ছোটগল্পে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

পিকলুর আয়না

পিকলুর আর মাধ্যমিক পাশ করা হল না। এমন নয় যে সে কিছু বোঝে না। বাংলায় রচনা এসেছিল  ‘দেশের প্রতি ছাত্র যুবকের কর্তব্য’। মোট নম্বর ছিল ষোলো। টাইপের মতো খুদে খুদে সমান সারিবদ্ধ হাতের লেখায় পিকলু রচনা লিখে চলেছিল। “দেশ” আর “কর্তব্য” বিষয়টা পিকলুর খুব প্রিয়। তাদের বাড়ির সামনে রোয়াকে বসে পল্লিবৃদ্ধগণ গত দেড় দশক ধরেই এই আলোচনা করে চলেছেন। সর্বাপেক্ষা প্রবীণ ব্যক্তিটি বলে যান। আর অনুজপ্রতিমেরা শোনেন। এক একজন মুখ্য আড্ডাধারীর গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়, আর অন্য একজন তার স্থানাভিষিক্ত হন। মুখ্য আড্ডাধারী কে হবেন, তা নিয়ে কোনো নির্বাচন হয় না। স্থির অকম্পিত দৃষ্টিতে যিনি বাগ্ বিন‍্যাস করে যেতে পারেন, সেই প্রবীণতম ব্যক্তিই সর্বসম্মতি ক্রমে মুখ্যপদ লাভ করেন। জ্ঞান হওয়া ইস্তক পিকলু লক্ষ্য করেছে এর কোনো অন্যথা হয় নি। ঘরে মুখ বুজে বসে থাকতে থাকতে নিজের পল্লীর জ্ঞানবৃদ্ধদের চিন্তাপূর্ণ রোয়াক বক্তব্য নিত্য দিন দুবেলা এক মনে শুনে গিয়েছে সে। ক্ষুদিরাম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অচেনা মানুষের দিকে কিভাবে বোমা ছুঁড়েছিলেন, কেন বীর সুভাষ দেশ ছেড়ে যাবার কালে এক পাঠান সহযোগী ছাড়া আর কাউকে নিলেন না, নিজে নিলেন জিয়াউদ্দিন নামে মূক বধির ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ, আর কেন বিবেকানন্দ সজ্ঞানে দেহত্যাগ করলেন, তা নিয়ে খুঁটিনাটি বিস্তারিত তথ্য পিকলুর মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। এখন স্বাধীনতা দিবসে তাকেও বক্তব্য রাখতে দিলে, সেও অক্লেশে ঘন্টাখানেক এই সব নিগূঢ় দেশপ্রেমের কথা অনর্গল বলে যেতে পারে। কিন্তু পিকলুর সমস্যা হল, তাকে পতাকা তুলতে কেউ ডাকে না। একদিন ভোট দিতে গিয়ে নিজের পাড়ার বুথে এক অমায়িক প্রিসাইডিং অফিসারকে পেয়ে পিকলু একটু আলোচনা শুরু করতে চেয়েছিল। অমনি রং বেরঙের রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা তাকে একজোটে ঘিরে ধরে বুথ থেকে তাড়িয়ে দেয়। তাতে অবশ্য পিকলু আলোচনার একটা নতুন পয়েন্ট পেয়ে যায়। সেটা হল ভোটের শতকরা হার কে কত পাবে তাই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কাট থ্রোট প্রতিযোগিতা থাকলেও, ভোট ব্যবস্থাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সংসদীয় দলগুলো একজোট। কোনো গতিকেই তারা এই ব্যবস্থাটি বিপর্যস্ত হতে দেবে না।
