সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৬২)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৬৭ 

সাবিত্রীদি আলাপনবাবুকে আবার কি বলে বসেন কে জানে ? তার ধুক-পুকুনির মধ্যেই গাড়িটা তিলপাড়া ব্যারেজ পার হয়। মোটর বাইকের মতোই আলাপনবাবুর গাড়ি চালানোর হাতটাও বেশ ভালো। খুব মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ি। শ্যাওড়াকুড়ি পার হতেই সাবিত্রীদি হঠাৎ বলে বসেন , আলাপনবাবু একটু চা খেলে হত না ?
আলাপনবাবু বলেন , হ্যা হ্যা নিশ্চয়। বলে রাস্তা লাগোয়া একটি ধাবার পাশে গাড়িটা দাঁড় করান তিনি।অঞ্জলি মনে মনে বলে , এই রে এবার আলাপনবাবুর হবে। সে সাবিত্রীদির মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু সেখানে পূর্বাভাসের চিহ্নমাত্র নেই। তারা খাটিয়া বসতেই একটি ছেলে কাঁচের গ্লাসে চা আর প্লেটে একটা করে পোড়া পাপড় দিয়ে যায়। খেতে খেতে সাবিত্রীদি আলাপনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন , আপনারা বিয়েটা করছেন কবে ?
— কবে বিয়ে করছি মানে ?
—- মানে অঞ্জলির সঙ্গে আপনার বিয়েটা হচ্ছে কবে ? আমরা নেমন্তন্ন পাব তো নাকি ?
— অঞ্জলির সঙ্গে বিয়ে মানে ? কি বলছেন আপনি ?
—- ও , তাহলে বিয়েই যদি করবেন না, তাহলে রাতের অন্ধকারে একাকী মেয়েটাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে কি করছিলেন ?
ওই কথা শোনার পরই অস্বস্তিতে পড়ে যান আলাপনবাবু। অসহায়ের মতো অঞ্জলির দিকে তাকান। অঞ্জলি তখন মুখ টিপে হাসছে
। তা দেখে আরও অবাক হয়ে যান তিনি। মুখ দেখেই অঞ্জলি অনুমান করতে পারছিল , খুব বেকায়দায় পড়ে গিয়েছেন আলপনবাবু। তাই তাকে উদ্ধার করতে অঞ্জলি বলে — দিদি সব জানেন। উনি দেখেও সেদিন না দেখার ভান করেছিলেন।

তার কথা শুনে লজ্জায় মুখ নামান আলাপনবাবু। সাবিত্রীদি তখন বলেন, তুমি বাপু কিছু মনে কোর না , আমি আর আপনি আজ্ঞে করতে পারছি না। তুমি আমার ভাইয়ের মতো।তাই বলছি আমাকে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমার এই বোনটাকে তোমার কাছে আমি সুখী দেখতে চায়।
তখন কথা সরে আলপনবাবুর মুখে। লজ্জা লজ্জা ভাবটা কাটিয়ে বলেন , না না আপনি আমাকে তুমিই বলুন , আমারই আগে আপনাকে বলা উচিত ছিল। আপনাকে দিদি হিসাবে পেলে আমারও খুব ভালো লাগবে। আমার তো আপন বলতে কেউ নেই। ঠাই ঠিকানাও নেই। ছোট থেকে হোমেই মানুষ হয়েছি।
— সে কি ? কেন ?
— কেন তা তো বলতে পারব না দিদি। তবে আপনারা যদি আপনার জন বলে আপনাদের কাছে একটু জায়গা দেন , তাহলে আমার এতদিনের শুন্য হৃদয়টা পূর্ণ হয়ে যাবে।
—- উহু , এভাবে বললে তো হবে না ভাই। আপনার জন হবে আর আপনি — আপনি করবে তা তো হবে না। আমি বুঝি একাই তুমি বলব ? ভাই বুঝি দিদিকে আপনি–আজ্ঞে করে কথা বলে ?
— বেশ দিদি তাই হবে।
অঞ্জলি লক্ষ্য করে আলাপনবাবুর চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে। সাবিত্রী সেটা মুছিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই ভিজিয়ে ফেলেন চোখের কোল। শুকনো থাকে না অঞ্জলির চোখও। মুহুর্তেই পরিবেশটা পাল্টে যায়। ভালো লাগায় ভরে যায় সবার মন প্রান। সেই ভালোলাগা নিয়েই গাড়িতে গিয়ে ওঠে তারা। তারপর গল্প করতে করতে পৌঁচ্ছে যায় সাবিত্রীদির বাড়ির দোরগোড়ায়।

