ক্যাফে ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৪)

১৩। ইলেকট্রনের ভগীরথ জীম্যান
ইলেকট্রনের কথা শুরু করতে গেলে নোবেলজয়ী ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী পিটার জীম্যান (২৫ মে ১৮৬৫ – ৯ অক্টোবর ১৯৪৩) এর কথা বলতে হয়।
১৯০২ সালে তিনি হেনড্রিক লোরেঞ্জ নামে তাঁর এক অধ্যাপকের সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নোবেল সম্মান লাভ করেন। নানাবিধ বিষয়ে জীম্যান গবেষণা করে থাকলেও তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে আলোক রশ্মির বর্ণালীর বহুধাবিভক্ত হবার ঘটনাসূত্রে। একেই বলে জীম্যান এফেক্ট।
আলো আর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে আলোর নানাবিধ বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করতে পিটার জীম্যান স্কুলজীবন থেকেই আগ্রহ অনুভব করেছেন।
যখন জীম্যান স্কুলের ছাত্র, ওই অল্প বয়সেই তিনি অরোরা বোরিয়ালিস নিয়ে একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রবন্ধ লিখে তার সঙ্গে নানাবিধ বৈজ্ঞানিক স্কেচ ও ইলাস্ট্রেশন জুড়ে একটি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
নেদারল্যান্ডসের লেইডেন ইউনিভার্সিটিতে জীম্যান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনা শুরু করেন। তাঁর অধ্যাপক ছিলেন হাইক কামেরলিঙ্গ ওনস ( ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৫৩ – ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬) এবং হেনড্রিক আনতুন লোরেঞ্জ ( ১৮ জুলাই ১৮৫৩ – ০৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮)। বলা দরকার, এঁদের মধ্যে লোরেঞ্জ জীম্যানের সঙ্গে পদার্থ বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেলজয়ী হয়েছিলেন। আর কামেরলিঙ্গ ওনস ১৯১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল সম্মান লাভ করেছিলেন।
খুব নিচু তাপমাত্রায় পদার্থের বৈশিষ্ট্য কি রকম হয় ও কিভাবে হিলিয়ম গ্যাসকে তরল করা যায়, সেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য কামেরলিঙ্গ ওনস নোবেল বিজয়ী হয়েছিলেন। আর হেনড্রিক আনতুন লোরেঞ্জ আলোকের উপর চৌম্বকত্বের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতেন।
লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার প্রথম কুড়ি বছর যাবৎ লোরেঞ্জ মূলতঃ বিদ্যুতের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্ব, চুম্বক এবং আলো নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী ছিলেন। লোরেঞ্জ ভেবে রেখেছিলেন যে, পদার্থের পরমাণুর অভ্যন্তরে অতিক্ষুদ্র ঋণাত্মক তড়িৎগ্রস্ত কণা রয়েছে এবং বলেছিলেন যে, ওই তড়িৎগ্রস্ত কণাগুলির দোলনের জন্য আলোক উৎপন্ন হয়।
গবেষক ছাত্র হিসেবে পিটার জীম্যান কার এফেক্ট নিয়ে কাজ করছিলেন। এই কার এফেক্ট আবিষ্কার করেন স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন কার ( ১৭ ডিসেম্বর ১৮২৪ – ১৫ আগস্ট ১৯০৭)।
আলোকরশ্মি যখন ক্রিস্টাল বা কাচ বা অন্য কোনো মাধ্যম যেমন গ্যাসের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন একটা নন লিনিয়ার অপটিক্যাল প্রভাব দেখা যায়। একেই বলে কার এফেক্ট।
উপস্থিত তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রভাবে আলো যে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তার প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তনটি ওই তড়িৎক্ষেত্রের বলের বর্গের আনুপাতিক হারে হয়ে থাকে।
কার এফেক্টকে কার ইলেকট্রো- অপটিক এফেক্টও বলা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে স্বচ্ছ মাধ্যমে আলো চলার পথে আলোকরশ্মির গতির অভিমুখের আড়াআড়িভাবে যদি একটা জোরালো তড়িৎক্ষেত্র রাখা হয়, তখন তার প্রভাবে আলোকরশ্মির প্রতিসরণের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এটাই কার এফেক্ট। একটি চৌম্বকিত তল থেকে আলো প্রতিফলিত হবার সময় কি রকম পরিবর্তন দেখা যাবে কার এফেক্ট তাও ব্যাখ্যা করে। পদার্থের আভ্যন্তরীণ চৌম্বক গঠন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে এর ব্যবহার রয়েছে।
যাই হোক লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র হিসাবে পিটার জীম্যান খুব যত্ন করে কার এফেক্ট নির্ধারণ করছিলেন। সেটা ১৮৯২ সাল। তাঁর এই প্রযত্ন লক্ষ করে নেদারল্যান্ডসের হারলেম এর সায়েন্টিফিক সোসাইটি তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। এই কাজের সূত্রে তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন।
