মেহফিল -এ- কিসসা ধারাবাহিকে মৃদুল মাহবুব

ভাষা ও সাহিত্য – ২

কবিতা ও সাহিত্য যে ভাষার মামলা নয়, তা ধরার জন্য একটু রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, কমলকুমারে ধার নিবো ধীরে ধীরে। বাংলা সাহিত্যকে ভাষার কৌশল নির্ভর, শব্দ-বাক্যের খেলা হিসাবে গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা তা জীবনানন্দ বাহিত। জীবনানন্দকে কীভাবে দাঁড় করিয়েছি তা দেখা দরকার আছে। এই মহত্‌ কবির সীমাবদ্ধতাটাও মাপা লাগে আজ। এই মাপগুলো গড্ডালিকা প্রবাহের মত না হলে তা আর করা থেকে বিরত থাকতেও চলতো। ফলে, যে দেবতা আমরা তৈরি করেছি তা কতটা অক্ষয় পাথরে গড়া তা দেখার আছে। জীবনানন্দের কবিতা কেমন তার থেকে বাংলা কবিতায় পরবর্তী কবিতায় তার প্রভাব কেমন তা মাপা দরকার আজ। এই আলোচনার অন্যতম দিক এটা।ভূমিকা না মূল কথায় যাই।
জীবনানন্দ নিয়েই যত ফুটনোট আমি লিখেছি আর কাউকে নিয়ে অতটা লিখিনি। আরো লিখব ভবিষ্যতে।কেননা সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ভাষা নির্ভর যে দুজন কবি আছেন তার মধ্যে তিনি প্রথম।শুধু ভাষার শক্তিতে বাক্যকে কবিতা করে তোলার ক্ষমতা কারো ছিল না। তিনিই প্রথম। বাংলা কবিতার পরম্পরা ভাষা ভিত্তিক না, চিন্তা নির্ভর ছিল।এই পরম্পরার বিপক্ষে কীভাবে তিনি দাঁড়িয়েছেন তা উপলব্ধি করা লাগে। যদি পাঠক ভেবে থাকে জীবনানন্দের কবিতায় চিন্তা নেই তাহলে এই বাক্যের মিস রিডিং হবে। যে কোনো শিল্প হলো চিন্তা। তাকে পাঠক চিন্তা হিসেবেই ডিকোড করে। কিন্তু সেই চিন্তার ঔজ্জ্বলতা, নতুনত্ব থেকে যখন ভাষা ভঙ্গিমা প্রধান হয়ে ওঠে কারো কবিতায় তখন তা বিশেষ হিসেবে চিহ্নিত হয়।জীবনানন্দের বাংলা কবিতার ভাষা পরম্পরা ছেঁড়া অভিনব একটা ব্যাপার বটে।
এই সকল কারণে জীবনানন্দ এমন একজন চর্চিত কবি, যাকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা শক্তিক্ষয় আর অপচয় বলে বোধ হয়।অর্থাৎ তাকে নিয়ে কোনো ভূমিকা, বিস্তার, উদাহরণ, কোটেশন ছাড়াও কথা বলা যায় এবং বললে পাঠকের বুঝতে ও ধরতে সমস্যা হয় না। আমি ধরেই নিয়েছি এবং দেখেছি তার মতো বহুল পঠিত, সমালোচক দ্বারা উন্মোচিত কবি দ্বিতীয়টি নেই বাংলা ভাষায়। ফলে সহজেই অনেক কথা বলা যায় তাকে নিয়ে।ব্যক্তি জীবন থেকে বেডরুম পর্যন্ত যাওয়ার মতো অসভ্যতা কয় জন কবিকে নিয়ে হয়েছে বাংলা সাহিত্যে! কবিতা আলোচনায় বেডরুমের অবদান তেমন কিছু নেই বলে মনে হয়।কবিতা মগজে লিখিত হয়। ব্যক্তি জীবনের উপলব্ধি শিল্পে আশ্রয় নেয়, কিন্তু তা নিউরনের আলো অন্ধকার দিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় যখন মুক্ত হতে থাকে তখন বাস্তবতা বিচ্যুত হতে থাকে। ফলে বেডরুম নির্ভর ব্যক্তিগত সহকারীমূলক আলোচনা-পড়া থেকে আমি বিরত থাকি। অধিকাংশ জীবনানন্দ আলোচক যতটা না তার শিল্প বোঝে তার চেয়ে বেশি লাবণ্যদাসের ঠ্যাঙানি বোঝে।ফালতু ফালতু শিল্প আলোচনায় জীবনানন্দ ভরপুর। এগুলো এড়িয়ে যাওয়া লাগে নিজ দক্ষতায়।
ফলে জীবনানন্দ কেন্দ্রিক আমার সমস্ত আলোচনা ফুটনোট। আর বেশি কিছুনা।