পিকলু মাধ্যমিকের রচনায় এই সব বক্তব্য একেবারে সন্দর্ভ রচনার নৈপুণ্যে লিখেছিল। ওই একটি রচনা লিখতেই সে অনেক পাতা বাড়তি নিয়েছিল আর সমস্ত সময়টুকু সেখানেই ব্যয়িত হয়ে গিয়েছিল। অন্য প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় পায় নি পিকলু। তাই শিক্ষক তাকে অন্য প্রশ্ন বাবদে আর কোনো নম্বরই দিতে পারলেন না। ষোলো নম্বরের রচনার জন্য মোট বত্রিশ পাতা গবেষণা লিখেও পিকলুর প্রাপ্তি হয়েছিল শূন্য। কেন যে অমন হয়েছিল তার একটা ব্যাখ্যাও পিকলু দাঁড় করিয়েছিল। যে শিক্ষক খাতা দেখেছিলেন, তিনি পিকলুর প্রশ্নবাণের সামনে নিজেকে বিপন্ন বোধ করেছিলেন। তাইতে ক্ষোভবশতঃ তিনি রচনাকারীর খাতার উপর কোপ মেরেছিলেন। অঙ্কেও পিকলু একটা শক্ত সম্পাদ্য করতে গিয়ে তার নানাবিধ বিকল্প প্রমাণ হাজির করে এবং বোর্ডের গণিতপুস্তক রচনাকারীর যে গণিতের প্রাথমিক বোধটুকুই নেই, এ ব্যাপারে একটি জ্ঞানদীপ্ত প্রবন্ধ লিখেছিল। গণিতের শিক্ষকের পরীক্ষার্থীর তরফে এহেন বাগ বিস্তার ভালো লাগে নি। আর প্রমাণগুলিও বইয়ের অনুরূপ ছিল না । তাই অঙ্কেও পিকলুর প্রাপ্তি শূন্য হয়েছিল। মাতৃভাষা বাংলা আর গণিত, উভয় বিষয়ে শূন্যতা অর্জন করায় পিকলুর বাবা আর পিকলুকে পড়াশুনা করতে বারণ করলেন। নিজেদের সিঁড়ির নিচেই ছোট্ট একটি দোকান খুলে পিকলু লজেন্স বিক্রি শুরু করে দেয়। বাবা তার থেকে প্রতিদিন বিক্রিবাটা ও মালপত্রের হিসেব বুঝে নিতেন ও দোকানের ভাড়া দিতে হলে যে পিকলুর কিছুই লাভ হত না , সেইটা বোঝাবার চেষ্টা করে যেতেন। স্কুলের ছেলেরা মায়ের হাত বাক্স ঘেঁটে যা দু চারটা পয়সা জোগাড় করতে পারত, তাতেই সস্তার লজেন্স কিনত। পিকলু জানত, এই সব কমদামি লজেন্স এর উপাদান কোথা থেকে সংগৃহীত হয়, তবু নিজের একমাত্র জীবিকাটুকু নষ্ট হয়ে যাক, সেটা সে চাইত না। ছেলেরা স্কুলে চলে গেলে, তার দোকানে আর কেউ আসত না। তখন সে ছাতা ঘাড়ে এ রাস্তায় সে রাস্তায়, এ গলি ও গলি ঘুরে বেড়াত, আর অসম্ভব সব ব্যবসার ফন্দি আঁটত। পুরোনো জিনিসের দোকানে ক্রেতা থাকত কম। তাদের দোকানের সাজ সজ্জা থাকত কম। নাম মাত্র। কেন না পুরোনো জিনিসের কারবারীদের লোকের মন ভোলানোর চেষ্টা থাকে না। তারা জানে জিনিসের মধ্যে কিছুমাত্র গুণ থাকলে এক শ্রেণীর ক্রেতা আসবেই। তারা ঘুপচির মধ্য থেকেই অভিজ্ঞ ঝানু চোখে মাল খুঁজে নেবে। পিকলু এই সব জিনিস দেখে বেড়াত। সেকেলে আরাম কেদারা, পালঙ্ক, জলচৌকি, আর আয়না দেখতে দেখতে ব্রিটিশ ভারতের বিবর্তনের ইতিহাস একবার ঝালিয়ে নিত পিকলু। সেই আরাকান ব্রহ্মদেশ থেকে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত এক ভারত ছিল ব্রিটিশদের কব্জায়। এত বিপুল একটা দেশকে কি করে তারা শান্ত ও সমাহিত রেখেছিল, সেটা এক আশ্চর্য ব্যাপার মনে হত। অবিভক্ত বাংলার কিছু আবেগ থর থর বিপ্লবী, কিছু মরাঠি স্বাধীনতাকামী, আর পঞ্জাবের কিছু সিংহহৃদয় ব্যক্তি ছাড়া ব্রিটিশের পক্ষে খুব বিপজ্জনক আর কোনো ব্যক্তিত্বের নাম পিকলুর মনে আসত না। খাট পালঙ্কের মেহগণি কাঠের ভিতরে সৌরচক্র কোনো চিহ্ন রেখে যায় কি না, অনুমান করার চেষ্টা করত সে। পুরানো আসবাবের কারবারীরা পিকলুকে চিনে ফেলেছিল। সে যে কিছুই কিনবে না, তা তারা জানত। পিকলু যে ওগুলো নিজের ব্যবহারের তাগিদে তো নয়ই, এমনকি স্পষ্ট কোনো ব্যবসায়িক দিশা থেকেও যে দেখে থাকে, তাও তারা মনে করত না। কেবল অলস দুপুরে কোনো কার্যকরী ক্রেতা আসার সম্ভাবনা থাকত না বলে তারা পিকলুকে দোকানে সময় কাটাতে দিত।
