ক্যাফে কলামে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

আজ ভারতের সংবিধান দিবস

ভারতের সংবিধান আজ থেকে বাহাত্তর বৎসর আগে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে চালু হয়েছিল। আজ এদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই দেশ সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, সেক‍্যুলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। আমাদের রাষ্ট্র সুবিচার, সাম‍্য ও মুক্তিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। ১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে সেক‍্যুলার এবং সমাজতান্ত্রিক শব্দদুটি সংবিধানে গৃহীত হয়।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রশাসনিক, আইনকক্ষ ও বিচারবিভাগীয়, এই তিনটি শাখায় বিন‍্যস্ত।
আজকের তারিখে আমাদের ভারতীয় সংবিধানে পঁচিশটি পার্টে ৪৭০ টি আর্টিকেল রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে বারোটি শিডিউল এবং পাঁচটি অ্যাপেনডিক্স। এ পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানটি ১০৫ বার সংশোধিত হয়েছে। গত ১০ আগস্ট ২০২১ তারিখে সাম্প্রতিকতম সংশোধনটি হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় পার্টে মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ পার্টে রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাবলী। নির্বাচনী কৃত‍্য নিয়ে পঞ্চদশ পার্টে আলোচনা আছে। ভাষা নিয়ে বক্তব্য রয়েছে সপ্তদশ পার্টে। আর জরুরি অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে অষ্টাদশ পার্টে।
কেন্দ্র ও রাজ‍্যের দায়িত্ব ও ক্ষমতার বিন‍্যাস আমাদের দেশের সংবিধানের একাদশ পার্টে বলা আছে।
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় রাষ্ট্র ফেডারেল প্রকৃতির, অর্থাৎ রাজ‍্যে রাজ‍্যে পৃথক পৃথক সরকার ও প্রশাসন আছে, কিন্তু মূল বৈশিষ্ট্যে এই রাষ্ট্র ইউনিটারি। অর্থাৎ কেন্দ্র সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। তাই ভারতীয় রাষ্ট্রের চেহারা পুরোপুরি ফেডারেল নয়, একে বলতে হবে কোয়াসি ফেডারেল। বিচার বিভাগ আমাদের রাষ্ট্র ব‍্যবস্থায় ওয়াচডগ হিসাবে কাজ করে।
কেন্দ্র এবং রাজ‍্যে সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও পঞ্চায়েত ও নগরপালিকার উপর কিছু ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৭৩ এবং ৭৪ তম সংশোধনের মাধ্যমে এটা হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের ব‍্যবস্থা অনুযায়ী প্রশাসনিক শাখার প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। আর্টিকেল ৫২ এবং ৫৩ তে এই কথা বলা আছে। আর প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রিসভার নেতা। আর্টিকেল ৭৪ এই কথা বলছে। প্রধানমন্ত্রী র নেতৃত্বে পরিচালিত ক‍্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আমাদের দেশের পার্লামেন্ট কিন্তু সংবিধানের ব‍্যবস্থা মেনে চলতে বাধ‍্য।