১.

জীবনানন্দ এখনো শিশুপাঠ্য রয়ে গেল আমাদের জন্য। মানে তার সবই ভলো, ক্রিটিক করার কোনো সামাজিক দশা তৈরি হয়নি এখনো সমাজে। নিজেরা নিজেরা মিলে জীবনানন্দীয় শিল্পের শঙ্খ নীল কারাগার স্থাপন করে বসবাস করছি আমরা।মহৎ কবির সমালোচকরা তাকে সময়ের প্রেক্ষিতে রিনিউয়্যাল করেন।কিন্তু জীবনানন্দের
রিনিউয়্যাল কই? পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের আলোচকদের আবিষ্কৃত জীবনানন্দ আর আজকের জীবনানন্দ দেখতে একই।মহৎ কবিরা যতদিন যায় ততই ম্যাচিউর হয়ে ওঠেন পরবর্তী কবিদের ক্রিটিক দ্বারা। কিন্তু তার মতো বড় কবি দিনের পর দিন কী পেলেন এই কালের কবিদের হাতে।ভক্তির কাগজের ফুল ছাড়া আর কিছু নেই তার জন্য। তার মতো মহৎ কবির জন্য এটা কম পাওনা।ফলে বহু দিন হলো জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যের ভালো ছেলে, ফার্স্ট বয়, গোবেচারা। জীবনানন্দ এক মেরামতহীন ঐতিহাসিক দালান কোঠা, যা যে কোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে আমাদের ভক্তির ভারের কারণে। তার কবিতা ভাষা আর ডেকোরেশন নির্ভর, কম চিন্তার পরম্পরায় গেছানো। এটাই তার সম্ভাবনা আর সংকট।এই অতিভক্তির কারণে জীবনানন্দ নামক সোনার পিঙ্গল মূর্তির কারণে বাংলা সাহিত্য ছবি আর উপমার মধ্যে আটকে আছে। তার পথ আর আমাদের পথ এক না, এটা বুঝেই সমকালীন কবিতা করতে হবে।

২.

ভাষা যে সাহিত্যতার প্রথম উদাহরণ জীবনানন্দ। ব্যতিক্রম যে উদাহরণ হতে পারে না, তা আমরা মানতে নারাজ।ফলে এই দেশে কবির জন্ম ও মৃত্যু হয় ভিন্ন ভাষার সাধনায়। সাহিত্য একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাপার।কিন্তু সমগ্র কবিসমাজের চাওয়া ভিন্ন ভাষায় লিখতে চাওয়া। কেন? আমাদের মানা দরকার, ভাষাই সাহিত্য নয়।ধরে নিয়েছি, ভাষায় আলাদা হতে পারাটাই নতুন সাহিত্য।সাহিত্য একটা টোটাল ব্যাপার। ভাষা কখনো সাহিত্য না।ফলে জীবনানন্দ নামক এক সাফল্যের মরীচিকার পেছনে কবি সমাজ দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে জীবনীশক্তি ক্ষয় করে এই জীবনে আর কিছুই লিখে উঠতে পারে না। কবিতা নয় ভাষার সাধনা।

৩.

