ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ এর কথা বড়ো যত্নে, বড়ো আন্তরিকতায় স্মরণ করি। নেদারল্যান্ডস এর মানুষ তিনি। ভ্যান গঘ সে শহরে কিছুদিন বসবাস করেছেন বলেই আমস্টারডাম শহর যেন ধন্য হয়ে গিয়েছে। ভ্যান গঘের নামে গোটা একটা মিউজিয়াম পর্যন্ত স্থাপনা করেছে শহরবাসী। আর সেখানে রেখেছে “দি পট্যাটো ইটার্স” আর “সানফ্লাওয়ার” এর অরিজিনাল ছবি। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০, এই মাত্রই বছর দশেক সময়ে আঁকতে পেরেছেন গঘ। ১৮৯০তে জুলাই মাসের ঊনত্রিশ তারিখে সাঁইত্রিশ বয়সের ভ্যান গঘের জীবনাবসান । ছবি নিয়ে যারা কারবার করে, তাদের কাছে কাজ করতেন তরুণ ভ্যান গঘ। ছবি দেখে বুঝে কেনাকাটা করা, আর পয়সাওলা রসিক সমঝদার পেলে তাকে গছিয়ে দেওয়া ছবি ব্যবসায়ীদের কাজ। তাদের কাছে কাজ করতে করতে ভ্যান গঘের মনে হল, ছবি আঁকাই তাঁর জীবনের পরমা গতি।

ছবি আঁকতে চাইলেন নিজের মনে। কিন্তু কিছু তুলি টানাটানির পর গঘের মনে হল, ছবি আঁকার কায়দা কানুন নিয়ে একটু তালিম, একটু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া দরকার। তবে যিনি আত্মার ভিতরে বিশ্বসেরা শিল্পীকে জাগিয়ে তুলছেন, তিনি স্কুলিংয়ের ধরাবাঁধা নিয়ম কানুন মানবেন কেন? প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গঘের গণ্ডগোল বেধে যেত। আবার নিজের মনের মতো করে আঁকতে ব্যস্ত হলেন। দশবছরের শিল্পিজীবনে একুশ শো শিল্পসৃষ্টি করেছেন গঘ। তার মধ্যে সাড়ে আটশোর বেশি অয়েল পেন্টিং।
ছবি আঁকাকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে চিনে নেবার আগে লণ্ডনের এক তরুণীকে ভালবেসেছিলেন গঘ। তখন মাত্র একুশ বছরের তাজা তরুণ। মেয়েটি গঘকে পাত্তা দেয় নি। বড়ো মর্মাহত হয়েছিলেন গঘ। নিজেকে ভীষণভাবে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ক্রমে শুশ্রূষা খুঁজে নিয়েছেন প্রকৃতির নির্জন কোলে। এরপর প্রকৃতিই যেন গঘের প্রিয়তমা হয়ে ওঠেন। গঘ বলেন, তুমি যদি প্রকৃতিকে সত্যি সত্যিই ভালবাসতে পারো, তো তুমি যেখানে তাকাবে, সেখানেই অপরূপ সৌন্দর্য খুঁজে পাবে।
নেদারল্যান্ডস এর আমস্টারডাম শহরে উনি গিয়েছিলেন ছবি আঁকতে। ওই দেশের খুব নামকরা চিত্রশিল্পী ছিলেন রেমব্রাণ্ট। কিন্তু সর্বকালের সেরা বুঝি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। ওই গঘের একটা ছবি তারা ভরা রাতে ছাতে এলে আমার মনে উঁকি দেয়। স্টারি নাইট। রাতের তারা খচিত আকাশ। মারা যাবার আগে একটা চিরস্মরণীয় আঁকা। গঘ তো মারা গেলেন ১৮৯০ তে। জুলাই মাসে। আর স্টারি নাইট আঁকলেন ১৮৮৯ এর জুন মাসে।
আমরা জানি পৃথিবীর একটা উপগ্রহ। কিন্তু আমাদের দেশের সেযুগের লোকজন চাঁদকে খুব গুরুত্ব দিত। ওই যে আকাশে অত বড় করে দেখা যায়। সাতাশ দিনের একটু বেশি সময়ে চাঁদ আকাশে নিজের পুরো গোল চেহারাটা মেলে ধরে। তো সাতাশ দিনে সাতাশটি নক্ষত্রের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে চাঁদ। অথচ নক্ষত্র কত বড়, আর কতদূরে।
