শশাঙ্ক পাল তাড়াতাড়ি শ্যামলীর দুটি হাত ধরে বললেন, আমাকে ক্ষমা কর্ মা। বুড়ো হয়েছি, কি বলতে কি বলি।
শ্যামলী আত্মস্থ ভঙ্গিতে বলল, বাবা, একটা প্রবল উত্তেজনার মধ্যে হঠাৎ করে তুমি কি বলে ফেললে, আর সেটাকেই আমি খুব বেশি রকম গুরুত্ব দিয়ে ফেলব, তা তুমি ভেবো না। সেদিন রমানাথদের বাড়িতে জ্যেঠিমা আমাকে কিছু বলেছিলেন, সেই নিয়ে রমানাথ খুব সঙ্কুচিত ছিলেন। বারবার করে তিনি আমার কাছে সে ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। আমি ওঁকে যতই বোঝাই জ্যেঠিমার কথায় আমি কিছু মনে করি নি, তবুও তাঁর অপরাধবোধ কাটে না।
শশাঙ্ক বললেন, আচ্ছা তুই বল্ তো শ্যামলী, এতদিন এক ছাদের নিচে ভাইবোনের মতো করে থাকলাম, আজ সবিতাটা যদি হঠাৎ করে এভাবে চলে যায়, আমার খারাপ লাগবে না? ওর যদি কোনো বিপদ আপদ হয়?
শ্যামলী বলল, বাবা, একটা কথা বোঝার চেষ্টা করো। পিসি তার জীবনে একটা নতুন আশা খুঁজে পেয়েছে। এই আশাটাই ওকে বাঁচতে সাহায্য করবে। আর বিপদে পড়লে তুমি তো থাকলেই। কিন্তু বিপদে পড়লে, মানুষের সবচেয়ে বড় সহায় সে নিজে। নিজের প্রাণকে কি করে রক্ষা করতে হয়, মানুষ ঠিক জানে। শুধু মানুষ কেন বাবা, পাখপাখালি, জন্তু জানোয়ার এমনকি পোকামাকড় পর্যন্ত জানে, কি করে প্রাণটা বাঁচাতে হয়। ওইটাই হল প্রাণধর্ম। এটাকে প্রবৃত্তিও বলতে পারো। ভেতর থেকে সংকেত আসে কখন কি করতে হবে। বদভ্যাসে অনেকে সেই ভেতরের সংকেত শুনতে পায় না। প্রকৃতি আসলে তাকে খরচের খাতায় লিখে ফেলেছে। পিসিকে আজ যেতে দাও বাবা। শুধু বলে রাখো, এ বাড়ির দরজা তোর জন্য খোলা থাকবে।
বাসন্তীবালার দিকে তাকিয়ে শ্যামলী বলল, মা আমার আজ কলেজ যেতে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেল। দেখি যদি শেষ দুটো ক্লাস করতে পারি।
বাসন্তীবালা ধরা গলায় বললেন, কিছু খেয়ে যাবি না মা?
শ্যামলী বলল, আমি রাস্তায় কিছু কিনে খেয়ে নেব মা।
কলেজে গিয়ে ক্লাসের ফাঁকে সে কলেজ প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে গেল। বলল, ম্যাম, আমি গার্লস হোস্টেলে থাকতে চাই। একটা দরখাস্ত লিখে এনেছি।
তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে প্রিন্সিপাল বললেন, কেন, বাড়িতে অশান্তি করেছ?
শ্যামলী জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বলল, না না, সে রকম কিছু নয়। এমনি।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, তুমি আমাকে কি ভাবছ আমি জানতে চাই না। তবে জেনে রাখো যে তোমার বয়সটা আমি অনেক দিন হল পেরিয়ে এসেছি।
শ্যামলী মিনতির সুরে বলল, সে আমি জানি। ওই জন্যই তো ভরসা আছে, আপনি আমার প্রয়োজনটা বুঝতে পারবেন।
প্রিন্সিপাল বললেন, দ্যাখো শ্যামলী, স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই। এখন থার্ড ইয়ারে পড়ছ। একেবারেই শেষের দিকে হঠাৎ করে এভাবে একটা বোর্ডার নেওয়া যায় না। অনেক কথা উঠবে। আমি এই ঝক্কি নেব না।
শ্যামলী আবার বলল, হোস্টেলে একটা সিট পেলে আমার খুব সুবিধা হত। একটু দেখুন না।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার বললেন, বাড়িতে কি নিয়ে অশান্তি করেছ?
প্রিন্সিপাল কঠিন হয়ে বললেন, একটা থার্ড ইয়ারের মেয়ে, যার পরীক্ষার আর অল্প কয়দিন বাকি, যে রিকশা করে বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করে, তাকে আমি কোনো যুক্তিতেই হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি না।
শ্যামলী ম্লান হেসে বলল, আমি বাসে করে আসি। ফেরার সময় প্রায় হেঁটে ফিরি।
প্রিন্সিপাল বললেন, বাজে কথা একদম বলবে না। আমি নিজে গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখেছি তুমি রিকশা চড়ে আসছ।
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ ম্যাডাম, একেবারে প্রথম দিকে বাবার জেদে রিকশা করেই আসা যাওয়া করতে হত। এখন আর করি না। লজ্জা লাগে।
প্রিন্সিপাল বললেন, কেন, রিকশা চড়তে লজ্জার কি আছে?
