প্রবন্ধে মৃদুল শ্রীমানী

কবির কৈফিয়ত

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় স্বদেশের মুক্তি আন্দোলন আর দেশীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা খুব কঠিনভাবে ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের গৌরবান্বিত করে দেখানোর অভ‍্যাস সব দেশেই ছিল। কিন্তু যে দেশ গুরুবাদী, তারা যেন দলীয় নেতাদের যে কোনো প্রশ্ন ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে ভালবাসেন। নজরুলের সময়ে দেশের মানুষকে শুধুমাত্র সোজাসাপ্টা ভারতবাসী, এইটুকুই লেবেলে চেনানো যায় নি। সারা পৃথিবীতে শ্রমিকের মুক্তি আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছিল রাশিয়া। আর তারই সূত্র ধরে বিশ্বের কোণে কোণে মেহনতী কৃষক মজুর জাগছিল। ভারতে সাধারণ মানুষ ধর্ম ও জাতপাতের বেড়াজালে শতাব্দীর পর শতাব্দী আটকে ছিল। শিক্ষার অধিকার ছিল অভিজাত ও উচ্চবর্ণের করায়ত্ত। মেহনতী মানুষ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পদযুগল থেকে জন্মেছে, এই ধারণা প্রচার করতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চবর্ণের লোকেদের বাধে নি।
দেশের মুক্তি সাধনায় সকলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। অথচ উচ্চবর্ণের মানুষ নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি প্রবল বিরূপতা প্রকাশ করতে অভ‍্যস্ত ছিল। ওরই বিরুদ্ধে কবির হুঁশিয়ারি, “ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান/ ইহাদেরে পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।”
আজ, ১৯৭৬ সাল থেকে আমাদের দেশ সংবিধানের লিপি অনুযায়ী সেক‍্যুলার। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে একসাথে লড়তে গিয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্য গড়ে ওঠা আকাঙ্ক্ষিত ছিল। দুর্ভাগ‍্যের বিষয় যে তা ঘটে নি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তরুণ বয়স থেকেই বুঝতেন, দেশের উন্নতি মানে একই সাথে রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখের উন্নতি। শরৎ সাহিত‍্যে পল্লী সমাজ উপন‍্যাসের আকবর লাঠিয়াল গভীর সম্ভ্রমে রমেশ ঘোষালের দিকে তাকিয়ে ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসের প্রখর হিন্দুত্ববাদী গৌরমোহন মুসলিম মালবাহককে অকারণে নির্যাতিত হতে দেখে কষ্ট পেয়েছেন। দেশের অগ্রণী সাহিত‍্যিকেরা বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের মুক্তি সাধনা মানেই হিন্দু মুসলিমের যৌথ মুক্তিসাধনা। এইখানে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের চিন্তাজগতের শোচনীয় দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেই বহু বার দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছিল।
যে শহরকে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়, সেই কলকাতাতেও ১৯৪৬ সালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। এর নাম দি গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং। বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে শুধু কলকাতা শহরে চার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
১৯৪৬ সালে এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, অল্পদিনের মধ্যেই ভারত স্বাধীনতা পাচ্ছে, অথচ দেশের হিন্দু ও মুসলিম প্রজা পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করতে ব‍্যর্থ হয়েছিল।
১৯৪৭ এ খণ্ডিত স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময়ে নজরুল ইসলাম ভীষণ অসুস্থ, চেতনাহারা। কিন্তু বিশ বছর আগে বাংলা ১৩৩৩ সনে ৬ জ‍্যৈষ্ঠ তারিখে লেখা কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় তিনি খুব স্পষ্ট ভাবে বলেছেন,
“হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন
কাণ্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।”
একজন জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে সাধারণ মানুষের প্রকৃত মুক্তির জন‍্য উন্নত চরিত্রবল গড়ে তোলার দাবি করছেন কবি। দেশের সমস্যার চরিত্র বৈশিষ্ট্য ঠিক কি, তা ব‍্যাখ‍্যা করছেন, একই সাথে কোন্ কোন্ প্রশ্নে একজন নেতা সতর্ক থাকবেন, তাও বুঝিয়ে বলেছেন কবি।
কবিতার একেবারে শেষের দিকে নজরুলের কঠিন চেতাবনী “আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ..”। আজকের রাজনৈতিক দলের কাণ্ডারীগণ জবাব দিন, জাতি বড় না জাত বড়, এ প্রশ্নের আজও সমাধান হয়েছে কি না?
