• Uncategorized
  • 0

রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী – ৮

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তাঁর কবিতা ‘বুদ্ধভক্তি’

“বুদ্ধভক্তি” কবিতাটি ইংরাজি ৭ জানুয়ারি, ১৯৩৮ তারিখে লেখা। এটি লেখার সময় কবির বয়স ছিয়াত্তর। এই সব সময়ে কবি সারা পৃথিবীর যুদ্ধ উন্মাদনা লক্ষ্য করে, শান্তিকামী শক্তিকে সংহত করার কাজে যে গুণী সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক দার্শনিকগণ ব্রতী হয়েছেন, তাঁদের সাথে কাজ করছেন। ত্রিশ পেরোনো বয়সে যে পৃথিবীকে তিনি চিনতেন ছিয়াত্তর বছর বয়সে পৌঁছে তা গুণমানে, আকারে প্রকারে রীতিমত বদলে গিয়েছে। ধর্ম নিয়ে যে বোধ তাঁর পারিবারিক সূত্রে গড়ে উঠেছিল, তা নিজের মতো করে নতুন নতুন ভাবে বিকশিত বিস্তারিত বিনির্মিত করে তুলেছেন কবি। এক নতুন জন্ম যেন লাভ করেছেন, এক নবীন মূল্যবোধ। সে উপলব্ধি স্পষ্ট ও সোচ্চারে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে বলে।
নোবেল পুরস্কার পেয়ে সারা পৃথিবীর কাছে তিনি কবি দার্শনিক হিসেবে পরিচিত হন। সেটা ছিল ১৯১৩ সাল। কবির বয়স তখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে। তারপর শুরু হল প্রথম মহাযুদ্ধ। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ অবধি চলেছিল এই যুদ্ধ। আকারে প্রকারে মানুষ হত্যার সংখ্যায় ও মানুষকে বিপন্ন করার মাত্রায় এই প্রথম মহাযুদ্ধ আগের সব যুদ্ধের ভয়াবহতাকে টেক্কা দিয়েছিল। এটি “নবজাতক” কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
মহাযুদ্ধে রক্তস্নাত পৃথিবী সমস্ত প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধকে ভেঙে দিল। ১৯১৮ সালে বিস্তর ক্ষয় ক্ষতির পরে যুদ্ধ থামলেও ধিকিধিকি আগুন কিন্তু রয়েই গেল যা কয়েক দশক বাদে আত্মপ্রকাশ করবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে।
কবিতার নাম দিয়েছেন “বুদ্ধভক্তি”, কিন্তু, কবিতার ভিতরে প্রবীণ ও বিস্তৃত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কবি বুনে দিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক বোধ। কবিতার একটি দুই পংক্তির সূচনা যুগিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাতে চীন ও জাপানের মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাটিকে নিয়ে কথা বলেছেন।
স্পষ্ট সূচীতীক্ষ্ণ ভাষায় লিখেছেন, “জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি জাপানী সৈনিক যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে, ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।”
এই দুটি পংক্তিতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন চীন ও জাপান, এই দুই বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত দেশের মধ্যে তুলনামূলক মজবুত আর্থিক সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রটি দুর্বলতরটিকে কি চোখে দেখে। ক্ষমতাশালী দেশটিতে তথাকথিত বৌদ্ধ ধর্মানুগত মনেরই বা কোন দশা ধরেছে।
