জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
টলস্টয়ের বউ
তিনি ছিলেন টলস্টয়ের বালিকা বধূ। আঠারো বৎসরের বালিকাটির সাথে পরিচয় হল কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয়ের। তখন টলস্টয়ের চৌত্রিশ বৎসর বয়স। আর তাঁর ‘দি কসাকস’ উপন্যাসটি বেরিয়ে গিয়েছে। বেশ একটু নামডাকও হয়েছে। বালিকার নাম সোফিয়া। সোফিয়া আন্দ্রিয়েভনা বেহরস। বয়সে ষোল বছর বড় একজন মানুষের সঙ্গে বাগদান হল সোফিয়ার। বড় মানুষ। অভিজাত। রাশিয়ান সাম্রাজ্যের টুলা গভরনেট এর ইয়াসনায়া পলিয়ানা এস্টেটের ভূস্বামী ওঁঁরা।
সোফিয়াকে বাড়িতে আদর করে ডাকে সোনিয়া বলে। সোনিয়া অবাক হয়ে দ্যাখে লিও টলস্টয়কে। কাজান ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছিল লোকটা। ষোল বছর বয়স তখন ওঁর। ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরা বলেছিলেন এই ছেলেটা ওঁচা আর যাচ্ছেতাই। পড়াশুনা ওর মাথায় ঢোকেই না। তাই তো গোলন্দাজ বাহিনীতে কাজ নিয়ে চলে গেল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে। সেখানে বীরত্ব দেখিয়ে সুনাম হল। ওরা টলস্টয়ের দাম বুঝল। ওকে করে দিল লেফটেন্যান্ট।
বাপ মায়ের আদর পায় নি লোকটা। মা তো মরে গিয়েছিল তখন ওর মোটে দু বছর বয়স। মাকে তো মনে থাকার কথাই নয় ওই বয়সে। বাবা নিকোলাই ইলিচ টলস্টয়কে ও হারিয়েছে নয় বছর বয়সে। যুদ্ধ করতে আর ভাল লাগে নি। কত মানুষ মারা পড়ে। কত সংসার ছরকুটে যায়। তাই ফিরে এল।
সেইসব কথা লিখেছেন ওঁঁর চাইল্ডহুড নামের উপন্যাসে। সেটা ১৮৫২ সাল। সোফিয়ার তখন মোটে আট বছর বয়স। আর ওঁঁর তখন বই ছাপা হচ্ছে। লিও’র একটা ভাই ছিল । নিকোলা। সে মারা গেল ১৮৬০ সালে। খুব একা হয়ে গেল লিও। কি করে একাকিত্ব কাটাবে। বিয়ে করে একাকিত্ব কাটাবে ভাবল।
সোফিয়াও অবশ্য বড় ঘরেরই মেয়ে। বাবা তার জার্মান। তিনি ডাক্তার। নাম আন্দ্রে এভসটাফিয়েভিচ বেহরস। মা অবশ্য রাশিয়ান। নাম তাঁর লিউবভ আলেকজান্দ্রেভনা ইসলাভিনা। মায়ের ঠাকুরদা ছিলেন জাঁদরেল লোক। কাউন্ট পিওতর জেভাদভস্কি। তিনি ছিলেন রাশিয়ার প্রথম শিক্ষামন্ত্রী।
১৮৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সতেরো তারিখে টলস্টয়ের সঙ্গে অনেকটা সময় কথা হল সোফিয়ার। গুণী মানুষটা। বাগদান হলো দুজনের। তারপর তিনি নিজের ডায়েরি পড়তে দিলেন কিশোরী সোফিয়াকে। কত কিছু লিখেছেন তিনি। হাতের লেখা সব সময় স্পষ্ট নয়। ওমা, কি সব লিখেছেন তিনি! তিনি এক দাসীর গর্ভে একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বুকের মধ্যে কেমন করতে থাকে সোফিয়ার। ষোল বছরের বড় লোকটা। চৌত্রিশ বছর। নিজের যৌন জীবনের নানা কথা লিখেছেন ডায়েরিতে। কত মেয়ের সাথে শরীরী সম্পর্কে জড়িয়েছেন, সব লিখেছেন। ভয় ভয় করতে থাকে সোফিয়ার। এ কার সাথে বাগদান হল তার!