রাজনীতি সচেতন নজরুলের আরেকটি বহুপঠিত কবিতা হল আমার কৈফিয়ৎ। সমকালীন রাজনীতির বাস্তব চেহারাটা চাঁচাছোলাভাবে এই কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে।
দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থপর চিন্তাকাঠামো আজকের দিনে ভারতবাসীকে বহুধাবিভক্ত করে রেখেছে। এই সময়কার সদ‍্যপ্রয়াত কবি লিখেছেন:
“বাসের হাতল কেউ দ্রুত পায়ে ছুঁতে এলে
আগে তাকে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দলে
ভুখা মুখে ভরা গ্রাস তুলে ধরবার আগে
প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দলে
পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয়
তাকে টেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল…” (শঙ্খ ঘোষ, তুমি কোন্ দলে, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ।) এই দুর্ভাগা হতশ্রী সময়ে দলের নির্বাচনী স্বার্থ জাতির স্বার্থ থেকে বহুগুণে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আজ সামান্য আর্থিক সুবিধার জন্য এক রাজনৈতিক দল থেকে অন‍্য দলে যেতে ভারতীয় নেতাদের বাধে না। এইরকম দলীয় নেতাকর্মীদের রুচি, ভাষাভঙ্গি, আচার আচরণ, শব্দ প্রয়োগ সভ‍্য মার্জিত লোকের বিবমিষা উৎপাদন করে। মানুষের পক্ষে যতদূর অধঃপাতে যাওয়া সম্ভব ততদূর নিম্নগামী রুচিকে আয়ত্ত্ব করেছেন ওঁরা। প্রায় এক শতাব্দী আগেই সেকালের একাংশের নেতাদের কাছ থেকে দেখে নজরুলের মনে হয়েছে এই নেতাদের রুচিগত মান যথেষ্ট পরিমাণে নিচু। তাঁদের চিন্তাকাঠামোর দৈন‍্য নজরুলের দৃষ্টি এড়ায় নি। এই পংক্তিটি লক্ষ করুন : “গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে।” নজরুল আরো বলেন, “আমরা তো জানি স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!” ব্রিটিশ চলে যাবার সময়ে কিভাবে দেশমাতৃকার অঙ্গচ্ছেদ হয়ে লক্ষ লক্ষ প্রাণের অকারণ অপচয়, অজস্র মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার মধ‍্য দিয়ে এসেছিল খণ্ডিত বিকৃত স্বাধীনতা, তা দেখার দুর্ভাগ্য থেকে কাজী নজরুল ইসলাম রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন। কেননা ১৯৪১ সালের আগস্টে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেহাবসানের পরে পরেই নজরুলের গুরুতর স্নায়বিক পীড়া দেখা দেয়। তা দুরারোগ্য হয়ে পড়ে। দরিদ্র ভারতবাসীর তরফে তাঁকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপীয় দেশে পাঠিয়েও আরোগ‍্য লাভ হয়নি। চেতনাহারা হয়ে মানসিক স্থবিরতার মধ‍্যে নজরুল জীবন্মৃত হয়ে পড়ে ছিলেন। এক অর্থে নজরুলের সৌভাগ্য যে, আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকার কারণে এই বিকৃত বিসদৃশ স্বাধীনতা তাঁকে দেখতে হয় নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রান্তদর্শীর মতো বলেছিলেন, কালের গতিকে ইংরেজ হয়তো একদিন এদেশ ছেড়ে চলে যাবে….। সে কথা বিখ্যাত হয়েছে। বড় বেদনার সঙ্গে বাস্তবে ফলেও গিয়েছে। ইংরেজ শাসক চলে যাবার পর নতুন যে শাসকেরা আসবে, দুশ্চরিত্রপনা ও ইতরামিতে তারা কোন্ নরকের জীব হবে, সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্বেগ ছিল। আজ দেশ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্বেগের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের জায়গা নেই। কাণ্ডারী হুঁশিয়ার আর আমার কৈফিয়ৎ এই দুটি কবিতাতেই কাজী নজরুল ইসলাম একই ধরনের সতর্ক বাণী প্রকাশ করে আজকের ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট কালে একান্তভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।