“বুদ্ধভক্তি” কবিতায় সংবাদপত্রে পড়া খবরের অনুষঙ্গে একটি ছবি ফুটিয়ে তুলতে চান কবি। দলে দলে জাপানী সৈন্যেরা চলেছে অমিতাভ বুদ্ধের মন্দিরে, না শান্তিপূর্ণ জীবনভিক্ষার জন্য নয়, সুস্থির হয়ে ভাবার ক্ষমতা অর্জনের জন্য নয়, জাপানী সৈন্য চায় চীন দেশের ধ্বংস। ঘটনাচক্রে চীন ও জাপান দুটিই দূর প্রাচ্যের বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত দেশ। ভারতে উৎপত্তি হয়ে নানা দুর্গম পথ অতিক্রম করে বৌদ্ধধর্ম যে দেশগুলিকে আলোকিত করেছিল, তারই অন্যতম দুটি দেশ, চীন ও জাপান। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে কবি লক্ষ্য করছেন যে এক ও অভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী দুটি দেশের একটি অপরটির ধ্বংস কামনায় বুদ্ধের আশীর্বাদ নিতে চলেছে।
জাপান ছিল চীনের তুলনায় শিল্পোন্নত দেশ। তুলনায় চীন ছিল কৃষিপ্রধান। জাপানের সাধারণ নাগরিক ছিল চীনের সাধারণ নাগরিকের তুলনায় অনেক বেশি তৎপর ও আগুয়ান।
জীবনের প্রথম পর্বে জাপানকে নিয়ে কবি বিস্তর স্বপ্ন দেখেছেন। জাপানের সাহিত্য, হাইকু কবিতা, জাপানের ইকেবানা পুষ্পসজ্জা, জাপানের গৃহসজ্জা, আর জাপানের অতিথি সৎকার উপলক্ষ্যে চা পান, ইত্যাদি বহু গুণপনা কবি রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
নবীন স্বপ্নমাখা দুটি চোখে জাপানকে গভীর ভালবাসায় লক্ষ্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন জাপানের লোকেরা শান্তিপ্রিয় ও সহনশীল। পথে সাইকেলে ধাক্কা লাগলে চালক ও পথচারী দুজনেই হেসে গা থেকে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে ব্যাপারটা ভুলে যায়। বলেছিলেন, জাপানী বাচ্চারা কাঁদে না।
খুব পরিমিতি বোধকে মান্যতা দিয়ে জাপানী কবি একটি ছবির মতো পদ্য গড়ে তোলেন খেয়াল করতেন তিনি। সব মিলিয়ে জাপানী শান্তিপ্রিয়তা, সৌন্দর্য পিপাসা আর উদ্যম রবীন্দ্রনাথের মন কেড়েছিল।
কিন্তু সমাজ তো আবেগ বিহ্বলতায় চলে না। সে চলে বাস্তবের কাঠখোট্টা নিয়মে। অর্থনীতির বিকাশের ধারার উপর নির্ভর করে সমাজ বিকাশের সূত্র। জাপান কবিগুরুর প্রৌঢ় বয়স পেরোনোর আগেই পুঁজিবাদের শিখরভূমি সাম্রাজ্যবাদ অর্জন করে ফেলে।
শোনা যায় জ্বলতে জ্বলতে নীল তারা দানবিক চেহারা নেয়। তখন বিপুল তার আয়তন। নিজের আগেকার চেনা সংহত আকারটাকে সে বহুগুণে টপকে যায়। আরো বাড়ার খিদেয় সে চারপাশের যা কিছু বস্তুনিচয় তাকে সবেগে গ্রাস করতে থাকে।
অতি পরিমাণ, ভূরি পরিমাণ বস্তু দানবিক মাধ্যাকর্ষণে নিজের অভ্যন্তরে গিলতে গিলতে সে একদিন বিস্ফারিত হয়।
পুঁজিরও নিয়ম যেন অনুরূপ। সে বড়ো হতে চায়। গড়ে ওঠবার, বিকশিত হবার এমন কি বড়ো হবার একটা পর্যায় পর্যন্ত তার প্রগতিশীলতা কাজ করে। তার পরবর্তী পর্যায়ে আরো বড় হবার তাগিদে তাকে আশপাশের দেশের বাজারে থাবা বসাতে হয়। সেই বাজার দখলের চেষ্টায় যুদ্ধ বাধে। একটা প্রগতিশীল দেশ পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক নিয়মে বিকাশ থেকে বিকৃতির পর্বে পৌঁছে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে। কবি