মনকে শক্ত করেন সোফিয়া। বড় জমিদার ঘরের ছেলেদের এ রকম অভ্যাস থাকেই। দাসীদের দিকে চোখ পড়লেই হল। তাদেরকে বিছানায় তুলে নিয়ে আসেন। তবে তাদের তো আর ধর্মপত্নী বলা চলে না! ছয়দিন পরে সেপ্টেম্বর মাসের তেইশ তারিখে টলস্টয়ের সঙ্গে বিয়ে হল সোফিয়ার। হলেন কাউন্টেস সোফিয়া তলস্তয়া।
আজ বাইশ আগস্ট সোফিয়া তলস্তয়ার জন্মদিন। ১৮৪৪ সালে জন্মেছিলেন।
স্বামীর যৌন অভিযানের গল্পগুলি সমস্তই ডায়েরি থেকে পড়ে নিয়েছেন সোফিয়া। স্বামীর জীবনের দায়িত্ব নিতে গিয়ে ওসব মনে রাখলে চলবে না। স্বামী সারাদিন লেখার ঝোঁকে থাকেন। ঘরময় বই কাগজ ছড়ানো। খেতেও ভুলে যান। কাছে বসে খাইয়ে দিতে হয়। একটা কাগজও হাতছাড়া করেন না কাউন্টেস সোফিয়া। যত্ন করে গুছিয়ে রাখেন। সমস্ত সংসারের দায়িত্ব এখন তাঁর ওপরে। লিওর যে বাবা মা কেউ নেই। তিনিই লিওর অভিভাবক, স্নেহদাত্রী, সুখদাত্রী, প্রেরণাদাত্রী। একে একে সন্তান জন্ম নেয়। মোট তেরটি সন্তান জন্মাল। সবাই অবশ্য বাঁচে নি। আটখানা বেঁচে বর্তে ছিল। বাকিরা কচি অবস্থায় শেষ হয়ে গেল। কেন রে এলি তোরা? এলি যদি, আরও একটু আয়ু নিয়ে এলি না কেন! যখনই স্বামী দেহ চেয়েছেন, নিঃসঙ্কোচে নিজেকে তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছেন সোফিয়া। প্রতিভাবান মানুষের দাবি অনেক। এরা ক্ষণজন্মা। এদের খুশি রাখা মেয়েদের দায়িত্ব। মাঝে মাঝে ভয়ও চেপে ধরে। তাঁর চোখ এড়িয়ে কোনো দাসী বাঁদি টলস্টয়ের কাছে ঘেঁষছে না তো?
রাত হয়ে গেলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে চাকরবাকরদের শুতে পাঠিয়ে স্বামীর লেখা থেকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে বসেন তিনি । টলস্টয় ওয়ার অ্যাণ্ড পিস লিখছেন।।
একে একে সাত সাতটা পাণ্ডুলিপি তৈরি হল। গুছিয়ে যত্ন করে লিখে দেন সোফিয়া। পরের দিন আবার বদল হয়। কিন্তু চমৎকার একটা লেখা হচ্ছে। দুনিয়া জুড়ে লোকে নাম করবে ওয়ার অ্যাণ্ড পিস এর। ১৮৬৯ এ বেরোলো ওয়ার অ্যাণ্ড পিস।
নিজেও তিনি ডায়েরি লেখেন। ডায়েরি লেখা একজন ক্রিশ্চিয়ানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। লেখো, নিজের কথা লিখে রাখো। গান বাজনার চর্চাও করেন সোফিয়া। ছবি আঁকেন। ঘর সাজান। আর স্বামীর সম্পত্তি আর ইয়াসনায়া পলিয়ানা এস্টেটের আয় ব্যয় দেখাশুনা করেন। এত কাজের পরেও রাতে ঘুম আসে না। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাড়া তাড়া লেখা থেকে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। না কি পাণ্ডুলিপি গড়ার ছলে স্বামীকে পাহারা দেন! যাতে আর কোনো দাসী তাঁর সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে জড়িয়ে উঠতে না পারে!