আমাদের শাস্ত্রে বলে যোগীরা রাতে ঘুমান না। মহাভারতের অর্জুনও নাকি রাতে ঘুমাতেন না তাই ওঁর একটা নাম ছিল গুড়াকেশ। রাতের অপেক্ষা করে থাকেন সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। রাতের আঁধারে তারায় তারায় কি লেখা আছে তাঁরা পড়েন। তারপর রাত একসময় শেষ হতে যায়। তখনও সূর্য ওঠার অনেক দেরি। এমনকি তার লাল আভাটুকুও ফোটে নি, তখন একরকম আলো, ভারি আবছা একরকম আলো দেখা যায়। ওকে জোডিয়াক্যাল লাইট বলে। সূর্য আর গ্রহগুলির মাঝে যে মহাশূন্য, সেখানে অনেক গুঁড়ো গুঁড়ো অতি সূক্ষ্ম ধুলো থাকে। সৌর আলো তাতেই ঠিকরে উঠে ওই হালকা আলো আকাশে আঁকে। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ অ্যাসাইলামে থেকে অমন একটা প্রত্যূষের ছবি আঁকলেন। কিন্তু গঘের এই আঁকাটায় চাঁদের আকার নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটা গানে এ রকম লিখেছেন,
যখন এসেছিলে অন্ধকারে
চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে–
গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥
তুমি গেলে যখন একলা চলে
চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।
তখন দেখি, পথের কাছে
মালা তোমার পড়ে আছে–
বুঝেছিলেম অনুমানে
এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥
ভ্যান গঘ ভাল বেসেছিলেন একটা মেয়েকে। লণ্ডনের একটা মেয়ে। সে মেয়ে গঘকে পছন্দ করে নি। গঘের তখন মোটে একুশ বছর বয়স। ওই মেয়েটা পছন্দ করল না বলে খুব আঘাত পেয়েছিলেন গঘ। নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বেশি দিন তো বাঁচেন নি। সাঁইত্রিশ বছরের জীবন গঘের। মনোকষ্ট জটিল হয়ে উঠেছে টের পেয়ে নিজে নিজেই অ্যাসাইলামে ভর্তি হলেন। ওখানেই যে ঘরে থাকতেন তার পুবের জানালার দিকে চেয়ে চেয়ে শেষ রাতের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। ওই হল স্টারি নাইট।
রাতের আকাশ মানুষকে নিজের ভিতরে তাকাতে শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন,
রজনীর শেষ তারা, গোপনে
আঁধারে আধো ঘুমে
বাণী তব রেখে যাও
প্রভাতের প্রথম কুসুমে..
ভ্যান গঘের কথা ভাবলে ওই শেষ তারার কথাটা খুব মনে হয়। কতটা একলা হলে একটা মানুষ এ রকম করে ভাবতে পারে। ভ্যান গঘও যেন ওইভাবে ভাবলেন। অতোটা একাকিত্ব বুকে বইলেন।
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, বিশ্বসেরা ডাচ শিল্পী বলেছিলেন, ‘আই ফীল দ্যাট দেয়ার ইজ নাথিং মোর ট্রুলি আর্টিস্টিক দ্যান টু লাভ পিপল।’
এমিল জোলা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক। তাঁর সব সেরা সৃষ্টি জার্মিনাল (১৮৮৫) লেখা হয়েছিল কয়লাখনি এলাকার বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। কয়লাখনিটাই যেন এক সর্বগ্রাসী দৈত্য। এই রকম একটা আবহ তৈরি করে বুর্জোয়া আর শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে তিনি তুলে ধরলেন। কয়লাখনি এলাকার শ্রমিকদের ধর্মঘট নিয়ে তিনি লিখেছেন। গুণীজনের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল জার্মিনাল। বিশ্ববন্দিত চিত্রকর ভ্যান গঘ এই জার্মিনাল পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন। জার্মিনালের প্রভাবে গঘের তুলিতে জন্ম নিয়েছিল দুটি অসামান্য চিত্রকর্ম, উইভার্স আর দি পটেটো ইটার্স। মানুষের প্রতি ভালবাসার ছোঁয়া মেশা সে ছবি।