“গণেশ চতুর্থী” -তে মৃদুল শ্রীমানী

গণেশকথা – ১

ব‍্যাসকূট

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব‍্যাস মহাভারত লিখবেন। কিন্তু লিখে দেয় কে? অনেক খুঁজে কলমচি পাওয়া গেল গণেশ ঠাকুরকে। গণেশ তো ডিকটেশন নিতে রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত করলেন যে, মহাভারত বলতে বলতে ব‍্যাসের একবারের জন‍্য‌ও থামা চলবে না। বলা থামালেই, লেখা চিরতরে বন্ধ।
ব‍্যাস মন দিয়ে শুনলেন গণেশের কথাটা। তারপর বললেন, গণেশজী, তাই হবে। তবে, আমি যা বলব, তার অর্থ না বুঝে তুমি লিখতে পাবে না। শুনবে, অর্থ উপলব্ধি করবে, তারপর লিখবে।
গণেশ গেলেন ফেঁসে। কোন্ মুখে বলবেন, অর্থ না বুঝে লিখছি। মহাভারতীয় ব‍্যাসকথার অর্থ বুঝতে গণেশজীর সময় লাগত। ইত‍্যবসরে ব‍্যাস মনে মনে পরবর্তী শ্লোকটুকু রচনা করে ফেলতেন। ব‍্যাসদেবের এই যে দুষ্টু বুদ্ধি, এই যে প‍্যাঁচ, একে বলে ব‍্যাসকূট।

গণেশকথা – ২

পরমেশ্বরীর স্পা

শিবজায়া পার্বতীর বাড়িতেই স্পা ছিল। মডার্ন লেডি পার্বতী বডি শেমিংয়ে বিশ্বাস করতেন না। সেকালিনী দেবীরা প্রায় কেউই করতেন না। সরস্বতী এবং গঙ্গাও। তো খোলামেলা স্পায়ে খোলামেলা গায়ে মাসাজ নিচ্ছিলেন শঙ্করঘরণী। জয়া বিজয়া দুই মাসাজ এক্সপার্ট তাঁদের কসরৎ দেখাচ্ছেন। দেবী মহেশ্বরীর গা থেকে তেলের সৌজন্যে ময়লা উঠে আসছে। ময়লা তো নয়, ও আসলে জীর্ণ ত্বকের অংশ। এপিথেলিয়াল টিস‍্যু। দেবীর শখ হল, তাই দিয়ে পুতুল গড়েন।
ওদিকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বিষ্ণু। পরমেশ্বরীর স্তনসৌন্দর্য দেখে গোবিন্দজী ফিদা হয়ে গেলেন। ইচ্ছে হল কোনো ছলে ওই পীন পয়োধর স্পর্শ করবেন। বিষ্ণু ঢুকে পড়লেন পুতুলটির মধ‍্যে। গণেশ হয়ে ওঁয়া করে কেঁদে উঠলেন।

গণেশ কথা – ৩

মামা কাহিনী

মামা জিনিসটা বড় প্রিয়। বাঙালি যাকে ভালবাসে, তাকে মামা বলে। বাঙালি সূর্যকে মামা বলে, চাঁদকেও মামা বলে। এমনকি পুলিশকেও মামা বলে। বিখ্যাত মামার গল্পে কংস, কালনেমি আর শকুনি স্টার অ্যাট্রাকশন। কিন্তু এক যে ছিল মামা। সে হল রবিনন্দন। মানে? শনি মহারাজ। এই শনি ছিলেন গণেশজীর মামা। তো মামাজী ভাগ্নেকে দেখতে এসেছেন। কিন্তু দেখতে গিয়েই বিপত্তি। শনি তাকানো মাত্র গণেশের মুণ্ড গেল খসে। অনুষ্ঠান বাড়িতে হায় হায় রব। তখন জানা গেল, উত্তর দিকে মাথা করে যে শুয়ে আছে, তার মাথা কেটে এনে বাচ্চার মাথায় জোড়া যাবে। তখন জম্বুদ্বীপে অসাধারণ এলেমদার সব সার্জন ছিলেন। উত্তর দিকে মাথা করে শুয়েছিল একটা হাতি। এলিফ‍্যাস ম‍্যাকসিমাস ইণ্ডিকাস। তো সেই হস্তিমুণ্ড এনেই শল‍্যচিকিৎসা শুরু হল। অপারেশন সাকসেসফুল। গণেশের মাথায় হাতির শুঁড়, হাতির কান। সার্জারির কি চমৎকার!