১৮৭৩ সালে আনা কারেনিনা লিখতে শুরু করলেন টলস্টয়। দি রাশিয়ান মেসেঞ্জার কাগজে ধারাবাহিক বেরোয় সেই লেখা। এমনি করে ১৮৭৭ সাল অবধি বের হল। তারপর ১৮৭৮ সালে দুই মলাটের মধ্যে বই হয়ে বেরোলো আনা কারেনিনা। টলস্টয়ের সাহিত্য জীবনের সবচাইতে বড় সম্পদ। স্তেপান স্টিভা আর্কাদিয়েভিচ অবলনস্কির বোন আনা আর্কাদিয়েভনা কারেনিনার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আলেক্সেই আলেকজান্দ্রোভিচ কারেনিন এর। তিনি যে আনার চাইতে কুড়িটা বছরের বড়। আনার গল্প পড়তে পড়তে নিজের জীবনের ছায়া দেখতে পান তিনি। আনার সঙ্গে ভ্রনস্কির একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে। একটা দারুণ গল্প। পরে সিনেমা হলে গ্রেটা গার্বোর মতো সুবিখ্যাত নায়িকা আনা চরিত্রে রূপ দেবেন।
সোফিয়া শখে ফোটোগ্রাফি শিখছেন। সংসারের বিপুল খরচ। দাসদাসীদের জন্যেও খরচ। স্বামীর লেখা থেকে রয়ালটি বাবদে যথেষ্ট পরিমাণে
পয়সা আসে বলে সংসার হেসে খেলে চলে যায়। শখ শৌখিনতা করা যায়।
কিন্তু লিও টলস্টয়কে আস্তে আস্তে যেন অচেনা লাগে। সম্পত্তির প্রতি উদাসীন হয়ে থাকছেন। পুরোনো বইগুলোর রয়ালটির টাকা নিয়ে খোঁজ খবর অবধি করতে চান না। কেমন একটা একবগগা একগুঁয়ে ভাব লিওর। এই লোকটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা শক্ত। সব সময় আর মুখ বুজে সহ্য করতে পারেন না সোফিয়া। আর কোনো বড় মাপের সাহিত্যিকের দাম্পত্য জীবন এতখানি টলমল করে উঠেছে? সোফিয়া কি সাধারণ মানুষকে ভালবাসেন না? ১৮৯১ – ১৮৯২ সালে যে দুর্ভিক্ষ হল, তাতে তো তিনিও কাজ করেছেন। তাবলে নিজের হকের টাকা ছেড়ে দেবেন কেন টলস্টয়? সংসার চলবে কি করে! আটখানা ছেলেপুলে। তারা তো কাউন্টের ঘরের ছেলে। তারা কেন কষ্টের মধ্যে বড় হবে! ফুঁসে ওঠেন সোফিয়া।
ওদিকে ওই মানুষটা লিখে চলেছেন গভীর সব কথা। ১৮৭৯ সালে লিখে ফেলেছেন এ কনফেশন। ১৮৮৬ তে পরপর লিখলেন গ্রেন বা শস্যদানা, একজন মানুষের কতটা জমি চাই, দি গডসন। ওই ১৮৮৬ তেই লিখলেন হোয়াট ইজ টু বি ডান। কী করিতে হইবে। পরের বছর ১৮৭৯ তে লিখলেন অন লাইফ। ১৮৯৩ তে দি কিংডম অফ গড ইজ় উইদিন ইউ। ১৮৯৪ সালে রীজন অ্যাণ্ড রিলিজন, রিলিজন অ্যাণ্ড মরালিটি, আর ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যাণ্ড প্যাট্রিওটিজ়ম। ১৮৯৬ তে এ লেটার টু দি লিবারালস। ১৮৯৯ তে রেজারেকশন।
দাম্পত্য জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। একবগগা একঝোঁকা একটা লোক হয়ে গেছেন লিও টলস্টয়। আচ্ছা, তুমি কৃচ্ছ্রতাসাধন করে আনন্দ পাচ্ছ বলেই যে সবাইকে তা পেতে হবে, তার কোনো মানে আছে!
১৯১০ সালে বিরাশি বছরের বৃদ্ধ গৃহত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন। নিউমোনিয়া বাধালেন। অ্যাসটাপাভো রেলওয়ে স্টেশনে তাঁকে পাওয়া গেল। বাঁচলেন না। ওই ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বরে মারা পড়লেন টলস্টয়।
অনেক গরিব মানুষ দলে দলে এসেছিল তাঁর অন্ত্যেষ্টিতে। তারা টলস্টয়ের নামটাও শোনে নি। তাঁর লেখা পড়া তো দূরস্থান। তারা শুধু শুনেছিল কে এক সাধু মহাত্মা নাকি দেহরক্ষা করেছেন।
সোভিয়েত বিপ্লব দেখা হল না টলস্টয়ের। তবে তাঁর বউ তা দেখলেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বরের চার তারিখে পঁচাত্তর বছর বয়সে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়লেন সোফিয়া, টলস্টয়ের বউ। ডায়েরি লিখতেন তিনি। সেই ডায়েরি বই হয়ে বেরোলো একশো বছর পরে। আমার জীবন।