সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৪)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস

হে মার্কেট মামলাটি সার্টিওরারি প্রয়োগের প্রশ্নে বিশেষ ভাবে উপযুক্ত ছিল।
প্রথমতঃ সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত, এবং বিশেষতঃ বিচারক জোসেফ ইস্টন গ‍্যারি খুব সচেতনভাবে কে বোমা ছুঁড়েছিল, সেই ব‍্যাপারে কঠোরভাবে অনুসন্ধানে বিরত ছিলেন। আদালত বেশ বুঝতে পেরেছিলেন অভিযুক্ত আটজন শ্রমিকনেতার একজনও বোমার ব‍্যাপারে জড়িত ছিলেন না। অথচ বিচারক মনঃস্থির করে রেখেছিলেন যে এই নেতাদের তিনি কোনোভাবেই বাঁচতে দেবেন না। ওই কারণে বোমা ছোঁড়ার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিতকরণের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কেবল উত্তেজক বক্তৃতা ও কাগজে তীব্র প্রতিবাদী লেখার উপর ভর করে গ‍্যারি সাতজন শ্রমিকনেতৃত্বের জন‍্য প্রাণদণ্ড এবং একজনের জন‍্য পনেরো বছরের কারাদণ্ড মঞ্জুর করেছিলেন।
অথচ গোয়েন্দা পুলিশের চোখে বোমা ছোঁড়ার ব‍্যাপারে তীব্র সন্দেহভাজন ব‍্যক্তি রুডলফ শনাউবেল্টকে মে মাসেই দু দুবার অ্যারেস্ট করেও অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৪ জুন, ১৮৮৬ তারিখে শনাউবেল্ট চিকাগো পুলিশের জেনারেল সুপারিনটেনডেন্ট ফ্রেডারিক এবেরসোল্ড এর হাতে লেখা পরোয়ানা পেয়েও চিকাগো ছেড়ে, এমনকি কাউন্টি ছেড়ে পালাতে পেরেছিল। তাকে ধরে আনার উদ‍্যোগই নেওয়া হয় নি।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মানুষ মতপ্রকাশের সুযোগ পাবে, এটা সাংবিধানিক অধিকার। তাই সংবাদপত্রে কলমচালনা এবং শ্রমিক সমাবেশে বক্তৃতা, এ দুটোর কোনোটাই অসাংবিধানিক নয়।
তাই, বোমা যে ছুঁড়েছিল, তাকে চিহ্নিত করার উদ‍্যোগ না নিয়ে যাঁরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শ্রমিক আন্দোলনের চেষ্টায় যত্নবান ছিলেন, তাঁদের একযোগে ফাঁসির আদেশ অবশ‍্যই সুপ্রিম কোর্টের কাছে সার্টিওরারি হিসেবে বিবেচিত হওয়া সঙ্গত ছিল।
ফাঁসির আগের দিন, ১৮৮৭র নভেম্বরের ১০ তারিখে স‍্যামুয়েল ফিলডন আর মাইকেল শোয়াব এই দুই নৈরাজ্যবাদী নেতা ইলিনয়ের তদানীন্তন গভর্নর রিচার্ড জেমস অগলেসবি (২৫ জুলাই ১৮২৪ – ২৪ এপ্রিল ১৮৯৯) এর কাছে প্রাণভিক্ষা করলেন। অগলেসবি ছিলেন একজন পোড়খাওয়া রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক দলীয় পরিচিতির বিচারে তিনি ছিলেন রিপাবলিকান। প্রথম জীবনে রিচার্ড ছিলেন একজন সৈনিক। ১৮৮৭ তে তিনি তৃতীয়বারের জন‍্য ইলিনয় প্রদেশের গভর্নরের পদে আসীন ছিলেন। এর আগে ১৮৬৫ – ১৮৬৯ সময়কালে প্রথমবারের জন‍্য গভর্নর হন। পরে ১৮৭৩ এ দশদিনের জন‍্য গভর্নরের চেয়ারে ছিলেন। রিচার্ড তাঁর পদাধিকার বলে দুই শ্রমিকনেতা ফিলডন ও শোয়াবের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
ইলিনয় গভর্নর রিচার্ড জেমস অগলেসবি-র তরফে স‍্যামুয়েল ফিলডন ও মাইকেল শোয়াব, এই দুইজন ফাঁসির আসামীকে প্রাণদণ্ডের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবার আদেশটি সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত তথা জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির বিচারকে একটা জোরদার ধাক্কা হিসেবেই দেখা সংগত হবে।
ফিলডন ও শোয়াব এর ফাঁসি মকুব হয়ে যেতে, সাতজন ফাঁসির আসামির মধ‍্যে বাকি রইলেন পাঁচজন। অস্কার নিবির তো পনেরো বছরের কারাদণ্ড ছিল।
এই পাঁচজনের মধ‍্যে লুইস লিঙ ছিলেন অত‍্যন্ত স্বাধীনচেতা। তিনি কোনোভাবেই আদালতের বিচার মেনে ফাঁসির মঞ্চে যেতে রাজি ছিলেন না। লিঙ ছিলেন প্রতিভাবান বোমা বিশেষজ্ঞ। কারান্তরীণ অবস্থায় হাতসাফাই করে তিনি মারণ বোমার মশলা যোগাড় করে ফেলেন। সবার অগোচরে তামাকসেবনের পাইপের আকারে বোমা বানিয়ে ফেললেন। নভেম্বরের দশ তারিখে, ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবার কয়েকটি ঘণ্টা আগে লুইস লিঙ নিজের মুখের মধ্যে নিজের হাতে তৈরি সেই মারণ বোমার বিস্ফোরণ ঘটালেন। বিস্ফোরণের আঘাতে তাঁর মুখের অর্ধেকটা উড়ে গেল। অত‍্যন্ত কষ্ট পেতে পেতে কয়েক ঘণ্টার মধ‍্যে তাঁর প্রাণের প্রদীপ নিভে গেল।
নভেম্বরের এগারো তারিখে সকালে উঠে বলিষ্ঠ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে ফরাসি বিপ্লবের মহান সংগীতে কারাগার উন্মথিত করে ফাঁসির মঞ্চে চললেন হে মার্কেটের মামলায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত চার অপরাজেয় বিপ্লবী। কারাকর্মীরা শ্রদ্ধাবনত চক্ষে চেয়েছিলেন এই চার অকুতোভয় বিপ্লবীর পানে।
জর্জ এঞ্জেল, অ্যাডলফ ফিশার, অ্যালবার্ট পারসনস আর অগাস্ট স্পিজ, এই চার শ্রমিকনেতৃত্বের ফাঁসি হয়ে গেল।
কারান্তরালে রয়ে গেলেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত স‍্যামুয়েল ফিলডন, মাইকেল শোয়াব, আর পনোরো বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত অস্কার নিবি।
সাতটা বছর কেটে গেলে, ১৮৯৩ এর ২৬ জুন তারিখে ইলিনয়ের আরেক গভর্নর হে মার্কেটের দণ্ডিতদের প্রতি আদালতের অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুললেন। জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির বিচারকে একটি প্রবল ধাক্কা দিয়ে ইলিনয় প্রদেশের বিংশতিতম গভর্নর জন পিটার আল্টজেল্ড (৩০ ডিসেম্বর ১৮৪৭ – ১২ মার্চ ১৯০২) ফিলডন, শোয়াব ও নিবি, তিনজনকেই ক্ষমাপ্রদর্শন করে মুক্তি দিলেন।
