দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২২০)

পর্ব – ২২০

শ‍্যামলী অনসূয়াকে বলল, দিদি বেরোচ্ছি।
কাজের সহায়িকাটি বলল, বেরোচ্ছি বলতে নেই। বলো, আসছি।
অনসূয়া বললেন, কারো সাথে কোনো তর্ক বিতর্ক বাদ বিতণ্ডায় যাবে না। এখন তোমার একটাই লক্ষ্য, ফার্স্ট ক্লাস এনশিওর করা।
শ‍্যামলী বাধ‍্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল।
অনসূয়া আবার বললেন, কলেজ থেকে বেরিয়ে কোথাও যাবে না। সোজা বাড়ি ফিরে খেয়ে রেস্ট নেবে।
শ‍্যামলী আবার ঘাড় নাড়ল।
অরিন্দম কিছু বললেন না। শুধু শ‍্যামলীকে দেখে মিটিমিটি হেসে গেলেন।
অনসূয়া বললেন, আমি চারটে নাগাদ কোর্ট থেকে ফিরে আসব, আর একসাথে চা খাব।
অরিন্দম বললেন, আমিও অফিস শেষ করে চলে আসব।
অনসূয়া বললেন, না তুই আসবি না। শ‍্যামলীর এখন সামনে পরীক্ষা।
অরিন্দম বললেন, আমি সন্ধ্যায় এসে ওকে একটু টুকি করেই বেরিয়ে যাব।
অনসূয়া হেসে ফেললেন।
গাড়িতে ওঠার সময় শ‍্যামলী দেখল অরিন্দমের কাঁধে হাত রেখে অনসূয়া বারান্দা থেকে তাকিয়ে আছেন। অরিন্দম হাত নাড়লেন। অনসূয়াও।
কলেজের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই একদল মেয়ে শ‍্যামলীকে ঘিরে ধরল। আজ সাত নভেম্বর। বিশ্ববিপ্লবের মহান দিন।  আমাদের বিপ্লবের জন‍্য কিছু দাও। কয়েকজন মেয়ে কৌটো বাগিয়ে ধরল। পাশ থেকে একটা মেয়ে বলল, শ‍্যামলী বাড়ির গাড়ি থেকে নামছে, আর তোরা কৌটোয় পয়সা নিয়ে ওকে ছেড়ে দিবি? বিল ব‌ইয়ে রশিদ কেটে টাকা নে।
শ‍্যামলী জানত তার হাতব‍্যাগে টাকা নেই। নানাভাবে খরচা হয়ে গিয়েছে। সহসা নিজের কপর্দকশূন্য অসহায় অবস্থার কথা ভেবে নিঃসীম লজ্জায় তার মাথাটা নিচু হয়ে এল। সে ড্রাইভার গোবিন্দের কাছে হাত পাতল। দুটো টাকা দাও না। মেয়েরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, না, দুটাকা পাঁচ টাকা নয়, দশটা টাকা দিতেই হবে।
শ‍্যামলীর গা হাত পা থরথর করে কাঁপছে। এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় সে কোনোদিন পড়ে নি। এই গোবিন্দও একদিন পালবাড়িতে আশ্রিত ছিল। ভাগ‍্যিস সে শ‍্যামলীর পরিস্থিতিটা আদ‍্যোপান্ত জানে।
মেয়েরা বলল, তোমার হাতব‍্যাগে দ‍্যাখো না, অমন কত দশটাকা রয়েছে। শ‍্যামলী বলতে গেল, দ‍্যাখো, আমার হাতব‍্যাগে কিচ্ছু নেই। মেয়েরা বলল, দ‍্যাখো না, দ‍্যাখো না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ‍্যামলী ব‍্যাগ খুলে দেখল ভিতরে পাঁচটি দশটাকার নোট রাখা। এ নিশ্চয়ই অনসূয়াদি’র কীর্তি।  তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। সে দশটাকার একটি নোট বের করে মেয়েদের দিতে তারা বলল, তুমি কাঁদছ কেন?
