|| নেলসন ম্যাণ্ডেলা || জন্মদিনে স্মরণলেখায় মৃদুল শ্রীমানী

নেলসন ম্যাণ্ডেলা: জন্মদিনে স্মরণলেখা
জোরদার মামলা শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার মামলা। সুবিখ্যাত রিভোনিয়া ট্রায়াল। বিচার হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া শহরে, প্যালেস অফ জাস্টিস এ।
মামলার চিফ প্রসিকিউটর ড. পার্সি ইউটার। তিনি ট্রান্সভালের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রিসাইডিং জজ বা বিচারপতির আসনে ড. কোয়ার্টস ডি ওয়েট।
মামলার এক নম্বর আসামী নেলসন ম্যাণ্ডেলা। ওর আরেকটি নাম রোলিহ্লাহ্লা। জোজা ভাষায় রোলিহ্লাহ্লা শব্দের অর্থ ট্রাবলমেকার, বদমাইশ, শয়তান। দুই নম্বর ওয়াল্টার সিসুলু। লায়োনেল বার্নস্টাইন নামে একজন আছেন। তিনি কমিউনিস্ট দলের লোক। তিনি ছয় নম্বর আসামী। আসামী পক্ষের অ্যাটর্নি অন রেকর্ড ন্যাট লেভি। ইনসট্রাকটিং অ্যাটর্নি জোয়েল জফে। আর লীড কাউন্সেল ব্রাম ফিশার।
মামলা চলল নয় অকটোবর ১৯৬৩ থেকে বারো জুন ১৯৬৪ অবধি।
১৯৬৪র এপ্রিল মাসের কুড়ি তারিখে ডিফেন্স প্রসিডিং শুরু হল। এক নম্বর আসামী নেলসল ম্যাণ্ডেলা ঝাড়া তিনঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। গণতন্ত্র কী, কেন সভ্যতার স্বার্থে গণতন্ত্র দরকার, কেন গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে অপরাধ আখ্যা দেওয়া যায় না। বলবেন না কেন, নেলসন ম্যাণ্ডেলাও যে আইনের ছাত্র। ইউনিভার্সিটি অফ পোর্ট হেয়ার আর ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটারস্যাণ্ড থেকে পড়াশুনা করেছেন তিনি। তবে পড়লে কী হবে, রাজনৈতিক দলের কাজে কর্মে মেতে থেকে পাশ আর করা হয়ে ওঠেনি। জোহানেসবার্গে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতেন। থেম্বু রাজকীয় পরিবারের সন্তান ম্যাণ্ডেলা ১৯৪৩ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন। তখন তিনি বছর পঁচিশের তরতাজা জোয়ান। একসময় কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতিও আকর্ষণ অনুভব করেছেন। মিশেছেন এসএসিপি বা সাউথ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টির পরিমণ্ডলে। তীব্র জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন মাডিবা। ওষ্ঠে কপালে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটা অস্তিত্ব ঝলসে ঝলসে উঠছে। চোখ গোল গোল করে হাঁ করে শুনছেন বিচারপতি। কোনো অভিযুক্ত এমন ওজস্বী সারগর্ভ বক্তৃতা দিতে পারেন, ভাবতেই পারছেন না সেই বিচারপতি। বলতে বলতে বলার ঝোঁকে ম্যাণ্ডেলা একসময় বলেই ফেললেন, তোমরা আমাকে ফাঁসিতেও ঝুলিয়ে দিতে পারো, তবে তাতে গরিব মানুষের মাথা তোলার লড়াই থামবে না।
সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে থামালেন তাঁর পক্ষের আইনজীবী। এ কী করছ, বোলো না, ফাঁসি দেবার কথা বোলো না, পারলে ওরা তো তোমাকে ফাঁসিতেই ঝোলাতে চায়। নিজের থেকে সেই পথ করে দিয়ো না, দিয়ো না।
ম্যাণ্ডেলা। তাঁকে লোকজন মাডিবা বলত। ও আসলে তাঁর গোষ্ঠীপরিচয়। তাঁর গোষ্ঠীর নামটাই মাডিবা। রাজপরিবারের রক্ত গায়ে থাকলে কী হবে, রোলিহ্লাহ্লার বাপ মা ছিলেন নিতান্তই অশিক্ষিত। তবু কী ভাগ্যি, তার মা ভেবেছিলেন ছেলেটাকে স্কুলে পাঠানো ভাল। তাইতেই স্কুলে যাওয়া হল। স্কুলের মাস্টার মশায় নাম রাখলেন নেলসন। ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটারস্যাণ্ডে তিনি একাই কালো ছাত্র ছিলেন। পড়াশুনা ঠিক মতো কমপ্লিট না করেই চললেন জীবিকা খুঁজতে। একটি ল ফার্মে আর্টিকেল ক্লার্কের কাজ ধরলেন। আইনের কাজ শিখে অ্যাটর্নি হয়ে ফিরলেন জোহানেসবার্গে।
বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয় তাঁর। ওই থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু। দু তিনটি কমিউনিস্ট বন্ধুও জুটে গিয়েছিল। চে গেভারার আদর্শ বুকে নিয়ে ১৯৬১ সালে একটা জঙ্গি গোষ্ঠী খুললেন। উমখোনটো উই সিজুই। নিজে হলেন তার চেয়ারম্যান। এজন্য ১৯৬২তে একপ্রস্থ জেলও খেটেছেন।
আবার রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে রিভোনিয়া ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১৯৬৪তে জেলে ঢুকলেন। কাটাতে হবে সাতাশ বছর।