জন পিটার আল্টজেল্ড ছিলেন একজন প্রগতিশীল জননেতা। তিনি শ্রমিক হিসেবে গায়ে গতরে খেটে রুটি যোগাড় করতে করতেই মিসৌরি প্রদেশে আইনের পাঠ নিয়েছিলেন। তারপর তিনি মিসৌরি প্রদেশের সাভানা এলাকায় সিটি অ্যাটর্নি হিসেবে নিয়োজিত হন। ওই কাজে নিয়োজিত থাকতে থাকতেই তিনি অর্ডিন‍্যান্স কোড নিয়ে বিকল্প চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ করেন ও তা আইনজীবী সমাজের নজরে আনেন। ১৮৭৪ এ তিনি সাভানা কাউন্টির স্টেট অ্যাটর্নি পদে নির্বাচিত হন।
১৮৯৩ তে আল্টজেল্ড ইলিনয়ের বিংশতিতম গভর্নর নির্বাচিত হলেন এবং ১০ জানুয়ারি ১৮৯৩ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৮৯৭, একটানা এই চারটি বছর ইলিনয়ের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৮৯৩ এর জানুয়ারি মাসে গভর্নরের পদে আসীন হয়ে ওই বছরেই জুন মাসে তিনি হে মার্কেট মামলার জীবিত দণ্ডপ্রাপ্তদের সকলকে ক্ষমাপ্রদর্শন করে মুক্তি দিয়ে দিলেন। এর আগে গভর্নর হিসেবে অগলেসবি ফিলডন ও শোয়াবের মৃত‍্যুদণ্ডের আদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেটুকু ওই দুইজনকে অন্ততপক্ষে প্রাণে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু গভর্নর হিসেবে আল্টজেল্ডের সিদ্ধান্ত ছিল বৈপ্লবিক। এই দণ্ডিত ব‍্যক্তিদের ক্ষমাপ্রদর্শন করে তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় ব‍্যক্তিত্ব হয়ে গেলেন। ইতিহাসবিদ ফিলিপ ড্রে বলেছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল যুগের সূর্যোদয়ের সঙ্গে গভর্নর জন পিটার আল্টজেল্ডের নাম সমার্থক হয়ে গিয়েছে।
তিনি নিজের জীবনে কায়িক শ্রমিকের বঞ্চনা ও যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। আর নিজেও একজন জার্মান অভিবাসী হবার কারণে এই অংশের মানুষের প্রতি আমেরিকানদের ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কথা তিনি মর্মে মর্মে জানতেন। তাই উপর আইনের নিষ্ঠাবান ছাত্র ছিলেন বলে জোসেফ ইস্টন গ‍্যারি ও চিকাগো পুলিশ প্রশাসন সমস্ত রকম ন‍্যায়নীতিকে আইনি নিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে পদদলিত করে যেভাবে শ্রমিক নেতৃত্বকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল, তার ত্রুটির জায়গাগুলি তিনি অবগত ছিলেন।
তথাপি উল্লেখ করতেই হচ্ছে, এ শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক বিদ‍্যাবত্তার বিষয় ছিল না। কেননা সুপিরিয়র কুক কাউন্টির হে মার্কেট বিচার ১৮৮৭ তে ইলিনয়ের সুপ্রিম কোর্টে, আর তারপরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টেও গৃহীত হয়েছিল। তার উপরে বিচারক গ‍্যারি তখন ইলিনয় আপিলেট কোর্টের অন‍্যতম বিচারক পদে অধিষ্ঠিত। দণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিক নেতাদের প্রতি অবিচার হয়েছে, অ্যাকাডেমিক পরিসরে এটুকু ধরতে পারলেই তাঁদের ক্ষমাপ্রদর্শন করার বলিষ্ঠতা আল্টজেল্ড দেখাতে পারতেন না। সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি একাত্মতা অনুভব করতেন বলেই ইতিহাসের অমোঘ অঙ্গুলিনির্দেশ আল্টজেল্ড দেখতে পাচ্ছিলেন আর অন্তরের বলিষ্ঠতা তাঁকে রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কর্তব্য কর্মে অবিচল রেখেছিল।
গভর্নর হিসেবে হে মার্কেট মামলায় দণ্ডিতদের ক্ষমাপ্রদর্শনের সিদ্ধান্ত তাঁকে আমেরিকার পুঁজিপতিদের কাছে বিপজ্জনক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পুঁজি তখনো সংবাদমাধ‍্যমকে নিয়ন্ত্রণ করত। চিকাগোর বড় বড় কাগজগুলি আল্টজেল্ডকে নিন্দাবাক‍্যস্রোতে অভিনন্দিত করেছিল। প্রদেশের ব‍্যবসা এবং অর্থনীতির পক্ষে আল্টজেল্ড বিপজ্জনক, এভাবেই বড় কাগজগুলি লিখত। বড় কাগজের মধ‍্যে একমাত্র মাইকেল সি ম‍্যাকডোনাল্ড পরিচালিত চিকাগো গ্লোব কাগজটি তাঁকে সমর্থন করত। এছাড়া শহরতলি ও গ্রামগঞ্জ থেকে বেরোনো অজস্র ছোট ছোট কাগজ আল্টজেল্ডকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। আল্টজেল্ডের শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে গরিব মানুষের আপনজন বলে অভিহিত করতেন।
গভর্নর হিসেবে আল্টজেল্ডের অন‍্যান‍্য উল্লেখযোগ্য কাজ হল কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও শিশুদের কারখানায় নিয়োগ বিষয়ে প্রগতিশীল আইন প্রণয়ন। এছাড়াও ১৮৯৪ তে পুলম‍্যান ধর্মঘটকে সেনাবাহিনী নামিয়ে দমন করার আহ্বানকে তিনি প্রতিহত করেছিলেন। বহু দণ্ডপ্রাপ্ত মানুষকে আল্টজেল্ড ক্ষমাপ্রদর্শনের মাধ‍্যমে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে তাঁর বিপক্ষের লোকেরা নিন্দাবাদ করত।
তবে গরিবের প্রতি একাত্মতাবোধ আর বিশেষ করে হে মার্কেট মামলায় দণ্ডিত দের ক্ষমাপ্রদর্শনের কারণে আল্টজেল্ড পুঁজিপতিদের কাছে শত্রু বনে গিয়েছিলেন। ইলিনয় প্রদেশে পরবর্তী গভর্নর নির্বাচন হয়েছিল ১৮৯৬ এ। পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ‍্যমগুলি নির্বাচনী লড়াইয়ে আল্টজেল্ডের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। দাঁতে নখে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও আল্টজেল্ড পরাজিত হয়েছিলেন।
