শ্যামলী বলল, বিয়েটা একটা চুক্তি। কোনো অতিলৌকিক সম্পর্ক বললে বাড়তি বলা হয়। ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন বললে হাস্যকর কথা বলা হয়। ১৬৪১ সালেই মিল্টন কঠোরভাবে ইংল্যান্ডের সমাজে চার্চের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।
অনসূয়া জিজ্ঞাসা করলেন, মিল্টন প্যারাডাইস লস্ট লিখেছেন কবে?
শ্যামলী বলল, দিদি, ওটা ওঁর বয়সকালের লেখা, তখন টাকা পয়সা প্রায় শেষ, গরিবের একশেষ, সালটা ১৬৬৭। বয়স ধরুন আটান্ন ঊনষাট হবে। কিন্তু সমাজচেতনা ওঁর একেবারে গোড়ার দিকের অভ্যাস। কবিতা লিখতে পারেন। কিন্তু তখনও নিজেকে তৈরি করে তুলছেন। কলমে শাণ দিচ্ছেন। ১৬৩০ সালে বাইশ বছর বয়সে “অন শেকসপীয়র” নামে কবিতা লিখেছেন। ছোটখাটো একটা পরিচিতিও তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র কিভাবে চলা উচিত, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বিন্যাস ঠিক কি রকম হওয়া উচিত, সেই সব নিয়ে লেখালেখি বেশি করেন।
তো সব বড় মানুষ কেই জীবনের গড়ে ওঠার দিনগুলোতে পরিব্রাজনের ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। পরিব্রাজন না করলে দৃষ্টি খোলে না। বহতা পানি, রমতা যোগী। মিল্টনও বেরিয়ে পড়েছেন ওইভাবে। তখন লেখালেখির মাধ্যমে ইউরোপের গুণী পণ্ডিতদের নজরে এসে গিয়েছেন। মিল্টন ঘোড়ায় চেপে বেড়াতে বেড়াতে ফ্রান্স, তারপর সেখান থেকে ইটালির ফ্লোরেন্স।
অনসূয়া বললেন, ঘোড়ায় চড়ে?
শ্যামলী বলল, ১৬৩৮ সালে তা ছাড়া আর উপায় কি? তখন রেলওয়ে ভবিষ্যতের গর্ভে। মোটর গাড়িও তাই। মানুষ চলে ঘোড়ার পিঠে। তো ইটালির ফ্লোরেন্স শহরের দক্ষিণে আরসেট্রি। সেখানে তিনি বিজ্ঞান সাধক গ্যালিলিও গালিলির সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছেন। গ্যালিলিও তখন চার্চের বিরাগভাজন হয়ে আরসেট্রির কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন।
অনসূয়া বললেন, বলিস্ কি, মিল্টন গ্যালিলিও র সাথে দেখা করেছিলেন?
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ দিদি, কারারুদ্ধ বিজ্ঞানসাধককে দেখতে যাবার ব্যাপারটা মিল্টনের মনের কাঠামোটা চিনিয়ে দেয়। সময়টা হচ্ছে ১৬৩৮ সালের জুলাই মাস। মিল্টন তখন ত্রিশ বছরের যুবক।
অনসূয়া বললেন, আর গ্যালিলিও?
শ্যামলী বলল, গ্যালিলিও তখন চার্চের অত্যাচার সহ্য করে করে শরীরে মনে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছেন। পঁচাত্তর বছর বয়সটাতো কম নয়। তার উপর দূরবীনে চোখ রেখে রেখে দৃষ্টিশক্তি নিঃশেষ হয়ে যেতে বসেছে। সব চাইতে বেশি কষ্ট রাষ্ট্র ও প্রশাসন তাঁকে না বুঝে শাস্তি দিল। গ্যালিলিওর যখন বয়স মোটামুটি বছর ছেচল্লিশ, তখনই তিনি যুগান্তকারী কাণ্ডটা ঘটালেন, আর নিজের বিপর্যয় ডেকে আনলেন।
অনসূয়া বললেন, চার্চ শাস্তি দিয়েছিল।
শ্যামলী বলল, তখন চার্চের হাতেই রাষ্ট্রক্ষমতা। আর সবদেশের খ্রীস্টান সমাজের সর্বময় প্রতিভূ পোপ। ভ্যাটিক্যান সিটি পোপের শাসনের কেন্দ্র। অনেক আগে থেকেই একদল বিজ্ঞানী মনে করতেন যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কিন্তু অ্যারিস্টটলের মত ছিল যে পৃথিবী তাবৎ বিশ্বসংসারের কেন্দ্রের । তাঁহারে আরতি করে চন্দ্র তপন। অ্যারিস্টটলের এই মতটা বাইবেলের মতের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। আর লোকেরা দেখতে পায় পূর্ব