তাঁর যৌবনে জাপানকে দেখেছেন প্রগতিশীল চেহারায়। আবার অর্থনীতির নিয়মে তার সাম্রাজ্যবাদী দশাটাও কবির চোখে নির্ভুলভাবে ধরা পড়েছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায়। তখন তার বিপুল উৎপাদনী কাঠামো। প্রযুক্তিবিদ আর প্রকৌশলীদের নিবিড় ভাবে কাজে লাগিয়ে সে উৎপাদনী চক্রের বিপুলায়তন কাঠামোকে পূৰ্ণ মাত্রায় কাজে লাগাতে চায়। বিপুল ব্যবস্থা চালাতে চাই বিপুল কাঁচামাল, শস্তা শ্রমিক আর শক্তির দানবিক যোগান। আর চাই বাজার। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল সে একটানা উৎপাদন করে চলে। থামতে হলে এবং তার পর নতুন করে আবার শুরু করতে হলে তার অনেক বরবাদ হয়। সেই কারণে মুনাফার হার ধরে রাখতে তাকে নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় উৎপাদন চালিয়ে যেতেই হয়। আর এই বাড়তি উৎপাদন একটা সাংঘাতিক সমস্যা তৈরী করে।
এত বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত দ্রব্য দেশের বাজারে বিক্রি হবার পরেও বাড়তি থেকে যায়। এই বাড়তি মাল বিক্রির জন্য চাই সামরিকভাবে অনুন্নত দেশের বাজার।
অনুন্নত দেশগুলির দিকে লোভী চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে প্রায় প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশ। যদি একটা জোড়াতাড়া তালমিল গড়ে ওঠে, সে এক রকম, নইলে অসি ঝনৎকার। অদ্য যুদ্ধ ত্বয়া ময়া।
পুঁজিবাদ জাতীয়তাবাদকে উৎসাহ দেয়। পুঁজির গড়ে ওঠার কালে, যে জাতীয়তাবাদ ছিল প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে পৌঁছনোর সময়ে সে হয়ে পড়ে পুরোনোপন্থী, অগ্রসর বিমুখ আর কুঅভ্যাস, কুসংস্কারের সাথে আপোষকামী। সাম্রাজ্যবাদী পর্বে জাতীয়তা তার সকল সদর্থক ভূমিকা ঝেড়ে ফেলে জাতীয় অহমিকার পোশাক গায়ে গলিয়ে নেয়। আমার জাতটি ভাল, উন্নত আর যে যেখানে আছে, সবাই ওঁচা, লক্ষ্মীছাড়া আর অসভ্য। এই হয়ে ওঠে অহমিকার ভিতরের কথা। এই অহমিকাটাকে সে ভদ্রস্থ খোলস দিতে নানাবিধ পণ্ডিত বিজ্ঞানী প্রকৌশলী ভাড়া করে, বা বেয়নেটের ডগায় তাঁদের ভুলভাল গবেষণায় নিয়োজিত করে। সাম্রাজ্যবাদী পর্বে একটি রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকদেরও বিশ্বাস করে না। যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিঃশর্তে রাষ্ট্রিক স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ না করে, সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র শত্রু হিসেবে গণ্য করে। ন্যূনতম সুযোগ পেলেই কারারুদ্ধ করে। তাঁদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। জেলে পোরা একান্ত সম্ভব না হলে, তাঁদের দেশ ছাড়ার পরিস্থিতি তৈরী করে। সব মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদ মনুষ্যত্বের উপর একটা কঠোর কঠিন আঘাত হানে।”