সুপিরিয়র কুক কাউন্টির এই অবিচারের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রত‍্যাঘাত ছিল মাইকেল শ‍্যাকসের চাকরি ডিসমিস হয়ে যাওয়া। ক‍্যাপ্টেন মাইকেল শ‍্যাকস পুলিশের তরফে হে মার্কেট কাণ্ডের পুলিশী ইনভেস্টিগেশন পরিচালনা করেছিলেন। শ‍্যাকসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি হে মার্কেট মামলায় জাল নথি পেশ করেছিলেন। জাল এভিডেন্স কোর্টে পেশ করার অভিযোগ ওঠে। তাইতে শ‍্যাকসের চাকরিতে ছেদ পড়ে। পরে অনেক কেঁদে ককিয়ে, এর তার হাতে পায়ে ধরে ১৮৯২ তে শ‍্যাকস আবার চাকরিতে পুনর্বহাল হন, তবে তাঁর পুরোনো দাপট আর ফিরে আসেনি।
সুপিরিয়র কুক কাউন্টির অবিচারের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রত‍্যাঘাত ছিল বিচারক জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির আপিল কোর্টের বিচারকের পদ হতে ইলিনয়ের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ডিসমিস হয়ে যাওয়া। যদিও হে মার্কেট দণ্ডপ্রাপ্ত দের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর ১৮৮৮ তে গ‍্যারির পদোন্নতি হয়, তিনি ইলিনয় আপিল কোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন, কিন্তু ১৮৯৭ এর জুন মাসে ইলিনয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিচারক গ‍্যারিকে অপসৃত হতে হয়। অবশ‍্য নিম্ন আদালতের পদে তাঁর পুনর্বাসন হয়। ৩১ অক্টোবর ১৯০৬ অবধি ওই নিম্ন আদালতেই তিনি কাজ করেছেন।

সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত, বিশেষ করে বিচারক জোসেফ ইস্টন গ‍্যারি লড়াকু শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজ সহ সর্বমোট আট বন্দীকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। ওঁদের বিরুদ্ধে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনা তথ‍্যপ্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না জেনে বুঝেই ওঁদের আগুন ঝরানো বক্তৃতাকে সামাজিক স্থিতিশীলতার পক্ষে বিপজ্জনক দেখিয়ে, ফাঁসির আদেশকে সুবিচার হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন বিচারক গ‍্যারি। মতপ্রকাশের ঘটনাকে অপরাধ, এবং সেই ধরনের মতপ্রকাশের জন‍্যই বোমা হামলা হয়েছে, এই বলে হামলাকারী বা হামলাকারীদের চিহ্নিত না করেই তড়িঘড়ি বিপ্লবীদের ফাঁসিতে ঝোলাতে বদ্ধপরিকর ছিল সুপিরিয়র কুক কাউন্টি কোর্ট।
লক্ষ্য করার বিষয় যে বোমা হামলা নয়, দায়িত্ব পালনরত উর্দিধারী পুলিশের প্রাণনাশের অপচেষ্টা নয়, সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালতের লক্ষ্য ছিল ঘটনার সময়ে উপস্থিত থাকুন না থাকুক, এমনকি ঘটনার দিনে অকুস্থলে পদার্পণ করুক না করুক, ছলে বলে কৌশলে যে কোনোভাবে শ্রমিক শ্রেণীর আপোসহীন যোদ্ধাদের নেতৃত্বকে ফাঁসি দিয়ে দাও। কে বোমা ছুঁড়েছিল সে প্রশ্নকে লঘু করে দাও। প্রকৃত হামলাকারীদের খুঁজো না। প্রকৃত হামলাকারীদের পরিচয় সামনে এসে গেলে নেতৃত্বদানকারী শ্রমিকনেতারা ছাড় পেয়ে যাবে। ওদেরকে ছাড়লে চলবে না। এটাকেই বলে কমিটেড জুডিশিয়ারি। আমেরিকার বুকে গণতন্ত্রের নাম জপতে জপতেই পুঁজির অঙ্গুলিহেলনে কমিটেড জুডিশিয়ারি গড়ে উঠেছিল এবং গ‍্যারির এই বিচার অথবা বলা ভাল, বিচারের প্রহসন আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত অবধি টিঁকে গেল।

এখানে একে একে অসমসাহসী যৌবনোদ্ধত বিপ্লবী শ্রমিকনেতাদের বক্তব্য ভাষান্তরিত করে তুলে ধরব। প্রথমে অগ্রণী ব‍্যক্তিত্ব অগাস্ট স্পিজের বক্তব্য। সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালতে জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির সামনে জুরিদের উপস্থিতিতে শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজ এই বক্তব্য রেখেছিলেন।
ইওর অনার, আজ এই আদালতে আমি এক শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে অন‍্য আরেকটি শ্রেণীর প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য রাখছি।
আমি আমার বক্তব্যের সূচনাতেই স্মরণ করি ভেনিসীয় ব‍্যক্তিত্ব দোজ ফাহেরি-কে, আজ থেকে পাঁচশত বৎসর আগে যিনি এই একই রকম পরিস্থিতিতে আদালতকে সম্ভাষণ করে বলেছিলেন মাই ডিফেন্স ইজ় ইওর অ্যাকিউজিশন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আমি যে যুক্তি দেব, আমার বিরুদ্ধে ঠিক সেটাই আপনাদের অভিযোগ।
আমার বিরুদ্ধে আপনাদের তরফে যে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ, আসলে সেটাই আপনাদের ইতিহাস। আমার বিরুদ্ধে মানুষ খুনের অভিযোগ তোলা হয়েছে, অভিযোগ তোলা হয়ে আমি খুনের ঘটনা ঘটাতে সহযোগিতা করেছি। এই অভিযোগের সূত্রে আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। অথচ, আশ্চর্যের বিষয় যে, স্টেট আমার বিরুদ্ধে কোনোরকম সাক্ষ্য প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন নি। এমনকি এটুকুও দেখাতে পারে নি যে কে লোকটা বোমা ছুঁড়েছিল, তার সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে। অথবা, ওই মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করার ব‍্যাপারে আমার কিছুমাত্র ভূমিকা ছিল।
কিন্তু ইওর অনার, স্টেটের অ্যাটর্নি এবং পুলিশ অফিসার বনফিল্ডের সহযোগী টমসন এবং গিলমার এর সাক্ষ‍্যকে আপনারা মহা গুরুত্ব দিলেন।