গাড়ির শব্দ পেয়েই সাবিত্রীদির দাদা-বৌদি , ভাইপো–ভাইঝিরা ছুটে বেরিয়ে আসে। অঞ্জলি গাড়ি থেকে নেমে সংগে আনা মিস্টির প্যাকটা বড়বৌদির হাতে আর বাচ্চাদের হাতে লজেন্স তুলে দেয়। বৌদিরা রাগ দেখিয়ে বলেন, প্রতিবার এসব আনার কি দরকার ?
অঞ্জলি বলে — বার বার আর কোথাই বৌদি ? এই নিয়ে তো দু’বার এলাম মাত্র। আর কি’ই বা এমন এনেছি ?
— বেশ বেশ ভাই আর ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই। এসো এসো সবাই ভিতরে এসো–বলে বৌদিরা অঞ্জলির হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যান।
সাবিত্রীদি আলাপনবাবুকে বলেন — তুমিও এসো ভাই।
সম্বোধনের পরিবর্তনে বৌদিরা একবার আলাপনবাবু আর একবার তার মুখের দিকে তাকান।ব্যাপারটা আন্দাজ করে সাবিত্রীদি ব্যাপারটা খোলসা করেন। বৌদিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন , আজ থেকে আলাপনও আমার আর একটা ভাই। খুব শীঘ্রিই আর একটা ভাজও হতে চলেছে আমার। বলেই অঞ্জলির দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান সাবিত্রীদি।
আর সেটা আন্দাজ করতর পেরেই হই-হই করে ওঠেন বৌদিরা। তারা অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে সমস্বরে বলে ওঠেন –কি মিলল তো ? আমাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয় বুঝলে। দেওরের বিয়েতে আমরা সেজেগুজে বরযাত্রী যাব কিন্তু। শুধু দুটো সই করে সেই পাট চুকিয়ে নিলে মানব না।
অঞ্জলিরা লজ্জায় কোন কথা বলতে পারে না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সাবিত্রীদিই তাদের উদ্ধার করেন। বৌদিদের বলেন , হ্যা –হ্যা সে হবে ক্ষণ।
এতদুর সব হয়রানি করে এলো , ওদের একটু তিষ্ঠাতে দাও তো বাপু।
তারপর বৌদিদের খপ্পর থেকে নিস্কৃতি মেলে অঞ্জলিদের। ঠিক ছিল সাবিত্রীদিকে পৌঁচ্ছে দিয়ে টিফিন করেই ফিরে যাবে তারা। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।একে তো বৌদিরা খাওয়া – দাওয়া না করে কিছুতেই যেতে দেবেন না , তার উপরে তাদের আসার খবর পেয়েই এসে পড়ে সাবিত্রীদিদের সেলফ হেল্প গ্রুপের মেয়েরা।

 

সাবিত্রীদি গ্রামের পিছিয়ে পড়া পরিবারের ১২ জন মেয়ে মিলে ‘ অবলম্বন ‘ নামে সেলফ – হেল্ফ গ্রুপ খুলেছেন। সাবিত্রীদিদের বাইরের একটা ঘরে তাদের অফিস হয়েছে। সেখানেই সাবিত্রীদি হোম থেকে তার কাছে শিখে আসা ঝাঁটা, ঝুড়ি, তৈরি আর তালাই বোনা মেয়েগুলোকে হাতে ধরে শেখাচ্ছেন।
তালাই বোনাটা রপ্ত করে নিলেও ঝাঁটা আর ঝুড়ি তৈরির কৌশলটা কিছুতেই নাকি বাগে আনতে পারছে না তারা। তাই মেয়েগুলো এসে পৌঁছোতেই সাবিত্রীদি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে , যা না ভাই , আমি ঠিক পেরে উঠছি না। কৌশলটা ওদের যদি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারিস দেখ না। মেয়েগুলো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে — হ্যা হ্যা, এসো না দিদি আমাদের একটু শিখিয়ে দেবে।
অঞ্জলি লক্ষ্য করে মেয়েগুলোর আগ্রহ,চোখে নিজের পায়ে দাঁড়ানো স্বপ্ন। অঞ্জলির নিজেরও খুব ভালো লাগে। তার কাছে হাতের কাজ শিখে ওরা যদি সামান্যতম স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারে তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিই হতে পারে ? তাই সে বলে, ঠিক আছে চলো দেখি।
কিছুক্ষণ দেখানোর পরই কয়েকটি মেয়ে কৌশলটা রপ্ত করে নেয়। মাঝে মধ্যে এসে তাদের এভাবেই দেখিয়ে দিয়ে যেতে হবে বলে মেয়েগুলো তাকে অনুরোধ করে।
আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবেই ছাড় পায় অঞ্জলি। তারপরই মেয়েগুলো যে যার বাড়ি চলে যায়। তারা চলে যেতেই এসে পৌঁছোন সাবিত্রীদির পাতানো ভাই অমলবাবু।কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে তিনি আলাপনবাবুর দিকে চেয়ে বলেন , আপনাদের আসার খবর পেয়েই আসছিলাম দোকান বন্ধ করে।কিন্তু তারপরই জানতে পারলাম খাওয়া দাওয়া না করে তোমাদের ছাড়া হবে না। ওইসঙ্গে আমারও নেমন্তন্ন হয়ে গেল। তাই একেবারে স্নান করে চলে এলাম।
আলাপনবাবু বলেন , ভালোই করেছেন।
তারপর এক সঙ্গে খেতে খেতে নানা গল্প গুজব হয়। খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে অঞ্জলিরা বেরোনোর উদ্যোগ নিতেই সাবিত্রীদি পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে অঞ্জলির হাতে তার মোবাইলটা তুলে দিয়ে বলেন – এটা তুই রাখ।
তীব্র আপত্তি করে সেটা ফিরিয়ে দিয়ে অঞ্জলি বলে , না না তোমার মোবাইল আমি রাখব কেন ?
— রাখবি আমি বলছি বলে। দেখ এখন আর আমার ওটার কোন দরকার নেই। দাদাদের তো ফোন আছেই। ওটা তোর কাছে থাকলে তোদের খবরাখবর সব পাব। তাছাড়া আলাপনের সংগেও সময় সুযোগ মতো কথা বলতে পারবি।