এর বছর তিনেক পর, ১৮৯৬ সালে জীম্যান লক্ষ করলেন, একটি শিখায় কোনো পদার্থ দহন করতে করতে তা থেকে তৈরি আলোর বর্ণালীকে যদি একটি চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে পরিচালনা করা যায়, তখন বর্ণালীর আলোকরেখাগুলি দুইভাগ বা তিনভাগ এমনকি চারভাগ পর্যন্ত হয়ে যায়। জীম্যান এটা দেখে বেশ অবাক হলেন এবং ধন্দে পড়লেন। ওই ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইলেকট্রনের অস্তিত্ব জানা ছিল না।
জে জে টমসন, জন এস টাউনসেন্ড এবং এইচ এ উইলসন এর সঙ্গে একযোগে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এইসূত্রে টমসন ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। অবশ্য তিনি ইলেকট্রন নামটি দেন নি। নব আবিষ্কৃত অতিপরমাণুর জন্য তাঁর পছন্দের নামটি ছিল করপাসল। কিন্তু বিজ্ঞানীসমাজের কাছে সে নাম গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। ইলেকট্রন নামটাই মান্যতা পেল।
সে যাই হোক, কেন যে চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে বর্ণালীর আলোকরশ্মিগুলি এভাবে বহুধাবিভক্ত হয়ে যায়, তা নিয়ে পিটার জীম্যান যখন চিন্তিত, তখন তাঁর অধ্যাপক হাইক কামেরলিঙ্গ ওনস জীম্যানের পরীক্ষালব্ধ ফলগুলি আমস্টারডাম এর রয়্যাল নেদারল্যান্ডস অ্যাকাডেমি অফ আর্টস অ্যাণ্ড সায়েন্সেস এর বিজ্ঞানীদের কাছে পেশ করলেন। তারিখটা হল ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর। শনিবার। জীম্যানের আরেক অধ্যাপক হেনড্রিক লোরেঞ্জও খবরটা পেলেন। তারপরই সোমবার অধ্যাপক লোরেঞ্জ তাঁর ছাত্র জীম্যানকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন।
লোরেঞ্জ জীম্যানকে নিজের তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ তত্ত্ব দিয়ে বর্ণালীর ওই বহুধাবিভক্ত হবার ঘটনাটি ব্যাখ্যা করলেন।
জীম্যানের এই আবিষ্কার আরেক গুণী বিজ্ঞানী স্যর অলিভার জোসেফ লজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। অলিভার লজ ( ১২ জুন ১৮৫১ – ২২ আগস্ট ১৯৪০) নিজের হাতে জীম্যানের আবিষ্কার নানাভাবে যাচাই করে সন্তুষ্ট হয়ে লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে ঘোষণা করলেন। সেটা ১৮৯৭ সালের গোড়ার দিক। সোসাইটির বিজ্ঞানীদের কাছে জীম্যানের গবেষণা মান্যতা পেল। নেচার পত্রিকায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হল।
আজ আমরা জানি, ইলেকট্রনের স্পিন আছে। ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ রয়েছে। ওই স্পিন ইলেকট্রনের একটি মৌলিক পরিচয়। একটি চৌম্বকক্ষেত্রে বিপরীত স্পিনের ইলেকট্রনগুলির কক্ষপথ পরিবর্তন করার সময় আলাদা আলাদা শক্তিমাত্রা থাকে। এই স্পিনের ভিন্নতার জন্যই একটি বর্ণালী রেখার পরিবর্তে দুই, তিন, চার ইত্যাদি সংখ্যক বর্ণালী রেখা দেখা যায়।
আলোর পোলারাইজেশন নিয়ে লোরেঞ্জ বলেছিলেন। যখন একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি চলে, তখন এক অভিন্নতলে সেই রশ্মির কম্পনকে পোলারাইজেশন বলে। জীম্যানের গবেষণায় লোরেঞ্জের সেই বক্তব্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল।
লোরেঞ্জের বক্তব্য ছিল, পরমাণুর অভ্যন্তরে অতিক্ষুদ্র ঋণাত্মক তড়িৎগ্রস্ত কণার দোলনের কারণেই আলো উৎসারিত হয়, জীম্যানের গবেষণার আধারে তা স্পষ্ট হল। আরো জানা গেল ওই পরমাণুর অভ্যন্তরে অতিক্ষুদ্র ঋণাত্মক তড়িৎগ্রস্ত কণারা হাইড্রোজেন পরমাণুর চাইতে হাজারগুণে হালকা।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হালফিল ধারণায়, ইলেকট্রন যখন নির্দিষ্ট শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে উন্নীত হয়, তখন আলোর বর্ণালীর ছটা বের হয়। এই প্রতিটি শক্তিস্তর আলাদা আলাদা কৌণিক ভরবেগের দ্বারা সুচিহ্নিত। চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে পড়লে এই রশ্মির বিভাজন ঘটে যায়। একই অভিন্ন শক্তিমাত্রার আলাদা আলাদা অবস্থা হয়। এই আলাদা আলাদা অবস্থার কারণে আলাদা আলাদা বর্ণালীরেখা দেখা যায়।
রাম না জন্মাতে রামায়ণ, বলে একটি প্রবাদ আছে। ইলেকট্রনের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত ও প্রমাণিত হবার আগেই তার নানা বিষয়ে জানা গিয়েছিল পিটার জীম্যানের গবেষণায়।