কিন্তু, আমি যে নরহত‍্যা ঘটিয়েছি, বা, আইনের চোখে আমি হে মার্কেটের নরহত‍্যার জন‍্য দায়ী, আদালতে যদি তেমনটা দেখানোর মতো কোনো সাক্ষ‍্যপ্রমাণ না থাকে, তাহলে তেমন অভিযোগের ভিত্তিতে আমার সাজা এবং ফাঁসির আদেশটা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে, শত্রুতা করে পরিকল্পনা করে আমাকে হত‍্যা করার সামিল। ইতিহাসের পাতা খুলুন, ধর্মীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, অথবা অন‍্য যে কোনো মানুষের প্রাণদণ্ড, বিচারপতির পোশাক পরে বিচারের নামে নরহত‍্যার অনেক বীভৎস নিদর্শন ইতিহাসে রয়েছে। ইতিহাসে এমন নজির আছে যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ব‍্যক্তিবর্গ সরল বিশ্বাসে, সাদাসিধে মনে, ধরে নিয়েছে যে যার বা যাদের তারা প্রাণদণ্ড দিচ্ছে, তারা প্রকৃতই দোষী ।
কিন্তু এই হে মার্কেট মামলায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের পক্ষে তেমন সরল বিশ্বাসে প্রাণদণ্ড দেবার ছুতোটুকু নেই। ন‍্যায়নীতিকে উচ্চে তুলে ধরার ভাবমূর্তির আড়ালে নিজের খুনিয়া ধান্দা লুকানোর সুবিধেটুকু নেই।
কেন তা নেই? কেননা, তারা নিজেরাই আমাদের দোষী প্রমাণ করার স্বার্থে বেশিরভাগ জাল তথ‍্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করেছে। আমাদের ফাঁসাতে আদালতের সামনে তথ‍্যপ্রমাণ দেবার নামে রীতিমতো জালিয়াতি করেছে। আর কী করেছে, বেছে বেছে তেমন সব জুরি ঠিক করেছে যারা আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাবে বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। এই আদালতের সম্মুখে, এবং এখানে আর যাঁরা উপস্থিত রয়েছেন, সেই জনতাকে স্টেট হিসাবে গণ‍্য করে, তাঁদের সম্মুখে আমি আমি অভিযোগ করছি, এই স্টেটের অ্যাটর্নি আর পুলিশ অফিসার বনফিল্ড আমাদের খুন করার জঘন্যতম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমি একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলব, যা থেকে বোঝা যাবে আমার এই অভিযোগ একটি জ্বলন্ত সত‍্য।
এখানে একে একে অসমসাহসী যৌবনোদ্ধত বিপ্লবী শ্রমিকনেতাদের বক্তব্য ভাষান্তরিত করে তুলে ধরব। প্রথমে অগ্রণী ব‍্যক্তিত্ব অগাস্ট স্পিজের বক্তব্য। সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালতে জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির সামনে জুরিদের উপস্থিতিতে শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজ এই বক্তব্য রেখেছিলেন।
ইওর অনার, আজ এই আদালতে আমি এক শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে অন‍্য আরেকটি শ্রেণীর প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য রাখছি।
আমি আমার বক্তব্যের সূচনাতেই স্মরণ করি ভেনিসীয় ব‍্যক্তিত্ব দোজ ফাহেরি-কে, আজ থেকে পাঁচশত বৎসর আগে যিনি এই একই রকম পরিস্থিতিতে আদালতকে সম্ভাষণ করে বলেছিলেন মাই ডিফেন্স ইজ় ইওর অ্যাকিউজিশন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আমি যে যুক্তি দেব, আমার বিরুদ্ধে ঠিক সেটাই আপনাদের অভিযোগ।
আমার বিরুদ্ধে আপনাদের তরফে যে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ, আসলে সেটাই আপনাদের ইতিহাস। আমার বিরুদ্ধে মানুষ খুনের অভিযোগ তোলা হয়েছে, অভিযোগ তোলা হয়ে আমি খুনের ঘটনা ঘটাতে সহযোগিতা করেছি। এই অভিযোগের সূত্রে আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। অথচ, আশ্চর্যের বিষয় যে, স্টেট আমার বিরুদ্ধে কোনোরকম সাক্ষ্য প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন নি। এমনকি এটুকুও দেখাতে পারে নি যে কে লোকটা বোমা ছুঁড়েছিল, তার সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে। অথবা, ওই মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করার ব‍্যাপারে আমার কিছুমাত্র ভূমিকা ছিল।
কিন্তু ইওর অনার, স্টেটের অ্যাটর্নি এবং পুলিশ অফিসার বনফিল্ডের সহযোগী টমসন এবং গিলমার এর সাক্ষ‍্যকে আপনারা মহা গুরুত্ব দিলেন।
কিন্তু, আমি যে নরহত‍্যা ঘটিয়েছি, বা, আইনের চোখে আমি হে মার্কেটের নরহত‍্যার জন‍্য দায়ী, আদালতে যদি তেমনটা দেখানোর মতো কোনো সাক্ষ‍্যপ্রমাণ না থাকে, তাহলে তেমন অভিযোগের ভিত্তিতে আমার সাজা এবং ফাঁসির আদেশটা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে, শত্রুতা করে পরিকল্পনা করে আমাকে হত‍্যা করার সামিল। ইতিহাসের পাতা খুলুন, ধর্মীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, অথবা অন‍্য যে কোনো মানুষের প্রাণদণ্ড, বিচারপতির পোশাক পরে বিচারের নামে নরহত‍্যার অনেক বীভৎস নিদর্শন ইতিহাসে রয়েছে। ইতিহাসে এমন নজির আছে যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ব‍্যক্তিবর্গ সরল বিশ্বাসে, সাদাসিধে মনে, ধরে নিয়েছে যে যার বা যাদের তারা প্রাণদণ্ড দিচ্ছে, তারা প্রকৃতই দোষী ।
কিন্তু এই হে মার্কেট মামলায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের পক্ষে তেমন সরল বিশ্বাসে প্রাণদণ্ড দেবার ছুতোটুকু নেই। ন‍্যায়নীতিকে উচ্চে তুলে ধরার ভাবমূর্তির আড়ালে নিজের খুনিয়া ধান্দা লুকানোর সুবিধেটুকু নেই।