শ‍্যামলী কিছু না বলে একছুটে কলেজে ঢুকে গেল।
 ক্লাসে গিয়ে পৌঁছে নিজের ডেস্কে বসতেই অতি রোগা চেহারার মেয়েটি এসে পিঠে হাত রেখে বলল, তুই কাঁদছিলি কেন? কাঁদতে নেই ছি!
শ‍্যামলী সহপাঠিনীর দিকে তাকাল। স্ফূরিত ওষ্ঠাধরে নিঃসীম বেদনা। গতকাল মঙ্গলবার কলেজে ক্লাস করে যে মেয়েটি বেরিয়েছিল, সে হোস্টেলে স্থান চেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার ব‍্যবধানে একেবারে সমস্ত অতীত যাকে মুছে ফেলতে হয়েছে সে একজন অসহায় মানুষের প্রতীক।
বুক দিয়ে কারখানাটাকে সে নতুন করে গড়ে তুলছিল। কারখানার গুড‌উইল কি করে বাড়বে ভাবছিল। শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ ও সম্মানবোধ গড়ে তুলতে সে পরিশ্রম করছিল, সমস্ত কিছু একটা দলিলের ধাক্কায় মিথ‍্যে হয়ে গেল। এমনকি শ্রমিকেরা তার দিকে ফিরে চাইল না। নিঃসীম ভয়ে তারা চোখ তুলে চাইতেও পারেনি। এদেশের সংগঠিত অংশের শ্রমিকরা একান্ত ভাবে ইউনিয়নের নেতাদের মুখাপেক্ষী। ইউনিয়নগুলি রাজনৈতিক দলের লেজুড়। অথচ ব‍্যাপারটা উলটো হ‌ওয়া উচিত ছিল। সংখ‍্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকদের স্বাধীন ও অবাধ ভোটে ইউনিয়নের নেতৃত্ব নির্বাচিত হ‌ওয়া উচিত ছিল। আর ইউনিয়ন গুলির যৌথ সংগ্রাম থেকে রাজনৈতিক দলের দিশা তৈরি হ‌ওয়া প্রয়োজন ছিল। এদেশের শ্রমিক যেন পুতুল। দম দেওয়া পুতুলের মতো তারা রাজনৈতিক প্রভুর ইচ্ছায় আন্দোলন করে, বনধ্  সফল করে, বা ব‍্যর্থ করে, আর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক শ্রমিক ইউনিয়নের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব জীবনে কায়িক পরিশ্রম করে অন্নসংস্থানের পথে হাঁটেন নি।
দিন দশেক আগেও যে মেয়ে রোজ পরিকল্পনা করত, কারখানার বিক্রি কিভাবে বাড়ানো যায়, কিভাবে কাস্টমারের আস্থা অর্জন করা যায়, কি করে কারখানার শ্রমিকদের মধ‍্যে স্বাস্থ্যকর অভ‍্যাস ও রুচি গড়ে তুলবে, সে সব‌ই এখন কোন্ কুয়াশাচ্ছন্ন অতীতের গল্প বলে মনে হচ্ছে।
রোগা মেয়েটা শ‍্যামলীকে বলল, শুনেছিস, গুরশরণরা সবাই মিলে পঞ্জাব চলে গেল। বাংলায় আর থাকবে না। ওদের মহল্লার কত লোক ব‍্যবসা জলের দরে বেচে চলে যাচ্ছে। গুরশরণটা কলেজ থেকে মাইগ্রেশন পর্যন্ত চাইতে এল না। ওর না কি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে।
শ‍্যামলীর বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। মনে পড়ছে সেদিন গুরুদ্বারে অসহায় শরণার্থীদের মধ‍্যে বসে আছে গুরশরণ। ভেবেই পাচ্ছে না, কোন্ দোষে তাদের উপর এত বড় বিপর্যয় নেমে এল!
