• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩)

আমার কথা 

৪৯
আমাদের বাড়িতে বাবার কোনো কোনো বন্ধু আসতেন। আমাদের বরানগরের বাড়িতে সেসব দিনে সদর মহল, অন্দর মহল ছিল। বন্ধু বান্ধবেরা সদর মহলে বসতেন। একবার বাবার কোনো বন্ধু এলে আমার অল্প বয়সী মা’টির খুব ইচ্ছে হয়েছিল আগন্তুকটি কে এবং কেমন তা নিজে চোখে জানবেন । আসলে তাঁর পিতৃগৃহে সদা সর্বদাই হাসি খুশি পরিবেশে নিত্য নতুন লোক আসতো আর অবরোধ প্রথা না থাকায় বাড়ির মেয়েরা নিঃসংকোচে দাদাদের বন্ধুদের সাথে গল্প ও আড্ডা মারতে পারতো। অথচ আমাদের বাড়িতে সেই খোলা হাওয়াটা ছিল না। সদর ঘরের পাশে ছিল ভাঁড়ার ঘর। সেখান থেকে সদরে উঁকি মারার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন অল্পবয়সিনী বধূটি ।
তার পর হাতে নাতে ধরা পড়া এড়াতে একটা ভাঙা লোহার বাসন খুঁজতে এসেছেন বলে স্তোক দিয়েছিলেন শ্বশুরমশায়কে।
আমি একটু বড়ো হতে আমাদের পত্রিকাসূত্রে অজস্র বন্ধুবান্ধব আসতেন আমাদের বাড়িতে। গানে বাজনায় আবৃত্তিতে গম গম করতো বাড়ি। আমাদের বোনেরা দাদাদের বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারতে পেত । চিঠি পত্রও লিখতো নির্দ্বিধায় ।

৫০
বিদ্যাসাগর ততোটা বিদ্যাবান ছিলেন না, যতোটা হৃদয়বান ছিলেন। তিনি যেটা বুঝতেন, নিজের হাড় মাস, সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে বুঝতেন। ওই জন্যে নিজের প্রতিজ্ঞার জন্য প্রাণপাত করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। তার সমযোগ্য পণ্ডিত এ দেশে যে খুব অল্প জন্মেছেন, তা কিন্তু নয়। বিদ্যাসাগর প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠলেন নিজের সিংহহৃদয়ের জোরে। কোনো একটা কাজ মনে ধরলে তার শেষ দেখে ছাড়বার হিম্মৎ রাখতেন তিনি।
১৮৩৯ সালে , মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে, তিনি বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত হন। সেই দিনটিতে সেটা একটা উপাধি মাত্র ছিল। দেশের মানুষের প্রতি যথা কর্তব্য করে তিনি পরবর্তী জীবনে এই প্রাপ্ত উপাধিকে যথার্থ প্রমাণ করেন।
মনে রাখি যে, মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে ওঁর উপাধিটি পাওয়া। ঊনিশ মানে কৈশোর পুরো পার করেন নি তখনো। পরে যখন বিধবা বিবাহ নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলছেন, তখন গ্রন্থকীট পণ্ডিতদের বাগ মানাতে “পরাশর সংহিতা” থেকে এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করে দেখালেন –
“নষ্টে মৃতে প্রবজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্য বিধীয়তে।”
কিন্তু পণ্ডিতরা কি এতই বোকা যে বীরসিংহ গ্রামের লোকটা বইয়ের পাতা খুলে দেখাবেন, আর বুঝে যাবেন? দেশাচার বলে একটা ব্যাপার আছে না?
পণ্ডিতরা পুঁথি পড়েছেন রুটি রুজির দায়ে। শিক্ষার আলোয় স্নাত শুদ্ধ মালিন্যমুক্ত হতে নয়।
পণ্ডিতদের পুঁথি দেখিয়েও সামাজিক সমর্থন সে ভাবে না পাওয়ায়, তিনি যুক্তি আর হৃদয়বত্তার কাছেও আবেদন করেন। তিনি বলেন বিধবা হওয়া মাত্র নারীরা দেবী হয়ে যান না, তাঁরা রক্ত মাংসের মানুষই থাকেন। অর্থাৎ ঈশ্বর বলতে চাইছেন, স্বাভাবিক মানবিক যৌন আগ্রহ তাঁদের থেকে যায়। এই যে জৈবিক চাহিদাকে গণনার মধ্যে আনা, এটা যুক্তির কাছে তাঁর আবেদন।
মনে রাখা দরকার যে ইংরেজ শাসক নিজের দেশে যথেষ্ট প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করলেও, ভারতে ইংরেজ প্রশাসনের ভূমিকা ছিল রক্ষণশীলতার সমর্থন করা। যে সকল পদক্ষেপ মানবচিত্তের উন্মেষ ঘটায়, সেই গুণগুলি যাতে ভারতীয়দের মধ্যে কোনোমতে বিকশিত হতে না পারে, সে ব্যাপারে ইংরেজ প্রশাসন শ্রেণীগত ভাবে সতর্ক ছিলেন।
সেই কারণে প্রগতির বিপক্ষের শক্তিকে নানা ভাবে রসদ যুগিয়ে গিয়েছিল ইংরেজ। সতীদাহ, বহুবিবাহ, বাল্য বিবাহ এগুলির বিরুদ্ধে জনমত গড়তে গিয়ে রামমোহন বিদ্যাসাগর কে প্রাণের ঝুঁকিও নিতে হয়েছিল।
প্রশাসনের কাছে তাঁরা “রত্ন” বলে বিবেচিত হন নি। তাঁরা সে ব্যাপারে লালায়িতও ছিলেন না।

