাতটি উপপত্নী। কেউ কেউ বলেছেন রাজার নাকি কুড়িটি বৌ ছিলেন। রাজা মরলে এঁরা অনেকেই স্বেচ্ছায় সতী হয়েছিলেন বলে লোকশ্রুতি।
দলীপ সিংহ ছিলেন মহারাজা রণজিৎ সিংহের কনিষ্ঠতম সন্তান। আরো নয়টি সন্তান ছিল মহারাজার। খড়ক সিংহ, ইশার সিংহ, রতন সিংহ, শের সিংহ, তারা সিংহ, ফতে সিংহ, মূলতানা সিংহ, কাশ্মীরা সিংহ, পেশোয়ারা সিংহ তাঁদের নাম। তবে শিশুপুত্র দলীপ সিংহ ( ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ – ২২ অক্টোবর ১৮৯৩) ছিলেন শিখদের সর্বশেষ মহারাজা।
তো রাজা রণজিৎ সিংহ ১৮১৩ সালে আফগান দুরানি বংশের সুজা শাহ দুরানিকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর প্রাণরক্ষার বিনিময়ে কোহিনূর হিরে আদায় করেন। আর ১৮৩৯ সালে তিনি মারা পড়লে কোহিনূর হিরে বিপন্ন হয়ে পড়ল। কোহিনূর হিরে ছিল ময়ূর সিংহাসনে। মোগলেরা সারা ভারতীয় উপমহাদেশের ধনরত্ন নিজেদের আয়ত্ত্বে আনতে ভালবাসত। কোহিনূর হিরেও তারা কেড়ে এনেছিল। নাদির শাহ মোগলদের অতুলনীয় ধনসম্পদ দেখে লুব্ধ হয়েছিলেন। ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ দিল্লি লুঠ করলেন। সাতশো হাতি, চার হাজার উট, আর বারো হাজার ঘোড়ার পিঠে করে মোগলাই দিল্লির ধনসম্পদ লুঠে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন নাদির শাহ। তবে তিনি কোহিনূর হিরে ময়ূর সিংহাসন থেকে খুবলে তুলে বাহুবন্ধ বানিয়ে পরলেন।
কোহিনূর হিরে নিয়ে গল্প কথার অন্ত নেই। ও এক অসাধারণ হিরে। কেউ বলে ও হিরে আসলে পৌরাণিক কৃষ্ণের স‍্যমন্তক মণি। তিনি সেটা পেয়েছিলেন নদীতটে, পলির মধ‍্যে। কেউ বলে ও হিরে পাওয়া গিয়েছিল কৃষ্ণা নদীর তীরে, তেরফুট পলির গভীরে। গোড়ায় অনেকটা বড় ছিল ওই হিরে। কাকতীয় বংশের রাজারা ওয়ারাঙ্গলে তাঁদের দেবী ভদ্রকালীর বামচক্ষুতে স্থাপন করেছিলেন ওই হিরে।
হিরেটি কাকতীয় শাসকদের দখল থেকে লুঠ করেছিলেন পাঠান সুলতান আলাউদ্দিন খলজী। তারপর ১৫২৬ সালে পাণিপথের যুদ্ধজয় হলে ওই হিরে এল মোগলসম্রাট বাবরের হাতে।
১৭৩৯ এ দিল্লি লুঠ করেছিলেন নাদির শাহ। কোহিনূর তো বটেই আরো অজস্র দামি দামি মণি মাণিক‍্য লুঠেরা নাদির শাহের কবলে গেল। গেল আরেকটি বিখ্যাত হিরে দরিয়া ই নূর এবং তৈমুর চুনি।
খুন জখম বিশ্বাসঘাতকতা জড়িয়ে ছিল কোহিনূরের ইতিহাসে। লুঠেরা নাদির শাহ খুন হয়েছিলেন ১৭৪৭ সালে। ১৭৫১ সালে নাদির শাহের বংশধর তাঁর নাতির থেকে কোহিনূর গেল আহম্মদ শাহ দুরানির হাতে। ওই আফগান শাসকের নাতি সুজা শাহ্। সুজাকে আশ্রয় দিয়ে তার মূল্য হিসেবে ১৮১৩ সালে তাঁর থেকে হিরেটি আদায় করেছিলেন পঞ্জাব ‌ই শের মহারাজা রণজিৎ সিংহ। অবশ্য তিনি সুজাকে সে সময় একলক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তবে হিরের দাম যে তার বহুগুণ ছিল তা রণজিৎ সিংহ জানতেন।
হিরে জিনিসটা কিন্তু পলিতে তৈরি হয় না। ও তৈরি হয় মাটির অনেক নিচে, অন্তত দেড়শত কিলোমিটার গভীরে আগ্নেয়গিরির কাছে সাংঘাতিক উষ্ণতার মধ‍্যে কার্বন অণুর সমযোজী বন্ধনে অকটাহেড্রাল কিউবিক ক্রিস্টাল হিসেবে। আর সেও অন্তত এক থেকে তিন বিলিয়ন বৎসর আগে। কিম্বারলাইট আকরিক ওই গভীরতায় দানবিক চাপে আর ওই উচ্চতাপে হিরে বানায়। আর তা আগ্নেয়গিরির লাভার সঙ্গে উদ্গীর্ণ হয়। লাভা পাথর প্রাকৃতিক উপায়ে ক্ষয় পেয়ে নদীপথে পলি হিসেবে বাহিত হতে পারে। তাই নদীতটে মানিক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়।