 শরণার্থী কথাটা মনে হতেই তার মনে পড়ল সকালে অরিন্দম আলোচনা করছিলেন হিটলারের সাংঘাতিক ও নৃশংস অত‍্যাচারে কত ইহুদি পরিবার ঘরছাড়া হয়েছে। একটা গোটা নৃগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন ভূমিহীন শরণার্থী বানিয়ে দিয়েছে নাৎসিবাদ।  পোশাক বদলাতে বদলাতে সে সেই আলোচনার দিকে কান খাড়া রেখেছিল। অনসূয়াদি বললেন, অরিন্দম, তুই এত কথা জানলি কি করে? অরিন্দম বললেন, শ‍্যামলীর কাছে। জানিস্, শ‍্যামলী ভীষণ সিরিয়াস আলোচনা করে। যার পায়ের নিচে মাটি নেই, অরিন্দমের তরফে এই সামান্য স্বীকৃতিটিও তাকে অত্যন্ত আশ্বস্ত করল। অরিন্দম, আপনি সামান্য একটু হলেও যে আমাকে আমার চেতনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাতে আমি সম্মানিত বোধ করছি।
ক্লাসে শিক্ষক এসে হাজির হলেন। তিনি বললেন, গতকাল কোনো একটা পরিস্থিতির কারণে ক্লাস নেবার জন্য উপস্থিত থেকেও আমি ক্লাস করানোর সুযোগ পাইনি। পরীক্ষা সামনে। আজকে ওই চ‍্যাপটারটা শেষ করে দেব। সবাই মন দিয়ে ক্লাস কোরো।
ক্লাসের মেয়েরা সমস্বরে বলল, ম‍্যাম, শ‍্যামলী আমাদের ওই চ‍্যপটারটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে।
শিক্ষক অবাক হলেন। তাই না কি? তাহলে দেখা যাক্ শ‍্যামলীর কাছে তোমরা কি রকম শিখেছ!
হৈ হৈ করে ক্লাস এগিয়ে চলল।
মেয়েরা বলল, শ‍্যামলী চমৎকার করে বোঝাতে পারে।
শিক্ষক উজ্জ্বল চোখে বললেন,
একজন শিক্ষকের সার্থকতা কিসে জান?
ক্লাস চুপ। পিনপতনের শব্দটিও যেন শোনা যাবে।
শিক্ষক মৃদু হেসে বললেন, ছাত্রদের কাছে ক্রমশই নিজেকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা।
তোমরা মারিয়া মন্টেসরির নাম শুনেছ? একজন বিরাট শিক্ষাবিজ্ঞানী। ইটালিতে জন্মেছিলেন। তিনি বলেছেন, দি গ্রেটেস্ট সাইন অফ সাকসেস ফর এ টিচার ইজ টু বি এবল টু সে , দি চিলড্রেন আর নাও ওয়র্কিং অ্যাজ ইফ আই ডিড নট একজিস্ট।
শ‍্যামলী, তুই শুনেছিস নিশ্চয়ই মন্টেসরির নাম?
শ‍্যামলী মাথা নিচু করে বসে আছে। শিক্ষক এগিয়ে তার কাছে এসে দেখতে পেলেন, তার চোখ গলে টপ টপ করে জল পড়ছে।
হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং মাই চাইল্ড।
মেয়ে বলল, ক‌ই, আমি কাঁদছি না তো!
 অতি রোগা মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গুরশরণ কৌর পঞ্জাবে চলে গেছে বলে ও কাঁদছে।
শিক্ষক বললেন, পঞ্জাবি মেয়ে? তোদের ক্লাসে তো কোনো পঞ্জাবি মেয়ে কোনোদিন ছিল না?
রোগা মেয়েটি বলল, ফিলজফি ডিপার্টমেন্ট এর মেয়ে।
শিক্ষক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, কখনো কখনো আমাদের মহৎ শিল্পীরা আমাদের কথাটা আগেভাগেই বলে দিয়ে যান। ভিনসেন্ট ভ‍্যান গঘ , একজন বিশ্বসেরা ডাচ শিল্পী বলেছিলেন, আই ফীল দ‍্যাট দেয়ার ইজ নাথিং মোর ট্রুলি আর্টিস্টিক দ‍্যান টু লাভ পিপল।
শ‍্যামলী চোখ মুছে হেসে বলল, লাভ ইজ মাই রিলিজন, আই কুড ডাই ফর ইট।
রোগা মেয়েটা বলল, কথাটা কীটস বলেছেন। শ‍্যামলী সব সময় বলে।
শিক্ষক সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে র‌ইলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।