কবিতাকে শব্দ-কল্প-চিত্রের মধ্যে আটকে রাখা একটা সমস্যাই মনে হয় আমার কাছে। চিত্রকল্প ব্যাপারটা অনেক বেশি ব্যক্তিগত।ব্যক্তিচেতনার চেয়ে সোসাইটির মানুষের ভাবনা কে ডিল করতে পারাটা শিল্পের বড় কাজ।ব্যক্তি খুব ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার দুনিয়ার প্রেক্ষিতে। ভাষা মূলক ব্যক্তির হাহাকার হলো ‘জীবনানন্দ-সিনড্রোম’ বাংলা কবিতার।এই চিত্রময় কাব্যের বাইরে যারা ভেঙে বের হয়ে কবিতা করতে চেয়েছে তাদের প্রধানতম সমস্যা হলো সময়ের তাৎক্ষণিকতা। পরিবেশটা, কয়েক সেকেন্ড তুলে দেওয়াটাই কবিতা তাদের কাছে। ধরেন একটা শালিক বা কাক দেখলাম, তুলে দিলাম কবিতায়।এই কালের ফালতু কবিতার সাইন হলো উপমা নির্ভর শব্দ, বাক্যে প্রচেষ্টাময় কবিতা। হাল আমলে যে সেমি-দার্শনিকতাময় কবিতা দেখবেন তার রুটও জীবনানন্দ দাশ।বাংলা কবিতার বড় সম্ভাবনার জায়গা হলো ‘জীবনানন্দ-সিনড্রোম’-এর বাইরে আসা।ভাষার বাইরে চিন্তার ভেতর কবিতাকে আনতে হবে নতুন পথে। শব্দ হবে ভাবনার বিচ্ছুরণ। চিন্তাকে কবিতায় দাঁড়াতে দিতে হবে।

৪.