একদিন এক বুড়ো গোছের কারবারীর সাথে দেখা হয়ে গেল পিকলুর।  পিকলু খেয়াল করল তার বাড়িতে তার প্রপিতামহ বুড়ো দাদুর যে ছবিটি আছে, যাকে অনেকটা তার বাবার মতোই দেখতে ছিল, তার মুখের সাথে বুড়ো কারবারীটির বিস্তর মিল। বুড়ো তাকে একটা আয়না গছাবেই, আর পিকলু কিনবে না। পিকলু কিনবে না, কেন না, তার কাছে কোনো পয়সা নেই। পাছে দুটো টাকা খরচা হয়ে যায়, এই ভয়ে সে পকেটে কিছুই নিয়ে বের হয় না। আর বুড়ো তাকে আয়না নিয়ে যেতে বলে, ব্যবহার করতে বলে, ও পছন্দ হলে তবেই দাম দিতে বলে। নগদে যখন পয়সা দিতে হচ্ছে না, আর অপছন্দ হলে ফেরত দেবার সুযোগ থাকছে বলে, যুক্তিবাদী পিকলু বুড়োর প্রস্তাবে না করতে পারল না। দোকানি তাকে বলল যে এ হল জাদু আয়না। খোদ লর্ড ক্লাইভ এই বেলজিয়ান আয়নাটি ব্যবহার করেছিলেন। ক্লাইভের জীবনের উত্থান পতনের সাথে এই আয়নাটি বিজড়িত।
ইতিহাসের গন্ধ পেয়ে পিকলু আয়না বাড়িতে নিয়ে আসতে আগ্রহ বোধ করল। ও ওপর ওপর আয়না নিতে অনিচ্ছা দেখালো। আগ্রহ দেখলেই অভিজ্ঞ কারবারী কুচ করে গলাটি কেটে নেয়, এই ছিল পিকলুর ধারণা।
বাড়িতে এসে পিকলু নিজের ঘরে আয়নাটি টাঙাল। পিকলু এটিকে নিজের ঘর মনে করে। কিন্তু ঘরে তার মা ও পিসিমার ঠাকুর দেবতারা থাকেন। হিন্দুর ঘরে ঠাকুর দেবতার পটের সামনে বিবাহিত দম্পতির শোয়া মানা। একাকী মহিলাও না শুলে ভাল। কিন্তু অবিবাহিত হিন্দু পুরুষদের কোনো দোষ নেই। তারা সদা পবিত্র।
পিকলু একটা বাহারি আয়না এনেছে দেখে পিসি বেশ একটু অবাক হল। যে ছেলে চুলটুকু আঁচড়ানোর মতো সময়ের অপব্যবহার করে না, মা পিসিমাকে সর্বদা শাস্ত্রজ্ঞানের কথা উপদেশ দেয়, সর্বদা বাবার পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে একবারও মাথা না তুলে কথা বলে, সে হঠাৎ এমন একটা সেকেলে বাহারি আয়না কিনে আনল কেন, বুড়ি পিসি ভেবে পেল না।
রাত বেশি হতে জাদু আয়না তার খেল শুরু করল। শোবার আগে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের হিসেব করে নিত পিকলু। সর্বদা বাম দিকে ফিরে শোয়ার কথা বলত। ও নাভিদেশে নিজের মনকে নিয়ে আসার প্রবল চেষ্টা করতে করতে অন্যান্য দিন তার ঘুম পেয়ে যেত। আয়না সাহচর্যে তার কিছুতেই ঘুম এল না। শয্যায় অনেক বার এপাশ ওপাশ করে, সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নার ভেতর দেখতে পেল স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেই দেশে দাঙ্গা বেধেছে। গান্ধী ছুটে গিয়েছেন নোয়াখালীতে। ইংরেজ তাড়ানোর আগেই নিজেদের মধ্যে এই ঝগড়া ঝাঁটি পিকলুর ভাল লাগলো না। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে সে আবার শুল। পিসি অনেক রাত অবধি জপ করেন। ঘরের দরজায় বাইরের প্যাসেজে তিনি শোন। পিসি বললেন, ঘুম আসছে না, না কি পিকলু?