তবে হিরে হলেই হল না। হিরের আছে চারটি সি। কালার বা বর্ণ, ক্ল‍্যারিটি বা স্বচ্ছতা, কারাট বা মাপ আর কাট, মানুষ তাকে কেটেকুটে চমৎকার রূপ দেয়। সবচাইতে দামি হিরে হবে বর্ণহীন। হালকা নীলচে আভাও থাকতে পারে। কোহিনূর হিরে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, অবিশুদ্ধিমুক্ত অপদ্রব‍্যবর্জিত ক্লাস টুএ হিরে। ক্লাস টুবি হিরে নাকি আরো দুর্লভ।সাধারণ গড়পড়তা হিরেয় হলুদ আভা থাকে। ওটা হয় ভিতরে কেলাসের ফাঁকে নাইট্রোজেন পরমাণু বাঁধা পড়ে থাকলে। হিরে খুব কঠিন। মোহ্ স্কেলে সে দশঘরের। তার এক আধটু কাছে যায় কোরাণ্ডাম। সে ন ঘরের।
দামি হিরে ঝলমল করবে। অন‍্য সব মণি মাণিক‍্য থেকে সে বেশি আলো প্রতিসরণ করে। কেন করবে না ? তার প্রতিসরাঙ্ক যে অনেক, ২.৪২।
হিরে যেমন কঠিন, তেমনি ঘন, প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে তার ভর সাড়ে তিনগ্রামের বেশি।
কারাট হল হিরের ভর আর সাইজের গল্প। এক কারাট মানে ৬.৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের হিরে। আর তার ভর হবে দুশো মিলিগ্রাম। এই হিসেবে কোহিনূর হিরেটি মহারাজা রণজিৎ সিংহের হাতে ছিল ১৮৬ কারাটের জিনিস। ব্রিটিশ সরকারের করতলগত হবার পর ১৮৫২ সালে সে অনেকটাই ভর হারিয়ে ফেলেছে। কাটাকুটির পর কোহিনূর এখন ১০৫.৬ কারাটের। তার ভর ২১.১২ গ্রাম মাত্র।
এখনকার দিনে অস্ট্রেলিয়ায় বেশি হিরে পাওয়া যায়। কঙ্গোতেও। রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও উল্লেখযোগ্য হারে হিরে মেলে‌।
তবে অনেক আগে হিরে পাওয়া যেত ভারতে। ১৭২৫ সাল নাগাদ বেশিরভাগ হিরে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে লুটপাট হয়ে চলে যেতে ভারত থেকে হিরের ব‌্যবসা গুটিয়ে গেল।
কোহিনূর নামে অমূল্য হিরেটি অখণ্ড ভারতের হাতছাড়া হল মহারাজা দলীপ সিংহের হাত ধরে। দলীপ সিংহ একুশ বছরের তরুণী রাণী জিন্দ কৌর আর সাতান্ন বছরের মহারাজা রণজিৎ সিংহের প্রেমের ফসল। ১৮৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ছয় তারিখে জন্ম মহারাজা দলীপের। বাবার মৃত্যুর সময় সে নয়মাসের শিশু। ইংরেজের সঙ্গে লড়াই চলছিল। কোহিনূর হিরে ইংরেজের হাতে গিয়ে পড়লে শিখদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে এই নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন অসুস্থ মহারাজা। তিনি না কি চেয়েছিলেন ওই হিরে পুরীর মন্দিরে প্রভু জগন্নাথের পদতলে সমর্পণ করা হোক। কিন্তু প্রায় বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। স্পষ্ট করে কথা বলার ক্ষমতাটুকুও অবশিষ্ট ছিল না অসুস্থ মহারাজার। মহারাজা রণজিৎ সিংহ মরলেও ইংরেজ বনাম শিখের লড়াই থামল না। আরো দশটা বছর লড়াই চালিয়ে ব্রিটিশ ধূর্ততা আর দেশদ্রোহিতার কাছে হারল শিখ জাতির স্পর্ধা। হিরের সঙ্গে জড়িয়ে র‌ইল অজস্র