বুদ্ধ ভক্তি” কবিতায় ছত্রে ছত্রে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী চেহারাটা যত্নে এঁকে দেন রবীন্দ্রনাথ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনো শুরু হয় নি, কিন্তু ছোটো ছোটো যুদ্ধ চলছিলই। এর মধ্য দিয়ে মারণাস্ত্রের কার্যকারিতা যাচাই হচ্ছিল। নিজেদের হিংস্র চেহারাটায় শাণ দেওয়া চলছিল। আর চলছিল দেশ ও জাতির সমস্ত কিছুকে একটা রাষ্ট্রিক সত্তার পদানত করে জনগণের মনে একটা চিহ্ন দেগে দেওয়া চলছিল। একটা দেশের শেষ ভরসা জনগণ। সাধারণ জনতাকে যদি নির্মানুষ করে তোলা যায়, তাহলে তার সাথে আর রোবটের ফারাক থাকে না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ তখন তাকে দিয়ে যে কোনো হীন কাজ পর্যন্ত করিয়ে নিতে বাধা পাবে না। রাষ্ট্রের যে কোনো মানবতা বিরোধী কাজেও জনতার উদ্বেল সমর্থন মিলবে। জনতার এই উদ্বেলতাটাই মারাত্মক। সমরবাদের প্রতি অকুণ্ঠ জন সমর্থন গড়ে তোলার চেষ্টায় থাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধ্বজাধারীরা। সামরিক প্রয়োজনের নাম করে ব্যক্তি নাগরিকের যে কোনো প্রশ্নের কণ্ঠরোধ করতে তৎপর থাকে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃপক্ষ। এই পর্যায়ে রাষ্ট্রিক যে কোনো পদক্ষেপের উপর জনগণের প্রশ্নহীন আনুগত্য নিশ্চিত করতে চায় প্রশাসন। প্রশ্ন তুললেই যাতে সেই অবাধ্য নাগরিককে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা চলে, তার জন্য আজ্ঞাবহ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলে ক্ষমতাসীন পক্ষ। প্রশ্ন করার মনকে ছেঁটে ফেলে, নির্বাসিত করে একদল মননহীন ব্যক্তি গোটা সিস্টেমটা করতলগত করে ফেলে। এটাই ফ্যাসিবাদ। এই ফ্যাসিবাদেরই দাঁত নখ দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেটাই বিশ্বস্ত ভাবে এঁকেছেন “বুদ্ধভক্তি” কবিতায়।এই কবিতায় চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জাপান। এক বৌদ্ধ ধর্মানুগত দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে আরেক বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত দেশ। দুই দেশের নাগরিকই বৌদ্ধ। ভগবান বুদ্ধের করুণা ও অহিংসার নীতি দুই দেশেই কখনো সম্মানিত ছিল রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে। ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মাত্র কয়েকটা বৎসর আগে তা কিভাবে বদলে গিয়েছে আমাদের জানাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতার গোড়াতেই একেবারে নির্মেদ টান টান ভাষায় জাপানের নিষ্ঠুর হিংস্র মানসিকতার দিকে আমাদের নজর টেনেছেন কবি। ধর্ম আর সেখানে মনুষ্যত্বকে ধারণ করছে না। ধর্মকে জাপান একটা মননহীন আধ্যাত্মিকতাহীন কল করে গড়ে নিয়েছে। সেইখানে দেবতার সাথে লেনাদেনা। ১৯৩৮ এ জাপানের সৈন্যরা কেমন তার একটা উদ্বেগজনক ছবি পেশ করেছেন কবি। নিম্নকোটির সৈন্যেরা সাধারণতঃ আসে চাষি জোলার ঘর থেকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তাদের মধ্যের মানুষটাকে নির্বিবাদে ছেঁটে ফেলে সেখানে এক হিংস্র সত্তার প্রতিষ্ঠা করে। এর নাম কিলার ইনস্টিংক্ট। মারো, যেভাবে পারো, মারো। মারাতেই সিদ্ধি। মারাতেই সার্থকতা। উৎকট ভাবে সেজে দাঁতে দাঁতে