গণেশকথা – ৪

দাঁত ভাঙা অঙ্ক

বাবা বলে গেছে, কাউকে আসতে দিবি না। বিড়বিড় করে বলতে বলতে গণেশ পাহারা দিচ্ছে। কেউ যদি এয়েচো তো, শূন‍্যেই পাগলা জগাইয়ের মতো এলোপাতাড়ি হাত চালায় গণেশ।
এমন সময় পরশুরাম এসে হাজির। জমদগ্নি মুনির পুত্র সে। এসে বলল, দেবাদিদেব শঙ্করকে আমি প্রণাম করতে চা‌ই। আমায় ভিতরে যেতে দাও। গণেশ বলল, বাবা এখন ব‍্যস্ত। বাড়িতে ঢোকা যাবে না। পরশুরাম বলল, মহেশজীর সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে। তুমি প্লিজ আমাকে ঢুকতে দাও। গণেশ ভাল কথা শোনার পাত্র নয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেন্ট বুঝি না। বাবা বলেছে দেখা হবে না চলে যাও।
পরশুরাম গণেশের গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝাতে গেল, ভাই, আমার সাথে শলাপরামর্শ করবেন বলেই, উনি অন‍্য কারোর আসার ব‍্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তুমি আমায় ঢুকতে দাও।
গায়ে হাত ছোঁয়ানোয় খুব রেগে গেল গণেশ। তারপর তেড়ে এসে এক ঢুঁ। পরশুরাম ছাড়বে কেন? সেও তো বিষ্ণুর অবতার। লেগে গেল ঝটাপটি। পরশুরামের আঘাতে গণেশের দাঁত ভাঙল। সেই থেকে গণেশ একদন্তং মহাকায়ং ।

গণেশকথা – ৫

কলাবৌ

আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি। সপ্তমীতেই একটু একটু শীতের ছোঁয়া। চাদরটা তখনও মুড়ি দিয়ে শুনতে পাওয়া যেত কলাবৌ স্নানে চলেছেন। কলাবৌ, কলাবতী বধূ নাকি গণেশের বৌ। বাড়ির সকলের জমকালো পোশাক। বাহনগুলোও কম যায় না। শুধুমাত্র কলাবৌ একটা ম‍্যাড়মেড়ে লালপাড় মিলের শাড়ি পরে একগলা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেকালিনী গৃহবধূকে অমন একগলা ঘোমটা দিয়েই থাকতে হত। তো কলাবৌয়ের জন‍্য আমার ভারি মনকেমন করত। সে বুঝি মা তোমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে?
পরে জানলাম কলাবৌ আসলে কৃষিলক্ষ্মী।
দুর্গার বোধন হয় দুর্গাষষ্ঠীতে। আর সপ্তমী সকালে কলাবধূর স্নান।
ছোটবেলায় জানতাম কলাবৌ গণেশের বৌ। পরে বড় হয়ে সিলেবাস ডিঙিয়ে ব‌ই পড়ার বদভ্যাস রপ্ত করলে জানলাম ও কলাবতী স্বয়ং দেবী দুর্গা। আমার ছোটবেলার লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরা ঘোমটা টানা কলাবৌ আসলে নবপত্রিকা। নব মানে নয়টি। নয়রকম উদ্ভিদ, সমূল, ও সপত্র উদ্ভিদ । কলা, কচু, ধান, হলুদ, ডালিম, বেল, অশোক, জয়ন্তী ও মানকচু।
তো কলাবৌয়ের রকম সকম দেখে মনে হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাঙালির ঘরে ঘরে মা অথবা বৌ, কেউ না কেউ নির্যাতিত হতে থাকে। কিছু বাঙালি বৌকে সন্দেহ করে অতিরিক্ত মাতৃভক্ত সাজে। আর কিছু বাঙালি বৌয়ের যৌনদাস হয়। দুটোই বিকৃতি। মা আর বৌ, দুজনেই গৃহলক্ষ্মী। দুজনেই সমান শ্রদ্ধেয়, সমান আদরণীয়। বাঙালি এইটি বুঝতে পারলে ভাল। ন‌ইলে তাকে গোবরগণেশ বলব।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।