আত্মীয় বিরোধ, খুনোখুনি আর বিশ্বাসঘাতকতা। লাল সিং আর তেজ সিং দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে ইংরেজের কাছে পুরস্কৃত হল। ইংরেজ ছিনিয়ে নিল শিখ সম্মান, মহারাণী জিন্দ এর বুকের থেকে ছিনিয়ে নিলেন দশ বছরের বালক দলীপকে, আর কোহিনূর হিরে। আর বালক দলীপ ও কোহিনূর, দুটোকেই চালান করে দিল ব্রিটেনে। দলীপ সিংহ সারাজীবন নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন। অবশ‍্য তাতে তাঁর অনেকগুলি বিয়ে ও অজস্র সন্তান উৎপাদন আটকায় নি। স‍্যর উপাধিও পেয়েছিলেন।
বালক দলীপের হাত থেকে পঞ্জাবের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি। ১৮৪৯ এর মার্চ মাসের শেষে পঞ্জাব স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হল। তারপর ১৮৫০ সালের জুলাই মাসের তিন তারিখে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার আড়াইশো বছর উপলক্ষে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের তরফে ডেপুটি চেয়ারম্যান বাকিংহাম প‍্যালেসে ১৮৬ কারাট ভরের কোহিনূর রাণী ভিক্টোরিয়া আলেকজান্দ্রিনার হাতে অর্পণ করলেন। এরপর কোহিনূরকে আরো ঝলমলে করার তাগিদে তাকে নতুন করে কাটাইয়ের উদ‍্যোগ নেওয়া হল। রাণীর বর প্রিন্স অ্যালবার্টের তত্ত্বাবধানে লেভি বেঞ্জামিন ভুরজাঙ্গারের পরিচালনায় কোহিনূরকে ব্রিলিয়ান্ট কাট দিতে গিয়ে কোহিনূর ভর হারাল অনেকটা। হালকা হয়ে কোহিনূর দাঁড়াল ১০৫.৬ কারাটের জিনিস। যে মূল হিরে ছিল ১৬৯টি তলের ওভাল ব্রিলিয়ান্ট কাট পেয়ে তা হল ৬৬ তলবিশিষ্ট হীরক। রাণী সেটি পরলেন হনিসাকল ব্রোচ হিসেবে। কোহিনূর হিরে কাটছাঁট করার পুরোনো গল্প‌ও আছে। হোরটেন্স বোর্সিয়া মূল হিরেকে কাটতে গিয়ে ছোট করে ফেলে ১৮৬ কারাট করে দেওয়ায় মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরাগভাজন হয়েছিলেন বলে গল্প চালু আছে। তবে ও হয়তো গল্প‌ই। কোনো পাথুরে প্রমাণ নেই।
ভারত সরকার অনেকবার অনুনয় বিনয় করে কোহিনূর হিরেটি ফেরত চেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা ব্রিটিশ সরকারকে হিরেচোর বলে অভিহিত করেননি কখনোই। ভারতের অনুনয় বিনয় শুনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একবার বলে ফেলেছিলেন আপনাদের অনুরোধ রক্ষা করতে গেলে তো গোটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামটাই ফাঁকা করে দিতে হয়। সেটা ২০১০ সালের জুলাই মাস, উদারপন্থী রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব ডেভিড ক্যামেরন তখন সবে সবে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন এবং তার পরে পরেই ভারত সফরে এসেছেন।। ২০১৬-র এপ্রিল মাসে ভারত রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফে সলিসিটর জেনারেল তথা সুপ্রিম কোর্টের বরিষ্ঠ আইনজীবী রঞ্জিত কুমার বলেছিলেন ব্রিটিশ সরকার কখনোই শিখদের মহারাজার থেকে কোহিনূর কেড়ে নেন নি, ওটা ঠিক চুরি নয়, ওটা ওঁদের দেওয়া হয়েছিল।
এখন প্লাটিনামের তৈরি একটা মুকুটে ২৮০০ হিরের মধ‍্যে ঝলমল করে হাসে অর্ধেক কোহিনূর।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।