ভারত কিভাবে স্বাধীনতা পাবে, ও রাষ্ট্রব‍্যবস্থা কিভাবে পরিচালিত হবে সেই লক্ষ্যে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি তৈরি করা হয়েছিল।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পূর্বমুহূর্তে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বৈঠক বসেছিল। তার অন্ত‍্যপর্বে বৈঠক সমাপনী অনুষ্ঠানে সদস্যরা সম্মিলিত কণ্ঠে জনগণমনঅধিনায়ক গেয়েছিলেন।
পরে ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি তারিখে স্বাধীন ভারত এই গানটি জাতীয় গাথা হিসেবে গ্রহণ করে।
১৯২৮ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে একটি সর্বদলীয় কনফারেন্সে একটি কমিটি গঠিত হয়। তাঁরা ভারতের সংবিধান কি রকম হবে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছিলেন। লিপিবদ্ধ সেই ভাবনা নেহরু রিপোর্ট হিসাবে পরিচিত। এই বিষয়ে যে কমিটি হয়েছিল তার চেয়ারম্যান ছিলেন মোতিলাল নেহরু। আর সেক্রেটারি ছিলেন জ‌ওহরলাল নেহরু। সব মিলিয়ে মোট নয়জন সদস‍্যের কমিটির অন‍্যান‍্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তেজবাহাদুর সপ্রু এবং সুভাষচন্দ্র বসু। তবে নেহরু রিপোর্টের আগেও সংবিধান নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছিলেন মিসেস অ্যানি বেশান্ত।
ভারতের স্বাধীনতা গড়ে তোলা আর তাকে সাংবিধানিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করতে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বিপুল ভূমিকা পালন করেছেন।
এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির ধারণাটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এনেছিলেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়। পরে তিনি র‍্যাডিক‍্যাল হিউম‍্যানিজমের কথা বলতেন। সেটা ১৯৩৪ সাল। রায়ের চিন্তা কংগ্রেস নেতাদের প্রভাবিত করে। কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীদের মধ‍্যেও কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি ওঠে। ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে জ‌ওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি স্বীকৃত হয়। এই দাবির সূত্রে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের ১৯৩৫ সালের গভর্ণমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বর তারিখে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি ব্রিটিশ সরকারের সামনে উচ্চারণ করেন। তিনি প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গড়ে তোলার কথা বলেন। শেষমেশ ১৯৪০ সালের আগস্টে ব্রিটিশ সরকার এই দাবি মেনে নেন।
প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলিগুলি ভোটের মাধ্যমে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গড়ে তোলে। মোট ৩৮৯ জন সদস্য নিয়ে এই সভা গড়ে তোলার কথা হয়। এর মধ্যে প্রদেশগুলি থেকে ২৯২ জন, প্রিন্সলি স্টেটগুলি থেকে ৯৩ জন, চিফ কমিশনারের স্টেটগুলি থেকে আরো চার জন, এই হিসাব হয়। অ্যাসেম্বলি জন্ম নেয় ১৯৪৬ সালের ০৬ ডিসেম্বর তারিখে। কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে। আজকের ভারতীয় পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হল-এ। সেদিন তাকে বলা হয়েছিল কনস্টিটিউশন হল। উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ২০৮ জন ও মুসলিম লীগের তরফে ৭৩ জন। প্রথম দুইদিন অস্থায়ী ভাবে সভাপতিত্ব করেছেন সচ্চিদানন্দ সিংহ। আর সভায় প্রথম বক্তব্য রাখেন জে বি কৃপালনী। এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের রাজেন্দ্র প্রসাদ। তিনি ছিলেন আইনবিশারদ পণ্ডিত, সাংবাদিক ও অর্থনীতির অধ্যাপক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন দুইজন, হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় এবং ভেঙ্গল থিরুভেঙ্কটাচারি কৃষ্ণমাচারি। মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষাবিদ ও খ্রিস্টান নেতা, এবং কৃষ্ণমাচারি ছিলেন আইসিএস ও গুণী প্রশাসক। কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সাংবিধানিক উপদেষ্টা ছিলেন বি এন রাউ। সংবিধান রচনা করা এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সংবিধানের খসড়া তৈরি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর। আর সুরেন্দ্রনাথ মুখার্জি ছিলেন প্রধান খসড়াকার। ২৯৯ জন সদস্য দুই বছর এগারো মাস আঠারো দিন ধরে পরিশ্রম করে ভারতের সংবিধান তৈরি করেছেন। এই কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ১৯৪৯ এর ২৬ নভেম্বরে অ্যাসেম্বলি এই খসড়া সংবিধানকে অনুমোদন দিয়েছিল। তারপরে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত রাষ্ট্র একে গ্রহণ করেন। সংবিধান গৃহীত হলে ১৯৩৫ সালের গভর্ণমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট এবং ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইন বাতিল হয়ে, ডোমিনিয়ন পরিচয় ঝরিয়ে ফেলে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ও সার্বভৌম ভারতের জন্ম হয়। সংবিধান দিবস তার‌ই নান্দীপাঠ।
ভারতের সংবিধানের প্রধান রূপকার বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর। তিনি ছিলেন একজন আইন বিশারদ। প্রায় ষাটটি দেশের সংবিধানের অন্ধিসন্ধি নিয়ে গবেষণা করে তিনি ভারতের মত বিপুল দেশের জন্য উপযোগী সংবিধান গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন উন্নত দেশের সংবিধান থেকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য চয়ন করে তিলোত্তমা করে গড়ে তোলা হয়েছে ভারতীয় সংবিধানকে। ভারতের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান। এই ধারণা এসেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে। প্রস্তাবনা, আইনের সুরক্ষার সার্বজনীনতা, আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে ভারতের সংবিধানে আমেরিকার সংবিধানের প্রভাব পাওয়া যায়। ব্রিটেনের সংবিধান লিখিত নয়। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় ব‍্যবস্থার অনুসরণে ক‍্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভার ব‍্যবস্থা, আইনের শাসন, পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বা লোকসভার অধিক ক্ষমতা এই বৈশিষ্ট্যগুলি ভারতীয় সংবিধান গ্রহণ করেছে। আর ভারতের রাষ্ট্রপতি যে একজন সাংবিধানিক প্রধান, আলঙ্কারিক কর্তৃপক্ষ, সে ধারণাও ব্রিটিশ রীতিনীতি অনুসরণে গড়ে উঠেছে। আয়ারল্যান্ডের সংবিধান থেকে এসেছে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশিকার ধারণা, আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে সে দেশের প্রভাব দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার সংবিধান থেকে এসেছে কনকারেন্ট লিস্ট বা যৌথ তালিকার ধারণা এবং পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনের বিষয়টি। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সাম‍্য মৈত্রী স্বাধীনতার ধারণাতে ফরাসি প্রভাব লক্ষ‍্যণীয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে এসেছে নাগরিকদের মৌলিক দায়িত্বের প্রসঙ্গ। ভারতীয় সংবিধানে কানাডার সংবিধানের প্রভাব‌ও যথেষ্ট। কেন্দ্র ও রাজ‍্যের মধ‍্যে ক্ষমতার বিন‍্যাস, কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকতর ক্ষমতা, রাজ‍্যে রাজ‍্যে কেন্দ্রের তরফে গভর্নর নিয়োগ এবং কেন্দ্র সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের তরফে পরামর্শ দানের ক্ষমতা, এই ধরনের বিষয়গুলিতে কানাডার সংবিধানের প্রভাব রয়েছে।
তবে ভারতীয় সংবিধানের প্রাণসত্তাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে সকল ভারতীয়ের সচেতন প্রজ্ঞা এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন বিশেষ প্রয়োজন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।