ঘষতে ঘষতে উষ্মা প্রকাশ করতে করতে সৈন্যের দল চলেছে দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে। কি প্রার্থনা? না, আরেকটি বৌদ্ধ প্রভাবিত দেশকে গুঁড়িয়ে দিতে আশীর্বাদ চাই। বিংশ শতকের গোড়াতেই উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট, এই দুই বিজ্ঞানী এরোপ্লেন আবিষ্কারে সফল হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথেরও এরোপ্লেন চড়ার সুযোগ হয়েছে, আর দার্শনিকের চোখ দিয়ে তিনি অনুমান করে নিয়েছিলেন যুদ্ধোন্মাদের দল কিভাবে এরোপ্লেনকে কুৎসিত কাজে লাগাবে। এই কবিতা লেখার বছর সাতেক আগেই ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, বাংলা ১৩৩৮ সনের ফাল্গুন মাসে ‘পক্ষী মানব’ নামে একটি কবিতা লেখেন তিনি। ইতিমধ্যেই পারস্য যাত্রার কালে বিমানে চড়েছেন কবি। বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদের অন্তরালে একটি লোভ দানবকে খেলা করতে দেখেন তিনি। ‘পক্ষী মানব’ কবিতায় সে কথা লিখেই ফেলবেন। তখনো আমেরিকার তরফে জাপানের উপর B 52 বোমারু বিমানে হিরোশিমা নাগাসাকিতে “লিটল বয়” ও “ফ্যাট ম্যান” নামে পরমাণু বোমা ফেলার দেরি আছে। কিংবা এই বিমান হানার পূর্ব ঘটনা হিসাবে জাপানের আয়োজনে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি পার্ল হারবারে অজস্র বিমান হানার কিছু দেরি আছে। কিন্তু বিমান যে মানুষের বিধ্বংসী ক্ষমতাকে একটা দানবিক মাত্রা দেবে, কবি এই “পক্ষী মানব” কবিতাতেই সেটা দ্বিধাহীন জড়িমা হীন স্পষ্ট কণ্ঠে বলে দিয়েছেন। তাঁর কলমে বিমানকে এভাবে বর্ণনা করেন ” আজি এ কি হল, অর্থ কে তার জানে!
স্পর্ধা-পতাকা মেলিয়াছে পাখা শক্তির অভিমানে…”
বিমানকে অশান্তি বলে চেনাতে চান তিনি। বলেন “কর্কশ স্বরে গর্জন করে
বাতাসেরে জর্জরি ..” বলেন ” উঠি মেঘলোকে স্বর্গ-আলোকে
হানিছে অট্টহাসে।…”
বলেন ” অশান্তি আজ উদ্যত বাজ
কোথাও না বাধা মানে”
আরো বলেন ” ঈর্ষা হিংসা জ্বালি মৃত্যুর শিখা
আকাশে বাতাসে বিরাট বিনাশে
জাগাইল বিভীষিকা”
আমাদের আলোচ্য কবিতাতেও বিমানের দানবিক ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন কবি। বলছেন ” হানিবে শূন্য হতে বহ্নি আঘাত
বিদ্যার নিকেতন হবে ধূলিসাৎ…” আরো বলেন ” বিষবাষ্পের বাণে রোধি দিবে নিঃশ্বাস –”
যুদ্ধের এই যে সাজ সজ্জা, বিষ বাষ্প দিয়ে মানুষ মারা,স্পষ্টতই আমাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দেবে। এই বুদ্ধভক্তি কবিতাতেই কবি লিখেছেন
” নারীর শিশুর যত কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ
জাগাবে অট্টহাসে পৈশাচী রঙ্গ,” নিশ্চিত ভাবেই হিটলারকে মনে করায়। ‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতার ছত্রে ছত্রে ফ্যাসিবাদের মুখোশ ধরে টানাটানি করে চলেন তিনি
ধর্মের অনুষঙ্গ বুদ্ধ ভগবানের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনও কি করে যুদ্ধবাজদের হাতে সমরবিদ্যার বিষয় হয়ে ওঠে আমরা আতঙ্কিত হয়ে দেখতে থাকি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।