খানিকবাদে পিকলু আবার উঠে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখে স্বাধীন ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে শরণার্থী আসছে। তাদের রাখা হচ্ছে শরণার্থী শিবিরে। সেখানে যুবতী মেয়েদের কোনই নিরাপত্তা নেই। আব্রুও নেই। আবার পিকলু এক গ্লাস জল খেয়ে শোয়ার চেষ্টা করল। পিসি বাইরে থেকে খোঁজ নিলেন ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে কেন?
পিকলু আয়নার রহস্য কথা ভাঙতে না চেয়ে আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল এক পয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধির কারণে কলকাতায় সারি সারি ট্রাম জ্বলছে। এক ব্যারিস্টার বলছেন, এক পয়সা বৃদ্ধি বড় কথা নয়, কার পকেট থেকে পয়সা কার পকেটে যাচ্ছে, প্রশ্ন সেটাই। পিকলু আবার জল খেয়ে শোয়ার চেষ্টা করল। খানিক বাদে আবার উঠে যেই আয়নার দিকে তাকিয়েছে দেখে কি, বামফ্রন্টের পুলিশ বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের মহিলা কর্মীদের উপর দৈহিক নির্যাতন করছে। পিকলুর বার বার ওঠা দেখে পিসি জপ ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকেছেন। ভাইপো আয়নার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে কি দেখছে দেখে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শোয়ালেন ও মিহিসুরে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম জপ করে যেতে লাগলেন। পিসির শীর্ণ হাতের চাপড়ানি পিকলুর মোটে ভালো লাগছিল না। সে মটকা মেরে পড়ে রইল। পিসি নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের বিছানায় যেতেই পিকলু আয়নার নতুন কাণ্ড দেখতে চাইল। আয়নার ভিতরে তখন এক নতুন ধরণের কেষ্টলীলা। সেই কেষ্ট আর গোপললনা নিয়ে পরকীয়া করেন না। বিরোধী দলের প্রার্থীদের পিলে চমকে দেন । কেন যে দেন, একটি বিশেষ গ্যাসের ঘাটতির কারণে সে সব হয় বলে আধুনিক গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্লাইভের আয়নায় এই সব দেখে শুনে পিকলু রীতি মতোন ঘাবড়ে গেল। এর পর আয়না কি দেখাবে সে ভেবে পেল না। এবার পিকলুর মা বাবাকে পিসি ডেকে এনেছে। মা বললেন, ‘কি হলো কি তোর, রাত দুপুরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি বিড়বিড় করিস?’ পিসি আবার আদ্যাস্তোত্র শুরু করলেন। তার ফাঁকেই বাবা আয়নাটা প্যাক করে ফেলে নিজের ঘরে নিয়ে চলে গেলেন। পিকলু চুপ করে শুয়ে কোনো মতে রাত কাটালো। সকাল হতেই প্যাক করা আয়না নিয়ে হাঁটা দিল বুড়ো লোকটার দোকানের দিকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।