জীবনানন্দ অনেক আনস্মার্টলাইন লিখেছেন। একটা উদাহরণ দিই। ‘বোধ’ কবিতায় অনেক জায়গায় জীবনানন্দীয় টেকনিক বলে আমরা যা বুঝে থাকি তা নেই। একটু খেয়াল করে দেখা লাগে। জীবনানন্দের কবিতা নতুন ভাষা প্রকাশের প্রকটতা।ফলে কবিতার বহু কিছুকে বাদ দিয়ে তা শুধু ভাষা হয়ে উঠতে চায় কখনো কখনো। এর বাইরে তার কবিতা আর কী কী! পশ্চিম ইউরোপের কবিতা যত দূর পর্যন্ত যায়, ততদূর পর্যন্তই তিনি। অনুপ্রেরণা উৎসারিত কবিতায় বহু ক্ষেত্রে কপি পেস্ট তিনি।এগুলোর উদাহরণ নতুন করে দেওয়ার দরকার নেই। তিনি যে ভাষায় কবিতা লিখছেন তা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বিরল।ভাষাই তার মাস্টারি। এছাড়া বিরাট এক শূন্যতা, ফাঁপানো বেলুন তার চিন্তার দুনিয়া।শুধু ভাষা আর প্রকাশ ভঙ্গি নির্ভর কবিতার সমস্যা হলো ভাষা যখন নিজের থেকে বের হতে চায় তখন দেহের রূপের পরিবর্তে শুধু কঙ্কালটা শুয়ে থাকে অরূঢ় ভনিতায়।প্রকরণ যেভাবে শিল্পের ক্ষতি করতে পারে তা ধরার জন্য ‘বোধ’ কবিতা একটা নিদারুণ সত্য উদাহরণ।জীবনানন্দের কবিতা থেকে ব্যবহারিক বহু কিছু শেখার আছে।জীবনানন্দ একটা কবিতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খুব প্রাথমিক বই।তাকে পড়তে পড়তে তার সাথে ডিলিং শেষ করেই তবে আপনাকে ভাবতে হবে। শ্রদ্ধা মিশ্রিত তারুণ্য একটা বড় ভণ্ডামি এই সমাজে। এর বাইরে থেকে তাকাতে হবে তার গভীরে।
দেখুন কীভাবে নিজের ভেতর নিজেই পতিত হচ্ছে জীবনানন্দ :
‘ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা করে চলে গেছেন যখন ডেকেছি বারে বারে
ভালোবেসে তারে;’
কেমন অতি সাধারণ গেঁয়ো পোয়েট্রি, বোধ বুদ্ধিহীন আত্মমেহন।এর নাম বোধ? ওভারঅল ভাষার দক্ষতায় অসাধারণ একটা কবিতা। বাংলা কবিতার প্রকাশ ভঙ্গির প্রকরণগত জায়গায় এমন দ্বিতীয় কবিতার উদাহরণ নেই। কিন্তু চিন্তার কী ‘দেবদাস’দীনতা নিয়ে এই বিশাল শিল্প সৌধটি দাঁড়িয়ে। চিন্তার প্রশ্ন ছুড়ে দিলে ধসে যাবে জীবনানন্দের অনেক কবিতা।আরো আরো উদাহরণ আপনারা খুঁজে নেবেন। যাদের কাছে কবিতা শুধু ভাষা, প্রকরণ, ভিন্ন প্রকাশনা  নয় তারা তার কবিতাকে মূল্যায়ন করতে গেলে বহু জায়গায় হোঁচট খাবেন। এটাই জীবনানন্দের বৈশিষ্ট্য, এগুলো কোনো সমস্যা না।এই সমস্ত ফিচার নিয়েই তিনি বাংলা ভাষার বড় কবি।
নিজস্ব ভাষা আবিষ্কার কবিকে একটা আয়ু দেয়। সেটা কবিতার শেষ কথা না। কবিতা অনেক কিছু দিয়েই গড়া যায়।সেটা মানতে হবে। কবিতা লেখার সবচেয়ে সহজতর, বহু ব্যবহৃত উপায় ভাষা আর প্রকরণের সাধনা।টেকনিকের মতো সেকেন্ডারি টুলস দিয়ে কবিতার কিছু হয় না। এটাই ভাষা সাধনার ফাঁদ ও গর্ত। আমাদের বহু কবি এর মধ্যে হারিয়ে গেছেন।এতটাই গভীর গর্ত যে উদ্ধারের উপায় থাকে না।

৫.

‘বনলতা সেন’বা ‘সমারূঢ় ’টাইপের আরো কিছু সরল কবিতা না লিখলে জীবনানন্দ শুধু বোদ্ধারাই পড়তেন।
মহৎ কবিদের সবচেয়ে খারাপ লেখাটিই সবচেয়ে পঠিত, পাঠক প্রিয় হয়। এগুলো বিলো-জীবনানন্দ স্ট্রান্ডার্ড কবিতা। ‘নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা?’ কিন্তু কেন? সমালোচকদের সহ্য করার সক্ষমতা আধুনিক মানুষের গুণ।বনলতা একটি ফুটা ভিক্টোরিয়ান প্রেম চেতনার ত্যানা, প্যাঁচানো। সমালোচকরা যা কিছু বলেছে সব কিছুই আরোপিত, তাদের নিজ নিজ কল্পনা।তাদের কল্পনা মানতে আপনার সমস্যা না থাকলে এটাও মানতে সমস্যা হওয়ার কথা না যে, এটা স্রেফ একটা প্রেমের কবিতা, হাহাকার। এটার মধ্যে বোদ্ধাদের আবিষ্কৃত কোনো চেতনা, ঐতিহ্য নেই। কেননা সাধারণে এটা পছন্দ করে। তাদের কথা ঠিক হলে ‘বনলতা সেন’ অন্তত পাশের বাড়ির তাবাসসুম পড়তো না।

ক্রমশ…..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।