শ্যামলী বলল, একটা লোক আমাকে নিয়ে যাবে বলে রিকশা টানছে, ভাবতেই আমার লজ্জা করে।
ম্যাডাম বললেন, তাহলে বলতে চাইছিস, যারা রিকশা চড়ে সবাই নির্লজ্জ?
শ্যামলী বলল, না ম্যাডাম, তাদেরকে তো আমি কিছু বলছি না। আমি আমারটা বলছি।
প্রিন্সিপাল বললেন, এই যে আমি বাড়ির গাড়ি চড়ে আসি, আমার জন্যেও তো একটা মানুষ সারাদিন আটকে থাকে। সেটাও নিশ্চয়ই লজ্জার বিষয়।
শ্যামলী বলল, কেন, ওটা তো তার প্রফেশন, ওটা সে শিখে নিয়েছে।
প্রিন্সিপাল বললেন, রিকশাওলার ব্যাপারটা কিন্তু প্রফেশন নয়, ওকে ও কাজটা শিখতে হয় নি, এই তো তুই বলতে চাইছিস?
শ্যামলী বলল, না, আসলে গাড়ি যে চালায়, তাকে ঠিক গায়ের জোরে গাড়িটা ঠেলতে হয় না। ওকাজটা চাপানো আছে যন্ত্রের ঘাড়ে। তেল পুড়িয়ে যন্ত্রটা চলছে। ড্রাইভার তাকে শুধু গাইড করে। কিন্তু রিকশাচালক যেন একটা বড় গ্লানিময় অবস্থায় কাজ করে। আমার কষ্ট হয়।
প্রিন্সিপাল বললেন, তার মানে তোর মতে আমরা যারা রিকশা চড়ি, সব নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অমানুষ।
শ্যামলী চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে, এঁকে যুক্তি দেখিয়ে বোঝানো যাবে না।
প্রিন্সিপাল আবার বললেন, বাবা মায়ের সঙ্গে কি নিয়ে অশান্তি করেছিস?
শ্যামলী বলল, বলার মতো কিছু নয়।
প্রিন্সিপাল বললেন, মন খুলে বললে অ্যালাও করার কথা ভাবতেও পারতাম। কিন্তু তুই ভাঙবি, তবু মচকাবি না। কি হয়েছে শিগগির বল?
শ্যামলী বলল, দেখুন ম্যাম, মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে। এই প্রাইভেসিটা আছে বলেই মানুষ গরু গাধা কুকুর বেড়ালের থেকে আলাদা। প্রাইভেসি ছাড়া স্বাধীনতার কোনো মানেই নেই। আমি হেড অফ দ্য ইনস্টিটিউশনকে রিটন্ প্রেয়ার দিতে চাই।
বেল বাজিয়ে হেডক্লার্ককে ডাকলেন প্রিন্সিপাল। তারপর বললেন, এই মেয়েটা শ্যামলী। এ যদি কোনো দরখাস্ত জমা দিতে চায়, সোজাসুজি আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
হেডক্লার্ককে চলে যেতে বলে প্রিন্সিপাল শ্যামলীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোদের একটা কারখানা আছে না?
শ্যামলী বলল, কারখানাটা বাবার।
প্রিন্সিপাল বললেন, আমি শুনেছি, কারখানাটা তুই চালাস।
শ্যামলী চুপ করে রইল।
প্রিন্সিপাল বললেন, অন্য যে কোনো ছেলেমেয়ে এই প্রশ্নের উত্তরে বলত, আমাদের কারখানা। আর তুই বললি, বাবার কারখানা অথচ সবাই আমরা জানি, কারখানা তুই চালাস। তোর একটা স্বভাবই হল, একটা জিনিসকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উলটো করে বলা। জীবনে সহজ হ। সহজ সরল ভাবে চলতে শেখ। ভাল রেজাল্টটাই সব নয়, অন্যকে সম্মান করতে না শিখলে তোকেও কেউ ভালবাসবে না।
শ্যামলী বলল, ম্যাম, আমি যদি হোস্টেলে কোনো মেয়ের গেস্ট হয়ে থাকি?
প্রিন্সিপাল বললেন, ভাল মনে করিয়ে দিয়েছিস। হোস্টেল সুপারকে ডেকে বলে দেব, যাতে তোকে হোস্টেলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না দেয়।
শ্যামলী বলল, আমি হয় তো অজান্তেই আপনার কাছে কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। আমার অপরাধটা বুঝিয়ে দিলে, সংশোধন করে নেবার চেষ্টা করব।
প্রিন্সিপাল বললেন, না না, তোমার আবার অপরাধ কোথায়? তোমার ছবি স্টেটসম্যান কাগজে ছাপে। তুমি তো এখন সেলিব্রিটি। তুমি আমাদের কলেজে পড়ে আমাদের ধন্য করে দিয়েছ।
শ্যামলী মৃদুস্বরে বলল, আমি এবার যেতে পারি?
প্রিন্সিপাল বললেন, মাথায় একটুও বুদ্ধি থাকলে অনেক আগেই সরে যাওয়া উচিত ছিল।
শ্যামলী মেরুদণ্ড টানটান করে একবার তাকালো তাঁর দিকে। তারপর ঝুঁকে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রিন্সিপালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পর হাতছানি দিয়ে হেডক্লার্ক তাকে ডাকলেন।
বললেন, শ্যামলী, কি করেছ তুমি? ম্যাডাম তোমার ওপর এত রেগে আছেন কেন?
শ্যামলী এক মুহূর্ত থমকে বলল, না না, রেগে তো নেই। এমনই।