দিকে সূর্য ওঠে, পশ্চিমাকাশে অস্ত যায়। চাঁদও পুবদিকে ওঠে। ফলে পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে সূর্য আর চাঁদ সহ সব দূরের দূরের জ্যোতিষ্ক প্রদক্ষিণ করে থাকে, এই ছিল চালু ও প্রতিষ্ঠিত ধারণা। চার্চের এই যে বক্তব্য, এ যে ঠিক নয়, ভাল করে গণিতচর্চা করলেই এটা বেশ বোঝা যায়। অন্তত পাইথাগোরাসের ছাত্ররা সেটা জানতেন। তাঁর একজন ছাত্র ফিলোলাউস ৩৯০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দেই এই বিষয়ে বলেছেন। খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সামোস এর অ্যারিস্টার্কাস একথা বলেছেন। ওঁর চেয়ে বছর চৌত্রিশ পরে জন্মেছিলেন এরাটোস্থানেস। তিনি এমনকি আরো বিশদ করে সেসব বললেন, পৃথিবী যে গোল সেটাও বললেন, তার পরিধি পর্যন্ত গণিতের সূত্র কাজে লাগিয়ে বলে দিলেন। ভারতে আর্যভট এটুকু অন্ততঃ বলেছিলেন যে পৃথিবী নিজেকে পাক খাচ্ছে।
গোলমাল পাকিয়ে দিয়েছেন অল বেরুণি। তিনি প্রতিভাধর ব্যক্তি। গণিতে মজবুত। কিন্তু সামাজিক সুবিধা কোন্ দিকে, সেটাকে গুরুত্ব দিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক বলে তিনি ধর্মধ্বজীদের দিকেই রায় দিয়ে পৃথিবীর চারপাশে সকলকে ঘুরিয়ে দিলেন। টাইকো ব্রাহেও তাই। প্রতিভাধর বিজ্ঞানীরা যদি সাহসভরে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতে চান, তাহলে যে কত বড় বিপর্যয় হতে পারে, তার নিদর্শন হলেন টাইকো ব্রাহে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কিন্তু ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর কথা অনুভব করেছিলেন। বলেছিলেন, ইল সোলে নন সাই মুভ।
অনসূয়া বললেন, এর মানে কি?
শ্যামলী বলল, পৃথিবী চলছে। স্থির নয়। ভাল করে গুছিয়ে কথাটা বলার চেষ্টা করেছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস। ১৪৭৩ সালে জন্মেছিলেন। ১৫৪৩ এ সত্তর বছর বয়সে মৃত্যু। ওই ১৫৪৩ এই বেরোল তাঁর বই ডি রিভলিউশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেসটিয়াম। এই বইতে গাণিতিক ব্যাখ্যা সহ কেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, তা যত্ন করে বলেছেন।
অনসূয়া বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। জিওর্দানো ব্রুণোর কথাও জানি।
শ্যামলী বলল, চার্চ ব্রুণোকে বৈজ্ঞানিক সত্য সপাটে বলায় সাংঘাতিক শাস্তি দিয়েছিল।
অনসূয়া বললেন, হ্যাঁ জানি, পুড়িয়ে মেরেছিল।
শ্যামলী বলল, তার আগে জিভটা কেটে নিয়েছিল, যাতে পুড়তে পুড়তেও ব্রুণো বিজ্ঞান বিষয়ে কিচ্ছু না বলে যেতে পারেন। বিজ্ঞানকে ধর্মধ্বজীরা এতটাই ভয় পায়।
অনসূয়া বললেন, তুই গ্যালিলিওর কথা বলতে বলতে কোথায় না কোথায় চলে গেলি!
শ্যামলী বলল, গ্যালিলিওর আগের যুগে বিজ্ঞানীরা খালি চোখে দেখে বুঝে অঙ্ক কষে কিছু বলতেন।
হান্স লিপারসে বলে নেদারল্যান্ডসের একজন দক্ষ চশমাশিল্পী কাচের লেন্স লাগিয়ে দূরবীন বানিয়েছিলেন। তাতে দূরের জিনিসকে কাছে দেখা যেত। পয়সাওলা লোকজন খুব পছন্দ করল জিনিসটা। গ্যালিলিও ওই জিনিসটার কথা স্রেফ কানে শুনেই, ওর বিষয়টা গাণিতিক ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে শুরু করলেন। ফোকাস দূরত্বের ব্যাপারটা হিসাব করে তিনি খেলনা দূরবীনকে বৈজ্ঞানিক কাজের জিনিসে দাঁড় করালেন। আর তারপরই খেল শুরু ।
অনসূয়া হেসে বললেন, কি খেল দেখালেন গ্যালিলিও?