ম্যাণ্ডেলার মুক্তির দাবিতে বাইরে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলেছেন উইনি ম্যাদিকিজেলা। তিনিও উইটওয়াটারস্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বছর পাঁচ ছয় তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে মাডিবার। ১৯৫৮ থেকে তিনি নেলসন ম্যাণ্ডেলার দ্বিতীয় স্ত্রী।
আজ নেলসন ম্যাণ্ডেলা দিবস। নেলসন ম্যাণ্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা।
সাতাশটা বছরের কারাদণ্ড হল ম্যাণ্ডেলার। রবেন আইল্যাণ্ড, পলস মূর, আর ভিক্টর ভার্সটার জেলে ঘুরে ঘুরে সাতাশটা বছর কি করে কেটে গেল।
মাডিবা, হ্যাঁ, লোকজন ভালবেসে নেলসন ম্যাণ্ডেলাকে এই নামেই ডাকত, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হলেন ১৯৯১তে। আর ১৯৯৪ সালে একটি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৯৭ অবধি। রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৯৯ অবধি।
উইনি ম্যাদিকিজেলা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিজানার একটি রাজপরিবারের কন্যা। ১৯৫৮ সালে ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে বিয়ে হয়। ম্যাণ্ডেলা র সাতাশ বছরের কারাজীবনে উইনিই ছিলেন জনগণের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র। এজন্য উইনি কত না মার খেয়েছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন, আটক করা হয়েছে কতবার, নির্বাসিত পর্যন্ত হয়েছেন। লড়তে লড়তে সমর্থকদের কাছে হয়ে উঠেছেন মাদার অফ দ্য নেশন। পার্টির উইমেন্স লিগের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নেলসন ম্যাণ্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। কিন্তু তারপর মাত্র দুই বছরেই স্বামীর সঙ্গে উইনির সম্পর্ক বিষিয়ে উঠল। আটত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের পর ডিভোর্স মামলা শুরু হল। ১৯৯৬তে নেলসন ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় বিচ্ছেদ। ১৯৯৪ থেকে ২০০৩ অবধি উইনি সংসদের সদস্য ছিলেন। ন্যাশনাল একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ অবধি ডেপুটি মন্ত্রী হিসেবে সংস্কৃতি দপ্তর সামলেছিলেন।
২০০৩ সালে উইনির বিরুদ্ধে চুরি ও প্রতারণার অভিযোগ উঠল। এরপর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান ম্যাদিকিজেলা। ২০১৮ র এপ্রিলের ২ তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
ম্যাণ্ডেলা এক বর্ণময় চরিত্র। আদর্শগতভাবে তিনি ছিলেন আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রী। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিগতদিনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেই মোটের উপর চালু রাখেন। অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা রাখতেই আগ্রহী ছিলেন ম্যাণ্ডেলা। তবে ভূমিসংস্কার ও দারিদ্র্য দূরীকরণের মত কিছু কর্মসূচি তিনি নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে লঙ ওয়াক টু ফ্রিডম নামে ৬৩০ পৃষ্ঠা ব্যাপী একটি আত্মজীবনীমূলক পুস্তক প্রকাশ করেন ম্যাণ্ডেলা। সে বই বহু ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৯৫ সালে সে বই অ্যালান প্যাটন পুরস্কারে ভূষিত হয়। তবে সত্যিই তিনি এই বইয়ের রচয়িতা কি না, সে নিয়ে টাইমস ম্যাগাজিন প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। দীর্ঘদিনের সাথি উইনি ম্যাদিকিজেলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর আশি বছরের বৃদ্ধ ম্যাণ্ডেলা গ্রাশা মাচেল এর পাণিগ্রহণ করেন। তবে রাজনৈতিক সঙ্গীর মৃত্যুশয্যায় তাঁকে দেখতে এসেছিলেন উইনি।
ভারত সরকার ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত করেছেন ম্যাণ্ডেলাকে, ১৯৯০ সালে। সেই বছরেই ফেব্রুয়ারিতে তাঁর কারামুক্তি ঘটেছিল। ওর আগেই ১৯৮৮ তে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে শাখারভ পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৯০ তে সোভিয়েত ইউনিয়ন দিলেন লেনিন শান্তি পুরস্কার। ১৯৯২ তে পাকিস্তানের সরকার দিলেন নিশান ই পাকিস্তান, সেদেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান।
আজ নেলসন ম্যাণ্ডেলার জন্মদিন। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মেছিলেন। ২০১৩ সালের ০৫ ডিসেম্বরে পঁচানব্বই বছর বয়সে মৃত্যু।
সাধারণ মানুষের মাপকাঠি দিয়ে অসাধারণদের বোঝা যায় না।