• Uncategorized
  • 0

গ এ গদ্যে মৃদুল শ্রীমানী

নগরলক্ষ্মী : একটি নারীর অসামান্য সংগ্রাম

নারী জীবন এবং সমাজে নারীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত বেশ কতকগুলি চরিত্র রবীন্দ্র সাহিত্যে চিত্রায়িত হয়েছে। এরমধ্যে ‘নগরলক্ষ্মী’ কবিতার সুপ্রিয়া চরিত্রটি উল্লেখের দাবি রাখে। রবীন্দ্র রচনাবলী বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণে কবিতাটি ‘কল্পদ্রুমাবদান’ অবলম্বনে লিখিত এরকম আভাসিত হয়েছে। রচনার তারিখ রয়েছে ২৭ আশ্বিন, ১৩০৬.
এই কবিতায় দেখা যাবে, বুদ্ধের জীবৎকালে একবার বিখ্যাত নগরী শ্রাবস্তীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। বুদ্ধ নিজের ভক্তদের প্রত্যেককে অনুরোধ করলেন দুর্ভিক্ষকাতর ক্ষুৎপীড়িত মানুষকে আহার যোগানোর দায়ভার কে নিতে পারবেন।
বলা দরকার যে, বুদ্ধদেব দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন এবং তাঁর সক্ষম সময়েই সমাজের বহু বিশিষ্ট ও অগ্রণী ব্যক্তি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আলোচ্য দুর্ভিক্ষ ও সেই সূত্রে ক্ষুধাকাতর জনতাকে অন্নদান প্রকল্পের দায়ভার গ্রহণের কথা বুদ্ধ যখন নিজের ভক্তদের বলেছিলেন, তখন ধনাঢ্য রত্নাকর শেঠ, সামন্ত রাজা জয়সেন, এবং বিপুল কৃষিজমির অধিকারী ধর্মপাল এবং আরো সকলেই নিজের নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। ধনী ব্যক্তি হোন বা লোকবলে বা জমির উপর স্বত্ব ও দখলে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও শ্রাবস্তীপুরীর ক্ষুধার্ত জনতার ক্ষুধা মেটানোর মনোবল সেই সব ব্যক্তিদের ছিল না।
বলা দরকার, বুদ্ধ মোটের উপর যাঁদের বদান্যতা আশা করেছিলেন, তাঁরা কেউ শ্রেষ্ঠী , কেউ সামন্তরাজা, আবার কেউ বিশাল ভূ সম্পত্তির মালিক হলেও যে বিচারবুদ্ধির প্রভাবে নিজের সর্বস্ব দান করে সাধারণের কল্যাণে উৎসর্গ করা যায়, এই হৃদয়বত্তার অভাব তাঁদের ছিল। বড় বড় সম্পত্তির মালিক হওয়া এক জিনিস, আর জনকল্যাণে সেই বিপুল সম্পত্তি উৎসর্গ করা আর এক জিনিস।
এমন সময়ে একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ালো। সে অনাথপিণ্ডদের কন্যা। সে নিজে একজন ভিক্ষুণী। সে বললো, খাদ্যহারা মানুষকে অন্ন যোগানোর ভার সে গ্রহণ করলো।
এইখানে উল্লেখ করতে হয়, বুদ্ধের জীবৎকালে ভিক্ষুজীবন যথেষ্ট কষ্টের মধ্যে কাটত। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার প্রশ্নই ছিল না। পোশাকও অতি সামান্য, হয়তো মাত্র একটিই। কোনো মান্যগ্রন্থে পড়েছি, মেয়েরাও মাত্র একটি পোশাকের কারণে নদীতে স্নানের সময়ে যথেষ্ট আত্মনিগ্রহ করতেন। বুদ্ধের অনুশাসন ছিল এতটাই কঠিন। তো সেই রকম একজন ভিক্ষুণী কি করে ক্ষুধার্ত জনতাকে খাদ্য দেবার অঙ্গীকার করছেন, তা সমবেত ভক্তদল বুঝতে অক্ষম হলেন। যে ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠী , যে সামন্তরাজ, যে বিপুল ভূসম্পত্তির অধিকারী, নিজের কাঁধে প্রভু বুদ্ধের আবেদন বহন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই হিসেবি বুদ্ধির লোকেরা এক ভিক্ষুণীর প্রত্যয়ের কাছে নিজেদের ছোটো হতে দেখে যেন ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হল। ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া শুধু তো বুদ্ধের চরণাশ্রিতা একজন নারীমাত্র নয়, সে যে অনাথপিন্ডদের কন্যা। কে অনাথপিণ্ডদ, কি তার পরিচয়? ভিক্ষুজীবনেও পিতৃপরিচয়ের ধারা বজায় রাখে হিসেবি বুদ্ধির লোক।
সমাজের নিচের থাকের একজন লোক, ব্রাত্যজন, সেও মাথা তুলে বড় কাজের দায়িত্ব পালনের ঘোষণা করবে : আর কেমন ধরণের বড় কাজ? যে কাজের সামনে শ্রেষ্ঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন, ভূস্বামী ধর্মপাল কুঁকড়ে যাচ্ছেন; সেই ক্ষুধার্ত বিশাল শ্রাবস্তীপুরীর দুর্ভিক্ষ ঘোচানোর কাজ? মেয়েটি কি পাগল হয়ে গেল? না কি, এ একটা অর্বাচীন দায়িত্বজ্ঞানহীন অহংকার?
বুদ্ধ কিছু বলেন না। বলে তো কিছু হয় না। প্রত্যেককে নিজেকে বুঝে উঠতে হয়। হয়ে উঠতে হয়। পরের বচনের উপর নির্ভর করে সত্যি সত্যি কেউ চলে না। সকলেই চলে নিজের উপলব্ধির উপর ভর করে। তার মন, মেধা, বুদ্ধি তাকে যে শলা দেয়, সেই ইঙ্গিতে সে চলে। বুদ্ধ বলেন, ‘আত্মদীপ ভব’। তুমি নিজে নিজে বোঝো, নিজে নিজে ভাবো।
এইবার ভিক্ষুণী একটা সাংঘাতিক কথা বলবে। সে যে একজন সর্বত্যাগী ভিক্ষুণী সেটা তো সত্য। সেই সত্যের জোরে সে তার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে যাবে সকলের কাছে। সকলে সাধ্য মতো ভিক্ষা দেবে এই নারীকে, যে অন্ত্যজের কন্যা। ভিক্ষা চেয়ে বেড়ালে ভিক্ষুণীর সম্ভ্রম ক্ষুণ্ন হয় না।
একজন ধনী মানুষ নিজের ধন বিলিয়ে দিয়ে সর্বত্যাগী হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে। ধনকুবের হন্যে হয়ে প্রাণের আরাম, মনের শান্তি খুঁজতে নিজের অর্থ সাম্রাজ্য তুচ্ছ করেছেন, এটাও সম্ভব। কিন্তু সাধারণভাবে ধনী কখনোই নিজেকে সকলের সাথে এক পংক্তিতে দেখতে চায় না। ধনের প্রকৃতিই অসাম্য। অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা করে উঁচুতে না দেখতে পেলে ধনীর অস্তিত্বের সংকট তৈরী হয়। সেই মানসিক গঠনের জন্যেই শ্রেষ্ঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন বা ভূস্বামী ধর্মপাল ভিক্ষুণীর প্রত্যয়ের সামনে নিজেদের আক্রান্ত বোধ করে। সুপ্রিয়ার এই কাজকে তারা অহংকারে মেতে ওঠা বলে চিনতে চায়। সে মেয়ের কাছে কোনো গোপন ভাণ্ডার আছে কি না, সে বাবদে প্রশ্ন তোলে।