৫১
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত। বাঙ্গালীর এ পর্যন্ত জ্ঞাত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পুঁথি চর্যাপদ তিনি আবিষ্কার করে প্রকাশ করেন। নাম ছিল হাজার বছরের বৌদ্ধ গান ও দোহা। এই মহান পণ্ডিত ব্যক্তিকে এক সভায় মানপত্র দেওয়া হয়। মানপত্রে তার নামের আগে গৌরবসূচক ভাবে লেখা ছিল বিদ্যাসাগর। তাতে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বিরক্ত হন। অন্ততঃ পঞ্চাশবার লাল কালিতে নিজের নামের আগে বসানো বিদ্যাসাগর শব্দটা কেটে তিনি বিড়বিড় করে বলে চলেছিলেন – বিদ্যাসাগর একজনই । যথার্থ পণ্ডিতের উপলব্ধি ।

৫২
মাসিমণির সাথে কথা বলার এই এক মুশকিল যে কথা আর ফুরোয় না। দুজনেই বাক্য বীর।
তেজস্বিনী বললেন – আমি কিন্তু তোমার সাথে মোটেও একমত নয়। ওই যে তুমি লিখেছ বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটাকে উড়িয়ে দেবার কথা, ওই যে লিখেছ না, লেনিন আর তার সঙ্গিনীর কথা, সারত্র আর তার সঙ্গিনী বুভুয়ার কথা, ওটা কিন্তু মুশকিলের। এক ধাক্কায় কি হয়?
বলতে হল “হয়। রামমোহনকে করতে হয়েছিল। ওঁর বৌদি অলকমঞ্জরীকে জোর করে লোকেরা সতীদাহ করলে রামমোহন প্রতিজ্ঞা করলেন সতীদাহ বন্ধ করিয়ে ছাড়ব। বিদ্যাসাগর মশায় ছাত্রাবস্থায় কলকাতার গৃহস্বামিনী বালবিধবা রাসমণি দেবীকে তাঁর মাতৃসমা মনে করতেন। বালবিধবাদের দুঃখ ঘোচাতে তিনি জীবনপণ করেছিলেন। দুজনকেই প্রাণনাশের হুমকি পেতে হয়েছিল। সমাজ বিকাশের পথটা কোনোদিন সরল সাদাসিধে কুসুমাস্তীর্ণ নয়।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।