শ্যামলী বলল, গ্যালিলিও সব সময় চোখে দূরবীন সেঁটে আকাশ দেখতে থাকেন। মনে রাখতে হবে তখন চার্চ চোখ রাঙিয়ে বলে রেখেছে, পৃথিবী স্থির। সমস্ত কিছু তাকে ঘিরে ঘুরছে। ছেচল্লিশ বছর বয়স পুরো হবার আগেই ১৬১০ সালের জানুয়ারির সাত তারিখে গ্যালিলিও দেখলেন বৃহস্পতি গ্রহের কাছে তিনটি কি জিনিস চকচক করে। প্রথম দেখায় তিনি ভেবেছিলেন তারা দেখছেন বুঝি। তিনদিন পরে দশ তারিখে দেখলেন তার একটা কোথায় চলে গিয়েছে। তার তিন দিন পরে তেরো তারিখে দেখলেন আরেকটি হাজির হয়েছে। এগুলো বৃহস্পতির উপগ্রহ। তেরো তারিখে যেটি দেখেছিলেন, সেটিই সবচেয়ে বড়। ওর নাম পরে দেওয়া হয়েছে গ্যানিমিড। আর প্রথম যে তিনটি দেখেছেন, ওগুলো হল, আইও, ইওরোপা, আর ক্যালিস্টো। দেখা গেল বৃহস্পতি গ্রহকে ঘিরে ওরা ঘুরছে। গ্যালিলিও নিজে দেখে ক্ষান্ত দিলেন না। সবাইকে ডেকে ডেকে দেখান। বলেন, পৃথিবীকে ঘিরে যদি সবাই ঘুরবে, তাহলে বৃহস্পতিকে ঘিরে এ চারটে ঘোরার কারণ কি? দূরবীন দিয়ে লোকজন নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছে। গণিতের প্যাঁচঘোঁচ কিছুই বুঝতে হচ্ছে না। সহজেই দেখা যাচ্ছে ওরা বৃহস্পতিকে ঘিরে ঘুরছে। ব্যাস্, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তাবৎ বিশ্বসংসারের সবকিছু ঘোরে, আর পৃথিবী সবকিছুর মাঝখানে স্থির, এই বাইবেলীয় ধারণায় জোর ধাক্কা লাগল।
চার্চের গা জ্বলা শুরু করল। পোপের নির্দেশে ধর্মধ্বজীরা একজোট বাঁধলেন। শুরু হল বিচার। ইনকুইজিশনের পর্ব। তো সারাজীবন আর ঠিকঠাক ছাড়া পেলেন না গ্যালিলিও। ইটালির ফ্লোরেন্সের শহরতলি আরসেট্রিতে তিনি ছিলেন ১৬৩১ থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। ১৬৪২ এর আট জানুয়ারিতে মারা যান তিনি। তো এই সময়ের মধ্যে বন্দীদশায় থাকা পঁচাত্তর বছরের প্রায় অন্ধ বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করে এলেন কবি জন মিল্টন। সময়টা ১৬৩৮ এর জুলাই। গ্যালিলিওর উচ্চতার প্রতি মিল্টনের সুগভীর শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম না থাকলে তো তাঁর কাছে যাবার প্রশ্ন উঠত না। চার্চ কিভাবে সত্যসাধককে সাজা দেয়, হেনস্থা করে, সব তিনি স্বচক্ষে দেখে জানলেন। চার্চ যে আসলে একটা বিকৃত ক্ষমতা ভোগ করছে, সেটা বুঝে গেলেন মিল্টন।
১৬৪১এ চার্চকে আত্মসংবরণ, আত্মশাসনের কথা বলে লেখালেখি করলেন। ১৬৪২ এ প্রথম বিয়ে। ওই মারি পাওয়েল। তখন পঁয়ত্রিশ বছরের গড়িয়ে যাওয়া যৌবনে ষোলো বছরের কিশোরী পাওয়েলকে বিয়ে করে ফেলে ভুলই করেছিলেন তিনি। মানসিক গঠনের মিল ছিল না। অতটুকু মেয়ে ওই সময়ের ভারিক্কি বুদ্ধিজীবী তার্কিক সমাজ সংস্কারকের গভীরতা বুঝতে পারবে কেন? মাস কয়েক যেতে না যেতেই সে পালালো বাপের বাড়ি। অমন গ্রাম্ভারি মিল্টনকে তার পছন্দই হয় নি। ফিরে সে আর কিছুতেই এল না।
বৌকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়ে গভীর অসম্মান বোধে, গ্লানিতে, ব্যথায়, যন্ত্রণায় ডিভোর্সের সপক্ষে একটা ব্যক্তিগত আর্তনাদের মত গদ্য লিখেছেন মিল্টন। যন্ত্রণার তাপ আর গ্লানি তাতে ছিল। কিন্তু মহাকবিসুলভ গভীরতা, মন্ময়তা বা ধ্রুপদী কোনো ভাবনার উৎসার সেখানে ছিল না।
কিন্তু চার্চ সেই নিতান্ত মাঝারি মানের লেখাকেও ব্যান করল। মিল্টন কি না ডিভোর্স চায়! এইসব কুলাঙ্গারের জন্যই যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেশ হারছে। পাপে ভরে উঠলে যুদ্ধে হার তো হবেই। যুদ্ধে হারার আতঙ্ককে পুঁজি করে ইংল্যান্ডের চার্চ কণ্ঠরোধ শুরু করল। আনল ১৬৪৩ এর অর্ডিন্যান্স।
তখন তার প্রতিবাদে মিল্টনের ভিতর মহাকবি জেগে উঠলেন। ক্লাসিক ওজস্বী ভাষায় লিখেছেন অ্যারিওপ্যাগিটিকা। সালটা ১৬৪৪
ভোরের আলো এসে পড়েছে শ্যামলীর মুখে। শ্যামলী বলে চলেছে চিরকালের মানবমুক্তির বাণী।