মেয়েদের এমন কথা তো শুনতেই হয়। এমন গবেষণা চলে যেখানে প্রতিপাদ্য থাকে যে মেয়েরা প্রকৃতিগত ভাবে দুর্বল ও নিম্নমানের মেধা ও মননের যোগ্য। বলা হয়ে থাকে যে, মেয়ের শরীরী কাঠামো যথেষ্ট ঝক্কি বহনের যোগ্যই নয়। বিজ্ঞানের নামে টেকনিক্যাল কতকগুলি ঝলমলে রাংতা মুড়ে দেখানো হতে থাকে মেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণীর হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স। তারই সূত্র ধরে নারীজন্ম ও নারীমর্যাদার উপর আঘাত হানা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। মেয়েরা বিজ্ঞানচর্চা করলে, তাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে অত্যাচার করো, মেয়েরা সাহিত্য লিখলে, ‘ও শুধু মেয়েদের পাঠ্য’, বলে নাক সিঁটকে থাকো, মেয়েরা প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে চাইলে নানাভাবে হেয় করো।
এই রকম মনের কাঠামো হতেই সমবেত নাগরিক ভিক্ষুণী সুপ্রিয়ার দিকে তাকায়। কি আছে তোমার? তুমি তো অন্ত্যজের কন্যা? তুমি কি করে এহেন দায়িত্ব পালন করবে? প্রগলভা হয়ো না নারী।
এইবার সুপ্রিয়া যে জবাবটি দেয়, তা অসামান্য। সুপ্রিয়া তার অস্ত্রটি প্রকাশ করে। সেটি একটি ভিক্ষাপাত্র মাত্র। নিজের সামাজিক অবস্থান নিয়ে তার মনে কোনো ধোঁয়াশা নেই। নিজেকে ভুল বোঝানোর কোনো প্রচেষ্টা নেই। সে জানে সে সর্বহারা ভিক্ষুণী। তার উপর সে অনাথ পিণ্ডদের কন্যা। সে যে তথাকথিত সমাজে দীনহীন এবং অক্ষম পর্যায়ভুক্ত, সে কথা তার বলতে লজ্জা হয় না। কেন না সে জানে তার ভিক্ষাপাত্র একটি সামাজিক আন্দোলনের অমোঘ অস্ত্র। সে জানে তার জীবন ইতিমধ্যেই মানবের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনে সে নিশ্চুপে উৎসর্গ করে দিয়েছে। আর এই দেওয়াটা নিয়ে তার কোনো দোলাচল নেই। সকলের সমবেত সাধু উদ্যোগই সমাজকে বাঁচাবার পথ দেখাতে পারে। এ বাবদে যিনি পথিকৃৎ হতে চাইবেন, তাঁকে সকলের কাছে যেতে হবে। সকলের কাছে যাবার জন্য ছোটো হতে হয়। যথার্থ বড়ো হবার অন্যতম রাস্তা এই ছোটো হওয়া। শ্রেষ্ঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন বা ভূস্বামী ধর্মপাল ধরনের ব্যক্তি ওই রাস্তা চেনেন না। তাই তাঁদের অগাধ ধন সম্পদও বাস্তব প্রয়োজনের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। এগিয়ে যাবার এই একটাই পথ। সকলের সহযোগিতাকে সমন্বয় করে, সূচিমুখ করে সমসার মোকাবিলা করা। এটা যিনি করতে চান, তাঁকে নিজের ভেতর একটা বড় যুদ্ধে জিততে হয়। নিজের ছোটো আমিকে জগতের বড়ো আমির পদতলে সঁপে দিতে হয়। সুপ্রিয়া এই লড়াইটা লড়ে। ভিক্ষা তার কাছে একটি আন্দোলন হয়ে ওঠে। ব্রতের মতো হয়ে যায়।
বৃহৎ সামাজিক প্রয়োজনের কাছে নিজের সমস্ত রকম অস্মিতাকে এই যে সানন্দে বিলীন করে দেবার ক্ষমতা একটি মেয়ে দেখায়, এর সামাজিক মূল্য বিপুল। এই পথে আলোকযাত্রা। এই পথই যথার্থ শ্রী ও সমৃদ্ধির পথ। এই পথে একটি মেয়ে গোটা নগরের শ্রী ও কল্যাণের মূর্তিমতী অস্তিত্ব হয়ে ওঠে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।