 

আলাপনবাবুর প্রসঙ্গ উঠতেই আবার লজ্জায় পড়ে যায় অঞ্জলি। কুন্ঠার সঙ্গে বলে , না–না , দিদি বিষয়টা হয়তো উনি ভালো চোখে দেখবেন না। কিছু বলতে পারেন হয়তো।
—- কই , বলুক তো দেখি দিদির সামনে তার বোনকে কি বলে ? হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব না তাহলে।
তারপর তার হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে মুঠোটা বন্ধ করে দেন সাবিত্রীদি। তার আর কিছু করার থাকে না। ফোনটা নিয়ে সে সবার কাছে একে একে বিদায় নিতে শুরু করে। গাড়িতে ওঠার আগে বৌদিরা কটাক্ষ করে বলেন, দেখো ভাই শুভদিনে আমাদের কথা যেন ভুলে যেও না। নেমতন্ন – টেমন্তন্ন পায় যেন।
তারপর আলাপনবাবুকে বলেন , কি ভাই মনে থাকবে তো আমাদের কথা ? বৌভাতে গিয়ে আমাদের মেয়েটাকে কেমন সাজিয়ে দিই দেখবে , একেবারে চোখ ফেরাতেই পারবে না তুমি।
সাজানোর কথা শুনে পুরনো একটা কথা মনে পড়ে যায় অঞ্জলির। দিদি আর বৌদিকে বিয়ের পর সাজিয়ে দিয়ে সে ভেবেছিল , তাকে কে সাজিয়ে দেবে ? আজ ভাগ্য তাকে কোথাই এনে ফেলেছে।দিদি হয়তো আসবে , কিন্তু দাদা- বৌদি? তার খবরই তো তারা কেউ নেয় না , কিন্তু তারা কেমন আছে জানতে খুব ইচ্ছে করে অঞ্জলির। নিজের বৌদির হাতে সাজা না হলেও সাবিত্রীদির বৌদিরা সাজিয়ে দিলেই তার মন ভরে যাবে। ওদের আন্তরিকতা সে জীবনে ভুলতে পারবে না। তার ভাবনার মাঝেই আলাপনবাবু বলেন , বৌভাতের ব্যবস্থা তাহলে তো আপনাদেরই করতে হবে। সাবিত্রীদি সবই জানেন। আমার আপনার বলতে কেউ নেই। আপনারাই আমার আপনজন।
এবারে মুখ খোলেন সাবিত্রীদির দুই দাদা। তারা বলেন , আমাদের যখন তুমি আপনারজন বলে এত সম্মান দিলে, তখন বৌভাতের দায়িত্ব আমারই নিলাম। কি বলো দিদি ?
সাবিত্রীদি বলেন , আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। কিন্তু তোদের সঙ্গে আলোচনা না করে কিছু বলতে পারছিলাম না। এখন তোরা দায়িত্ব নিলি, আমার বুকটা ভরে গেল।অঞ্জলি লক্ষ্য করে কখন সাবিত্রীদির দাদারা আলাপনবাবুকে আপনি থেকে তুমি বলতে শুরু করেছেন। তার খুব ভালো লাগে। আন্তরিকতাই বোধহয় এই রকম করে সব বেড়া ভেঙে দিতে পারে। সাবিত্রীদিদের বাড়িতেই বৌভাতের অনুষ্ঠান চূড়ান্ত হয়ে যায়। তারপর বৌদিরা অঞ্জলিকে গাড়িতে তুলে দেয়। গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে হোমের পথে।

 

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।