কেন তা নেই? কেননা, তারা নিজেরাই আমাদের দোষী প্রমাণ করার স্বার্থে বেশিরভাগ জাল তথ‍্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করেছে। আমাদের ফাঁসাতে আদালতের সামনে তথ‍্যপ্রমাণ দেবার নামে রীতিমতো জালিয়াতি করেছে। আর কী করেছে, বেছে বেছে তেমন সব জুরি ঠিক করেছে যারা আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাবে বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। এই আদালতের সম্মুখে, এবং এখানে আর যাঁরা উপস্থিত রয়েছেন, সেই জনতাকে স্টেট হিসাবে গণ‍্য করে, তাঁদের সম্মুখে আমি আমি অভিযোগ করছি, এই স্টেটের অ্যাটর্নি আর পুলিশ অফিসার বনফিল্ড আমাদের খুন করার জঘন্যতম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমি একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলব, যা থেকে বোঝা যাবে আমার এই অভিযোগ একটি জ্বলন্ত সত‍্য।

হে মার্কেট মামলাটি সার্টিওরারি প্রয়োগের প্রশ্নে বিশেষ ভাবে উপযুক্ত ছিল।
প্রথমতঃ সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত, এবং বিশেষতঃ বিচারক জোসেফ ইস্টন গ‍্যারি খুব সচেতনভাবে কে বোমা ছুঁড়েছিল, সেই ব‍্যাপারে কঠোরভাবে অনুসন্ধানে বিরত ছিলেন। আদালত বেশ বুঝতে পেরেছিলেন অভিযুক্ত আটজন শ্রমিকনেতার একজনও বোমার ব‍্যাপারে জড়িত ছিলেন না। অথচ বিচারক মনঃস্থির করে রেখেছিলেন যে এই নেতাদের তিনি কোনোভাবেই বাঁচতে দেবেন না। ওই কারণে বোমা ছোঁড়ার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিতকরণের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কেবল উত্তেজক বক্তৃতা ও কাগজে তীব্র প্রতিবাদী লেখার উপর ভর করে গ‍্যারি সাতজন শ্রমিকনেতৃত্বের জন‍্য প্রাণদণ্ড এবং একজনের জন‍্য পনেরো বছরের কারাদণ্ড মঞ্জুর করেছিলেন।
অথচ গোয়েন্দা পুলিশের চোখে বোমা ছোঁড়ার ব‍্যাপারে তীব্র সন্দেহভাজন ব‍্যক্তি রুডলফ শনাউবেল্টকে মে মাসেই দু দুবার অ্যারেস্ট করেও অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৪ জুন, ১৮৮৬ তারিখে শনাউবেল্ট চিকাগো পুলিশের জেনারেল সুপারিনটেনডেন্ট ফ্রেডারিক এবেরসোল্ড এর হাতে লেখা পরোয়ানা পেয়েও চিকাগো ছেড়ে, এমনকি কাউন্টি ছেড়ে পালাতে পেরেছিল। তাকে ধরে আনার উদ‍্যোগই নেওয়া হয় নি।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মানুষ মতপ্রকাশের সুযোগ পাবে, এটা সাংবিধানিক অধিকার। তাই সংবাদপত্রে কলমচালনা এবং শ্রমিক সমাবেশে বক্তৃতা, এ দুটোর কোনোটাই অসাংবিধানিক নয়।
তাই, বোমা যে ছুঁড়েছিল, তাকে চিহ্নিত করার উদ‍্যোগ না নিয়ে যাঁরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শ্রমিক আন্দোলনের চেষ্টায় যত্নবান ছিলেন, তাঁদের একযোগে ফাঁসির আদেশ অবশ‍্যই সুপ্রিম কোর্টের কাছে সার্টিওরারি হিসেবে বিবেচিত হওয়া সঙ্গত ছিল।
ফাঁসির আগের দিন, ১৮৮৭র নভেম্বরের ১০ তারিখে স‍্যামুয়েল ফিলডন আর মাইকেল শোয়াব এই দুই নৈরাজ্যবাদী নেতা ইলিনয়ের তদানীন্তন গভর্নর রিচার্ড জেমস অগলেসবি (২৫ জুলাই ১৮২৪ – ২৪ এপ্রিল ১৮৯৯) এর কাছে প্রাণভিক্ষা করলেন। অগলেসবি ছিলেন একজন পোড়খাওয়া রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক দলীয় পরিচিতির বিচারে তিনি ছিলেন রিপাবলিকান। প্রথম জীবনে রিচার্ড ছিলেন একজন সৈনিক। ১৮৮৭ তে তিনি তৃতীয়বারের জন‍্য ইলিনয় প্রদেশের গভর্নরের পদে আসীন ছিলেন। এর আগে ১৮৬৫ – ১৮৬৯ সময়কালে প্রথমবারের জন‍্য গভর্নর হন। পরে ১৮৭৩ এ দশদিনের জন‍্য গভর্নরের চেয়ারে ছিলেন। রিচার্ড তাঁর পদাধিকার বলে দুই শ্রমিকনেতা ফিলডন ও শোয়াবের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
ইলিনয় গভর্নর রিচার্ড জেমস অগলেসবি-র তরফে স‍্যামুয়েল ফিলডন ও মাইকেল শোয়াব, এই দুইজন ফাঁসির আসামীকে প্রাণদণ্ডের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবার আদেশটি সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত তথা জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির বিচারকে একটা জোরদার ধাক্কা হিসেবেই দেখা সংগত হবে।
ফিলডন ও শোয়াব এর ফাঁসি মকুব হয়ে যেতে, সাতজন ফাঁসির আসামির মধ‍্যে বাকি রইলেন পাঁচজন। অস্কার নিবির তো পনেরো বছরের কারাদণ্ড ছিল।
এই পাঁচজনের মধ‍্যে লুইস লিঙ ছিলেন অত‍্যন্ত স্বাধীনচেতা। তিনি কোনোভাবেই আদালতের বিচার মেনে ফাঁসির মঞ্চে যেতে রাজি ছিলেন না। লিঙ ছিলেন প্রতিভাবান বোমা বিশেষজ্ঞ। কারান্তরীণ অবস্থায় হাতসাফাই করে তিনি মারণ বোমার মশলা যোগাড় করে ফেলেন। সবার অগোচরে তামাকসেবনের পাইপের আকারে বোমা বানিয়ে ফেললেন। নভেম্বরের দশ তারিখে, ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবার কয়েকটি ঘণ্টা আগে লুইস লিঙ নিজের মুখের মধ্যে নিজের হাতে তৈরি সেই মারণ বোমার বিস্ফোরণ ঘটালেন। বিস্ফোরণের আঘাতে তাঁর মুখের অর্ধেকটা উড়ে গেল। অত‍্যন্ত কষ্ট পেতে পেতে কয়েক ঘণ্টার মধ‍্যে তাঁর প্রাণের প্রদীপ নিভে গেল।
নভেম্বরের এগারো তারিখে সকালে উঠে বলিষ্ঠ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে ফরাসি বিপ্লবের মহান সংগীতে কারাগার উন্মথিত করে ফাঁসির মঞ্চে চললেন হে মার্কেটের মামলায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত চার অপরাজেয় বিপ্লবী। কারাকর্মীরা শ্রদ্ধাবনত চক্ষে চেয়েছিলেন এই চার অকুতোভয় বিপ্লবীর পানে।
জর্জ এঞ্জেল, অ্যাডলফ ফিশার, অ্যালবার্ট পারসনস আর অগাস্ট স্পিজ, এই চার শ্রমিকনেতৃত্বের ফাঁসি হয়ে গেল।
কারান্তরালে রয়ে গেলেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত স‍্যামুয়েল ফিলডন, মাইকেল শোয়াব, আর পনোরো বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত অস্কার নিবি।
সাতটা বছর কেটে গেলে, ১৮৯৩ এর ২৬ জুন তারিখে ইলিনয়ের আরেক গভর্নর হে মার্কেটের দণ্ডিতদের প্রতি আদালতের অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুললেন। জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির বিচারকে একটি প্রবল ধাক্কা দিয়ে ইলিনয় প্রদেশের বিংশতিতম গভর্নর জন পিটার আল্টজেল্ড (৩০ ডিসেম্বর ১৮৪৭ – ১২ মার্চ ১৯০২) ফিলডন, শোয়াব ও নিবি, তিনজনকেই ক্ষমাপ্রদর্শন করে মুক্তি দিলেন।
জন পিটার আল্টজেল্ড ছিলেন একজন প্রগতিশীল জননেতা। তিনি শ্রমিক হিসেবে গায়ে গতরে খেটে রুটি যোগাড় করতে করতেই মিসৌরি প্রদেশে আইনের পাঠ নিয়েছিলেন। তারপর তিনি মিসৌরি প্রদেশের সাভানা এলাকায় সিটি অ্যাটর্নি হিসেবে নিয়োজিত হন। ওই কাজে নিয়োজিত থাকতে থাকতেই তিনি অর্ডিন‍্যান্স কোড নিয়ে বিকল্প চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ করেন ও তা আইনজীবী সমাজের নজরে আনেন। ১৮৭৪ এ তিনি সাভানা কাউন্টির স্টেট অ্যাটর্নি পদে নির্বাচিত হন।
১৮৯৩ তে আল্টজেল্ড ইলিনয়ের বিংশতিতম গভর্নর নির্বাচিত হলেন এবং ১০ জানুয়ারি ১৮৯৩ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৮৯৭, একটানা এই চারটি বছর ইলিনয়ের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৮৯৩ এর জানুয়ারি মাসে গভর্নরের পদে আসীন হয়ে ওই বছরেই জুন মাসে তিনি হে মার্কেট মামলার জীবিত দণ্ডপ্রাপ্তদের সকলকে ক্ষমাপ্রদর্শন করে মুক্তি দিয়ে দিলেন। এর আগে গভর্নর হিসেবে অগলেসবি ফিলডন ও শোয়াবের মৃত‍্যুদণ্ডের আদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেটুকু ওই দুইজনকে অন্ততপক্ষে প্রাণে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু গভর্নর হিসেবে আল্টজেল্ডের সিদ্ধান্ত ছিল বৈপ্লবিক। এই দণ্ডিত ব‍্যক্তিদের ক্ষমাপ্রদর্শন করে তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় ব‍্যক্তিত্ব হয়ে গেলেন। ইতিহাসবিদ ফিলিপ ড্রে বলেছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল যুগের সূর্যোদয়ের সঙ্গে গভর্নর জন পিটার আল্টজেল্ডের নাম সমার্থক হয়ে গিয়েছে।
তিনি নিজের জীবনে কায়িক শ্রমিকের বঞ্চনা ও যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। আর নিজেও একজন জার্মান অভিবাসী হবার কারণে এই অংশের মানুষের প্রতি আমেরিকানদের ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কথা তিনি মর্মে মর্মে জানতেন। তাই উপর আইনের নিষ্ঠাবান ছাত্র ছিলেন বলে জোসেফ ইস্টন গ‍্যারি ও চিকাগো পুলিশ প্রশাসন সমস্ত রকম ন‍্যায়নীতিকে আইনি নিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে পদদলিত করে যেভাবে শ্রমিক নেতৃত্বকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল, তার ত্রুটির জায়গাগুলি তিনি অবগত ছিলেন।
তথাপি উল্লেখ করতেই হচ্ছে, এ শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক বিদ‍্যাবত্তার বিষয় ছিল না। কেননা সুপিরিয়র কুক কাউন্টির হে মার্কেট বিচার ১৮৮৭ তে ইলিনয়ের সুপ্রিম কোর্টে, আর তারপরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টেও গৃহীত হয়েছিল। তার উপরে বিচারক গ‍্যারি তখন ইলিনয় আপিলেট কোর্টের অন‍্যতম বিচারক পদে অধিষ্ঠিত। দণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিক নেতাদের প্রতি অবিচার হয়েছে, অ্যাকাডেমিক পরিসরে এটুকু ধরতে পারলেই তাঁদের ক্ষমাপ্রদর্শন করার বলিষ্ঠতা আল্টজেল্ড দেখাতে পারতেন না। সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি একাত্মতা অনুভব করতেন বলেই ইতিহাসের অমোঘ অঙ্গুলিনির্দেশ আল্টজেল্ড দেখতে পাচ্ছিলেন আর অন্তরের বলিষ্ঠতা তাঁকে রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কর্তব্য কর্মে অবিচল রেখেছিল।
গভর্নর হিসেবে হে মার্কেট মামলায় দণ্ডিতদের ক্ষমাপ্রদর্শনের সিদ্ধান্ত তাঁকে আমেরিকার পুঁজিপতিদের কাছে বিপজ্জনক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পুঁজি তখনো সংবাদমাধ‍্যমকে নিয়ন্ত্রণ করত। চিকাগোর বড় বড় কাগজগুলি আল্টজেল্ডকে নিন্দাবাক‍্যস্রোতে অভিনন্দিত করেছিল। প্রদেশের ব‍্যবসা এবং অর্থনীতির পক্ষে আল্টজেল্ড বিপজ্জনক, এভাবেই বড় কাগজগুলি লিখত। বড় কাগজের মধ‍্যে একমাত্র মাইকেল সি ম‍্যাকডোনাল্ড পরিচালিত চিকাগো গ্লোব কাগজটি তাঁকে সমর্থন করত। এছাড়া শহরতলি ও গ্রামগঞ্জ থেকে বেরোনো অজস্র ছোট ছোট কাগজ আল্টজেল্ডকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। আল্টজেল্ডের শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে গরিব মানুষের আপনজন বলে অভিহিত করতেন।
গভর্নর হিসেবে আল্টজেল্ডের অন‍্যান‍্য উল্লেখযোগ্য কাজ হল কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও শিশুদের কারখানায় নিয়োগ বিষয়ে প্রগতিশীল আইন প্রণয়ন। এছাড়াও ১৮৯৪ তে পুলম‍্যান ধর্মঘটকে সেনাবাহিনী নামিয়ে দমন করার আহ্বানকে তিনি প্রতিহত করেছিলেন। বহু দণ্ডপ্রাপ্ত মানুষকে আল্টজেল্ড ক্ষমাপ্রদর্শনের মাধ‍্যমে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে তাঁর বিপক্ষের লোকেরা নিন্দাবাদ করত।
তবে গরিবের প্রতি একাত্মতাবোধ আর বিশেষ করে হে মার্কেট মামলায় দণ্ডিত দের ক্ষমাপ্রদর্শনের কারণে আল্টজেল্ড পুঁজিপতিদের কাছে শত্রু বনে গিয়েছিলেন। ইলিনয় প্রদেশে পরবর্তী গভর্নর নির্বাচন হয়েছিল ১৮৯৬ এ। পুঁজিনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ‍্যমগুলি নির্বাচনী লড়াইয়ে আল্টজেল্ডের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। দাঁতে নখে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও আল্টজেল্ড পরাজিত হয়েছিলেন।
সুপিরিয়র কুক কাউন্টির এই অবিচারের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রত‍্যাঘাত ছিল মাইকেল শ‍্যাকসের চাকরি ডিসমিস হয়ে যাওয়া। ক‍্যাপ্টেন মাইকেল শ‍্যাকস পুলিশের তরফে হে মার্কেট কাণ্ডের পুলিশী ইনভেস্টিগেশন পরিচালনা করেছিলেন। শ‍্যাকসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি হে মার্কেট মামলায় জাল নথি পেশ করেছিলেন। জাল এভিডেন্স কোর্টে পেশ করার অভিযোগ ওঠে। তাইতে শ‍্যাকসের চাকরিতে ছেদ পড়ে। পরে অনেক কেঁদে ককিয়ে, এর তার হাতে পায়ে ধরে ১৮৯২ তে শ‍্যাকস আবার চাকরিতে পুনর্বহাল হন, তবে তাঁর পুরোনো দাপট আর ফিরে আসেনি।
সুপিরিয়র কুক কাউন্টির অবিচারের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রত‍্যাঘাত ছিল বিচারক জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির আপিল কোর্টের বিচারকের পদ হতে ইলিনয়ের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ডিসমিস হয়ে যাওয়া। যদিও হে মার্কেট দণ্ডপ্রাপ্ত দের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর ১৮৮৮ তে গ‍্যারির পদোন্নতি হয়, তিনি ইলিনয় আপিল কোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন, কিন্তু ১৮৯৭ এর জুন মাসে ইলিনয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিচারক গ‍্যারিকে অপসৃত হতে হয়। অবশ‍্য নিম্ন আদালতের পদে তাঁর পুনর্বাসন হয়। ৩১ অক্টোবর ১৯০৬ অবধি ওই নিম্ন আদালতেই তিনি কাজ করেছেন।

সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত, বিশেষ করে বিচারক জোসেফ ইস্টন গ‍্যারি লড়াকু শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজ সহ সর্বমোট আট বন্দীকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। ওঁদের বিরুদ্ধে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনা তথ‍্যপ্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না জেনে বুঝেই ওঁদের আগুন ঝরানো বক্তৃতাকে সামাজিক স্থিতিশীলতার পক্ষে বিপজ্জনক দেখিয়ে, ফাঁসির আদেশকে সুবিচার হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন বিচারক গ‍্যারি। মতপ্রকাশের ঘটনাকে অপরাধ, এবং সেই ধরনের মতপ্রকাশের জন‍্যই বোমা হামলা হয়েছে, এই বলে হামলাকারী বা হামলাকারীদের চিহ্নিত না করেই তড়িঘড়ি বিপ্লবীদের ফাঁসিতে ঝোলাতে বদ্ধপরিকর ছিল সুপিরিয়র কুক কাউন্টি কোর্ট।
লক্ষ্য করার বিষয় যে বোমা হামলা নয়, দায়িত্ব পালনরত উর্দিধারী পুলিশের প্রাণনাশের অপচেষ্টা নয়, সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালতের লক্ষ্য ছিল ঘটনার সময়ে উপস্থিত থাকুন না থাকুক, এমনকি ঘটনার দিনে অকুস্থলে পদার্পণ করুক না করুক, ছলে বলে কৌশলে যে কোনোভাবে শ্রমিক শ্রেণীর আপোসহীন যোদ্ধাদের নেতৃত্বকে ফাঁসি দিয়ে দাও। কে বোমা ছুঁড়েছিল সে প্রশ্নকে লঘু করে দাও। প্রকৃত হামলাকারীদের খুঁজো না। প্রকৃত হামলাকারীদের পরিচয় সামনে এসে গেলে নেতৃত্বদানকারী শ্রমিকনেতারা ছাড় পেয়ে যাবে। ওদেরকে ছাড়লে চলবে না। এটাকেই বলে কমিটেড জুডিশিয়ারি। আমেরিকার বুকে গণতন্ত্রের নাম জপতে জপতেই পুঁজির অঙ্গুলিহেলনে কমিটেড জুডিশিয়ারি গড়ে উঠেছিল এবং গ‍্যারির এই বিচার অথবা বলা ভাল, বিচারের প্রহসন আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত অবধি টিঁকে গেল।

এখানে একে একে অসমসাহসী যৌবনোদ্ধত বিপ্লবী শ্রমিকনেতাদের বক্তব্য ভাষান্তরিত করে তুলে ধরব। প্রথমে অগ্রণী ব‍্যক্তিত্ব অগাস্ট স্পিজের বক্তব্য। সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালতে জোসেফ ইস্টন গ‍্যারির সামনে জুরিদের উপস্থিতিতে শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজ এই বক্তব্য রেখেছিলেন।
ইওর অনার, আজ এই আদালতে আমি এক শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে অন‍্য আরেকটি শ্রেণীর প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য রাখছি।
আমি আমার বক্তব্যের সূচনাতেই স্মরণ করি ভেনিসীয় ব‍্যক্তিত্ব দোজ ফাহেরি-কে, আজ থেকে পাঁচশত বৎসর আগে যিনি এই একই রকম পরিস্থিতিতে আদালতকে সম্ভাষণ করে বলেছিলেন মাই ডিফেন্স ইজ় ইওর অ্যাকিউজিশন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আমি যে যুক্তি দেব, আমার বিরুদ্ধে ঠিক সেটাই আপনাদের অভিযোগ।
আমার বিরুদ্ধে আপনাদের তরফে যে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ, আসলে সেটাই আপনাদের ইতিহাস। আমার বিরুদ্ধে মানুষ খুনের অভিযোগ তোলা হয়েছে, অভিযোগ তোলা হয়ে আমি খুনের ঘটনা ঘটাতে সহযোগিতা করেছি। এই অভিযোগের সূত্রে আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। অথচ, আশ্চর্যের বিষয় যে, স্টেট আমার বিরুদ্ধে কোনোরকম সাক্ষ্য প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন নি। এমনকি এটুকুও দেখাতে পারে নি যে কে লোকটা বোমা ছুঁড়েছিল, তার সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে। অথবা, ওই মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করার ব‍্যাপারে আমার কিছুমাত্র ভূমিকা ছিল।
কিন্তু ইওর অনার, স্টেটের অ্যাটর্নি এবং পুলিশ অফিসার বনফিল্ডের সহযোগী টমসন এবং গিলমার এর সাক্ষ‍্যকে আপনারা মহা গুরুত্ব দিলেন।
কিন্তু, আমি যে নরহত‍্যা ঘটিয়েছি, বা, আইনের চোখে আমি হে মার্কেটের নরহত‍্যার জন‍্য দায়ী, আদালতে যদি তেমনটা দেখানোর মতো কোনো সাক্ষ‍্যপ্রমাণ না থাকে, তাহলে তেমন অভিযোগের ভিত্তিতে আমার সাজা এবং ফাঁসির আদেশটা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে, শত্রুতা করে পরিকল্পনা করে আমাকে হত‍্যা করার সামিল। ইতিহাসের পাতা খুলুন, ধর্মীয় ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, অথবা অন‍্য যে কোনো মানুষের প্রাণদণ্ড, বিচারপতির পোশাক পরে বিচারের নামে নরহত‍্যার অনেক বীভৎস নিদর্শন ইতিহাসে রয়েছে। ইতিহাসে এমন নজির আছে যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ব‍্যক্তিবর্গ সরল বিশ্বাসে, সাদাসিধে মনে, ধরে নিয়েছে যে যার বা যাদের তারা প্রাণদণ্ড দিচ্ছে, তারা প্রকৃতই দোষী ।
কিন্তু এই হে মার্কেট মামলায় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের পক্ষে তেমন সরল বিশ্বাসে প্রাণদণ্ড দেবার ছুতোটুকু নেই। ন‍্যায়নীতিকে উচ্চে তুলে ধরার ভাবমূর্তির আড়ালে নিজের খুনিয়া ধান্দা লুকানোর সুবিধেটুকু নেই।
কেন তা নেই? কেননা, তারা নিজেরাই আমাদের দোষী প্রমাণ করার স্বার্থে বেশিরভাগ জাল তথ‍্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করেছে। আমাদের ফাঁসাতে আদালতের সামনে তথ‍্যপ্রমাণ দেবার নামে রীতিমতো জালিয়াতি করেছে। আর কী করেছে, বেছে বেছে তেমন সব জুরি ঠিক করেছে যারা আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাবে বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। এই আদালতের সম্মুখে, এবং এখানে আর যাঁরা উপস্থিত রয়েছেন, সেই জনতাকে স্টেট হিসাবে গণ‍্য করে, তাঁদের সম্মুখে আমি আমি অভিযোগ করছি, এই স্টেটের অ্যাটর্নি আর পুলিশ অফিসার বনফিল্ড আমাদের খুন করার জঘন্যতম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমি একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলব, যা থেকে বোঝা যাবে আমার এই অভিযোগ একটি জ্বলন্ত সত‍্য।

এই মাননীয়গণ লেগনার সম্পর্কে আদ‍্যোপান্ত অবগত ছিলেন। তাঁরা জানতেন এই লোকটাকে কাঠগড়ায় সাক্ষ্য দিতে বললে আদালতের সামনে টমসন আর গিলমারের সমস্ত বানানো গপ্পো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে। তার সাক্ষ‍্যের সবটুকুই যে ফক্কিকারি, তা আর কারো বুঝতে বাকি থাকবে না। লেগনারের নামটা সরকার পক্ষের সাক্ষী হিসেবে ছিল, কিন্তু কায়দা কৌশল করে তাকে আদালতে সাক্ষী হিসেবে ডেকে পাঠানো হল না। ধর্মাবতার, আরো শুনে রাখুন, এই লেগনার তার অনেক বন্ধু বান্ধবকে বলেছে যে পুলিশ তাকে শহর ছেড়ে দূরে কোথাও গা ঢাকা দেবার জন্য পাঁচশ ডলার অফার করেছে, আর শাসিয়েছে যে সে যদি এই চিকাগোয় থাকে, আর কোর্টে আমাদের তরফে সাক্ষী হিসেবে আসার চেষ্টা করে তো তার পিণ্ডি চটকানো হবে। লেগনার‌ও পুলিশকে পাল্টা বলে দিয়েছে, তোমরা লেগনারকে অমন ভাল ছেলে পাও নি যে পয়সা ফেলে তাকে কিনতে পারবে, আর তার এমন ভয়ডর‌ও নেই যে সে পুলিশের কথায় উঠবে বসবে। সে হেঁকে বলে দিয়েছে যে সে পুলিশের নোংরা খেলার মধ‍্যে নেই। আর তাই আমরা যখন লেগনারকে সাক্ষী হিসেবে দাবি করলাম, তখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। মিস্টার গ্রিনেল বললেন, আর মিস্টার গ্রিনেল তো একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব‍্যক্তিত্ব, তো গ্রিনেল মহাশয় বললেন যে, তিনি স্বয়ং লেগনারের খোঁজ খবর করেছিলেন, কিন্তু তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

তিন সপ্তাহ পরে আমি জানতে পারলাম চিকাগোর ল অ্যাণ্ড অর্ডারের দুই মহান ধ্বজাধারী, চিকাগো পুলিশের দুইজন মহান ডিটেকটিভ মহোদয় ওই লেগনার নামে তরুণটিকে কিডন‍্যাপ করে নিউ ইয়র্কের বাফ‍্যালো এলাকায় নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছেন। কিন্তু কেন এই মিস্টার গ্রিনেল, আর তার মালিকপক্ষ এই সিটিজেনস অ্যাসোসিয়েশন, এমন একটা কাজ করলেন, তার জবাব দিন! এই সমস্ত খুনে বদমাশদের জনতার আদালতে বিচার হোক!
না, আমি পুনর্বার ঘোষণা করছি যে প্রসিকিউশন এটা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি যে আইনতঃ আমরা অপরাধী। তাঁরা কিছু লোকের সাক্ষ্য কিনতে পেরেছেন, আর কিছুটা হাবিজাবি জোড়াতালি মেরে বলাতে পেরেছেন বলেই এই ট্রায়ালটা সত‍্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তা বলা যায় না। এই ট্রায়ালটা কোনোভাবেই সত‍্যের কাছে ঘেঁষতে পর্যন্ত পারেনি।
আইনের বিধান মেনে, নিরঙ্কুশভাবে সত‍্যপ্রতিষ্ঠা না করে, বিচারের নামে আমাদেরকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবার একটাই অর্থ, অভিযোগকারী নিজেই বিচারকের আসনে বসে পড়েছে। পয়সা দিয়ে নিয়োগ করা ভিজিল‍্যান্স কমিটি বিচারের বাণী আওড়াচ্ছে।
আমি কম্বুকণ্ঠে বলছি যে আপনারা নিজেদেরকে ল অ্যাণ্ড অর্ডারের রক্ষাকর্তা বলতে বলতেই, ন‍্যায়নীতির মহান পূজারী হিসেবে ঢক্কানিনাদ করতে করতেই আইনভঙ্গকারী হয়েছেন। আজ আপনারাই যথার্থ এবং একমাত্র আইনভঙ্গকারী, এবং এই মামলায় আপনাদের অপরাধ নরহত‍্যার সঙ্গে তুলনীয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।