আপনার বিচারবোধ আর ন্যায়পরায়ণতার কাছে আমরা আপিল করছি, যে পদ্ধতিতে এই আদালত আমাদের প্রাণদণ্ডের সিদ্ধান্ত নিলেন, তা ভেবে দেখুন। একজন বিচারকের চেয়ারে বসলেই সে লোকটা ন্যায়মূর্তি হয়ে যায় না। বিচারকের পক্ষেও অন্যায় এবং অসংগত কাজ করা সম্ভব হতে পারে। এ ধরনের অনেক নিদর্শন আছে। আমাদের ইতিহাসে লর্ড জেফ্রি দের কথা আমরা শুনেছি। তাই বলছি, একটা লোক বিচারকের পদে রয়েছে বলেই তার কাজ যথার্থ হয়ে যায় না। গোটা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা বিচারপতি পদে আসবার জন্য চেষ্টা করেন, বড় বড় পুঁজিপতির সমর্থনেই তাঁরা সেই চেয়ার পেয়ে থাকেন। আমেরিকান পলিটিক্সের এই কায়দাটা সবাই জানে। সবাই আরো জানে যে আমাদের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কিভাবে হতে হয়। হান্টিংটনেরা আর জয় গৌল্ডেরা কিভাবে, আর কাদের বদান্যতায় এই আমেরিকায় সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতির পদ পেয়ে যায়, সেটা অজানা নয়। রেল কোম্পানির বড় বড় মালিকেরা তাদের পছন্দের লোককে ওই চেয়ারে বসায়। আর ঠিক এই কারণেই আমাদের আদালতের উপর, গোটা বিচারব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা টলে গিয়েছে।
এখন আমি আমার সমস্ত চিন্তাটা আপনার কাছে গুছিয়ে তুলে ধরতে চাই। আমরা যখন এই আদালতে প্রথম আসি, তখন তো আমি জানতাম না, আপনার মনে ঠিক কী আছে। আন্দাজ করতেই পারি নি, আপনি কী করতে চলেছেন। আর দ্বিতীয়তঃ, আমি জানতাম না, আমাদেরকে আর একবার ভাল করে শুনানির অধিকারটুকু না দিয়েই অভিযোগকারী সরকারি পক্ষের বক্তব্যের ভিত্তিতে আমাদের ফাঁসি দিচ্ছেন। বাস্তব ঘটনার সঙ্গে আপনাদের এই বিচারের কোনো যোগসূত্রস্থাপন ও মেলবন্ধন হল না।
আমি বলতে চাই, আমাদের উপর এই ফাঁসির আদেশটা আগাপাশতলা একটা জুডিশিয়াল মার্ডার হয়ে দাঁড়াল। গণপিটুনি বা গণধোলাইয়ের ফলে মানুষের মৃত্যুর কথা শোনা যায়। গণপিটুনিতে তথ্যপ্রমাণ, যুক্তিবিচার এসবের ধার না ধরেই লাগামছাড়া আবেগে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু গণপিটুনির জেরে মানুষের মৃত্যু ঘটায় উন্মত্ত জনতা। তারা তো আইনের পাঠ নেয় নি। বিচারকসুলভ শিক্ষা, নিরপেক্ষতা, যুক্তিবিচার ও নৈর্ব্যক্তিক মানসিক গঠন, উন্মত্ত জনতার কাছে আশা করা যায় না। তাই আপনাদের এই বিচার উন্মত্ত জনতার হাতে গণপ্রহারে মৃত্যুর চেয়েও নিন্দনীয় ও লজ্জাকর। মহাশয়, আপনার এই বিচারটি গণধোলাইয়ের থেকে সামান্যই আলাদা। এখানে অভিযোগ তুলেছে একদল উন্মত্ত জনতা। তাদের উন্মত্ততাকে অভিনন্দন জানিয়েছে একদল সংগঠিত ক্ষমতাবান জনতা। কিন্তু সেই ট্রায়াল এখন সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন আপনি শান্ত ধীর স্থির বিচারকের মতো, বিবেচক মানুষের মতো এখানে আসীন রয়েছেন। এবার আপনি গোটা বিষয়টা যুক্তির প্রেক্ষিতে, স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে নিরীক্ষণ করুন তো। আপনার এই মামলার একটা উদ্ভট বৈশিষ্ট্যের দিকে আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেটা হল যে ভঙ্গিতে, আর যে পদ্ধতিতে সরকার পক্ষ তাদের অভিযোগ আপনার আদালতে পেশকরল। আর এক দিকে যে পদ্ধতিতে পুরো দস্তুর যে ঢঙে, যে কায়দায় পুঁজিপতিরা শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধতা করে, ঠিক সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের অ্যাটর্নিরা এই মামলাটা চালালেন। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস হল, আমাদের, অভিযুক্তদের অ্যাটর্নিদের আচরণ। ভেবে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়, আমাদের পক্ষের উকিলবাবুরা যেন সারাক্ষণ খুনের মামলার সওয়াল চালিয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের উকিল হলেও তাঁরা পুঁজিমালিকের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনতার সপক্ষে কিছু বলতে চাইলেন না। সরকার পক্ষ যেভাবে মামলাটা তুলে ধরল, সেটা আগাপাশতলা পুঁজিপতিদের স্বার্থে। ভিতরে পুঁজিবাদী সত্তা সক্রিয়ভাবে না থাকলে ওভাবে মামলা লড়াই যায় না। তাদের প্রবৃত্তিটাই পুঁজি মালিকের ছাঁচে তৈরি।
আমি বলতে চাইছি শ্রেণীগত উপলব্ধির কথা। যে শ্রেণীটা একনায়কত্বকে সঠিক বলে মনে করে, এবং সাধারণ মানুষের কথা বলার অধিকারটা হরণ করে নিতে চায়, মনেই করে না সাধারণ মানুষের বলার কোনো কিছু থাকতে পারে; তারা মনে করে শ্রমজীবী মানুষের একটাই মাত্র অধিকার আর একটাই মাত্র দায়বদ্ধতা; তা হল, মালিকের প্রতি আনুগত্য। গোড়া থেকেই তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মামলাটা চালিয়ে গিয়েছে। আমার সহযোদ্ধা, আমার কমরেড স্যামুয়েল ফিলডেন খুব চাঁছাছোলা ভাষায় সোজা সরল সত্যটাকে তুলে ধরেছেন। খুন করার লক্ষ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে এই মামলাটা সাজানো হয়েছে। আর মালিকরা জুরিদের শিখিয়ে দিয়েছে, হ্যাঁ, হুকুম দিয়েছে, আমাদেরকে নৈরাজ্যবাদী হিসেবে দাগিয়ে সেই ধাঁচের রায় দিতে।
ইওর অনার, আপনি এটা জানতেন। আর জানেন, আমি যা বলছি, এটাই সত্য। আপনি বিচারকের চেয়ারে হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থেকে সব কিছু শুনে গিয়েছেন। ঘটনা পরম্পরার বিশ্লেষণ করে আমি আপনার স্মৃতিকে সক্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে আপনাকে বলছি, নিরপেক্ষভাবে দুই পক্ষের দিকে তাকান। আর যুক্তি দিয়ে, স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিষয়টা তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন।