রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

মৃত্যুর নিপুণ শিল্প 

রাতের অপেক্ষা করে থাকেন সেরা জ‍্যোতির্বিজ্ঞানীরা। রাতের আঁধারে তারায় তারায় কি লেখা আছে তাঁরা পড়েন। তারপর রাত একসময় শেষ হতে যায়। তখনও সূর্য ওঠার অনেক দেরি। এমনকি তার লাল আভাটুকুও ফোটে নি, তখন একরকম আলো, ভারি আবছা একরকম আলো দেখা যায়। ওকে জোডিয়াক‍্যাল লাইট বলে। সূর্য আর গ্রহগুলির মাঝে যে মহাশূন্য, সেখানে অনেক গুঁড়ো গুঁড়ো অতি সূক্ষ্ম ধুলো থাকে। সৌর আলো তাতেই ঠিকরে উঠে ওই হালকা আলো আকাশে আঁকে। ভিনসেন্ট ভ‍্যান গঘ ( ৩০ মার্চ ১৮৫৩ – ২৯ জুলাই ১৮৯০) অ্যাসাইলামে থেকে অমন একটা প্রত‍্যূষের ছবি আঁকলেন। কিন্তু গঘের এই আঁকাটায় চাঁদের আকার নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটা গানে এ রকম লিখেছেন,

যখন এসেছিলে অন্ধকারে
চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে–
গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥
তুমি গেলে যখন একলা চলে
চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।
তখন দেখি, পথের কাছে
মালা তোমার পড়ে আছে–
বুঝেছিলেম অনুমানে
এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥

ভ‍্যান গঘ ভাল বেসেছিলেন একটা মেয়েকে। লণ্ডনের একটা মেয়ে। সে মেয়ে গঘকে পছন্দ করে নি। গঘের তখন মোটে একুশ বছর বয়স। ওই মেয়েটা পছন্দ করল না বলে খুব আঘাত পেয়েছিলেন গঘ। নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বেশি দিন তো বাঁচেন নি। সাঁইত্রিশ বছরের জীবন গঘের। মনোকষ্ট জটিল হয়ে উঠেছে টের পেয়ে নিজে নিজেই অ্যাসাইলামে ভর্তি হলেন। ওখানেই যে ঘরে থাকতেন তার পুবের জানালার দিকে চেয়ে চেয়ে শেষ রাতের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। ওই হল স্টারি নাইট।

রাতের আকাশ মানুষকে নিজের ভিতরে তাকাতে শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন,
রজনীর শেষ তারা, গোপনে
আঁধারে আধো ঘুমে
বাণী তব রেখে যাও
প্রভাতের প্রথম কুসুমে..

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ কবিতাটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে যখন লক্ষ করি “তোমার জ‍্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায়,” কথাটি, তখন ওই শেষ তারার কথাটা খুব মনে হয়। কতটা একলা হলে একটা মানুষ এ রকম করে ভাবতে পারে। ভ‍্যান গঘও যেন ওইভাবে ভাবলেন। অতোটা একাকিত্ব বুকে বইলেন।

শনি গ্রহকে মানুষ বহুদিন থেকে চেনে। কিন্তু তার ওই বলয় আর টাইটান নামে তার চাঁদ আবিষ্কার করেছেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস ( ১৪ এপ্রিল ১৬২৯ – ০৮ জুলাই ১৬৯৫)। আর শনি গ্রহের বলয় যে অনেকগুলো, সেটা বললেন ইতালিয়ান গণিতবিদ জিওভান্নি দমিনিকো কাসিনি ( ০৮ জুন ১৬২৫ – ১৪ সেপ্টেম্বর ১৭১২) । ১৬৭১ সালে ল‍্যাপেটাস, আর ১৬৭২ এ রিয়া নামে শনি গ্রহের দু দুটো উপগ্রহ আবিষ্কার করেন কাসিনি। আর ১৬৮৪ তে টেথিস আর দিওন নামে আরো দুটো। রাতের পর রাত জেগে টেলিস্কোপ বাগিয়ে আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের সন্ধান করেছেন তাঁরা। ওই যে জোডিয়াক‍্যাল আলোর কথা বলছিলাম গঘের আঁকা বলতে গিয়ে, ওটা আবিষ্কার করেন কাসিনি। তখন ১৬৮৩ সাল।

আলো যে কিভাবে চলছে, সে নিয়ে আগে অনেক বিতর্ক হয়ে গিয়েছে। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এর কথা বলছিলাম, ১৬৭৮ সালেই উনি আলোর ঢেউ এর মতো চলার কথা বললেন। ১৬৯০ সালে আলো চলার রকম নিয়ে বই লিখলেন ‘ট্রিটিজ অন লাইট।” লোকজন হাইগেনস এর কথা মানতে চায় নি। কেননা, আইজ‍্যাক নিউটন ( ০৪ জানুয়ারি ১৬৪৩ – ৩১ মার্চ ১৭২৭) ওই সময়ই বলেছেন আলো কণা হিসেবে চলে। লোকজন নিউটনের কথাটা নিয়েছে। হাইগেনস এর কথা মানতে চায় নি। আলো নিয়ে কত ভাবনা বিজ্ঞান সাধকদের। কবিদেরও। রবিঠাকুর বলেন,

“দেখা না-দেখায় মেশা হে বিদ্যুৎলতা,
কাঁপাও ঝড়ের বুকে একি ব্যাকুলতা ॥
গগনে সে ঘুরে ঘুরে খোঁজে কাছে, খোঁজে দূরে–
সহসা কী হাসি হাস’; নাহি কহ কথা ॥
আঁধার ঘনায় শূন্যে, নাহি জানে নাম,
কী রুদ্র সন্ধানে সিন্ধু দুলিছে দুর্দাম।
অরণ্য হতাশপ্রাণে আকাশে ললাট হানে,
দিকে দিকে কেঁদে ফেরে কী দুঃসহ ব্যথা ॥”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় পার্থিব জীবনের সীমার মধ‍্যেই মহাজাগতিক অস্তিত্বের কথা, অনন্তের কথা, বলতে চেয়েছেন বারে বারে। বলেছেন:
“হঠাৎ সন্ধ‍্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
সমস্ত আকাশে বাজে অনাদিকালের বিরহবেদনা।
তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
এ গলিটা ঘোর মিছে
দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
…. এ গান যেখানে সত‍্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘন ছায়া-”
( বাঁশি, পরিশেষ, ২৫ আষাঢ় ১৩৩৯)
লিখেছেন:
“এ ভঙ্গুর পাত্রখানি প্রতিদিন উষার আলোতে
নানা বর্ণে আঁকি;
নানা চিত্ররেখা দিয়ে মাটি তার ঢাকি।
হে মহান্, নেমে এসে তুমি যারে করেছ গ্রহণ,
সৌন্দর্যের অর্ঘ্য তার তোমা-পানে করুক বহন।।”
( জলপাত্র, পরিশেষ, ০৮ শ্রাবণ ১৩৩৯)
লিখেছেন:
“জেনেছ যারে তাহারও মাঝে
অজানা যেই সেই বিরাজে,
আমি যে সেই অজানাদের দলে,
তোমার মালা এল আমার গলে।।”
( পাঠিকা, বীথিকা, বৈশাখ ১৩৪১)
লিখেছেন:
“অকুণ্ঠিত দিনের আলো
টেনেছে মুখে ঘোমটা কালো–
আমার সাধনাতে
এল তোমার প্রদোষবেলা সাঁঝের তারা হাতে।।”
(ভুল, বীথিকা, ৩ বৈশাখ ১৩৪১)

আরো লিখেছেন:
“তোমার সন্ধ্যা ছিল প্রদীপহীনা,
আঁধারে দুয়ারে তব বাজানু বীণা।
তারার আলোক-সাথে মিলি মোর চিত্ত
ঝংকৃত তারে তারে করেছিল নৃত‍্য,
তোমার হৃদয় নিস্পন্দ ছিল।।…
উষার চরণতলে মলিন শশী
রজনীর হার হতে পড়িল খসি।
বীণার বিলাপ কিছু দিয়েছে কি সঙ্গ,
নিদ্রার তটতলে তুলেছে তরঙ্গ–
স্বপ্নেও কিছু কি আনন্দ ছিল?”
( উদাসীন, বীথিকা, তারিখহীন)
আরেকটি:
“সেই কথা ভালো, তুমি চলে এসো একা,
বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে–
স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা,
সন্ধ‍্যাতারাটি শিরীষ-ডালের ফাঁকে।…
পারো যদি এসো শব্দবিহীন পায়,
…আকাশে চুলের গন্ধটি দিয়ো পাতি,
…তোমাতে আমাতে মিলিত নিবিড় একা–
স্থির আনন্দ, মৌনমাধুরীধারা,..”
( নিমন্ত্রণ, বীথিকা, ৩১ জ‍্যৈষ্ঠ ১৩৪২)

মনে রাখি যে “বিশ্বপরিচয়” গড়ে তুলতে গিয়ে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু (০১ জানুয়ারি ১৮৯৪ – ০৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) র ছাত্র প্রমথনাথ সেনগুপ্তের খসড়া ব‍্যবহার করেছেন। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন বসুকেই। এমনকি অল্পদিনের মধ‍্যে বইটির সংস্করণ হলে আশা করেছেন যে বসু লেখাটি সংশোধন করে দেবেন। সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন অত‍্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তাঁর সঙ্গেই নাম এসে যায় মেঘনাদ সাহা ( ০৬ অক্টোবর ১৮৯৩ – ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬)র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদার্থবিজ্ঞানচর্চা বুঝতে গিয়ে বসু ও সাহার পদার্থবিজ্ঞানচর্চার খোঁজ নেওয়াটা সঙ্গত।

বসু এবং সাহা, দুই অলোকসামান‍্য পদার্থবিজ্ঞানী ১৯১৯- ২০ সালে একযোগে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ক গবেষণাপত্র জার্মান ভাষা থেকে সরাসরি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বসু এবং সাহা ছিলেন ঘনিষ্ঠ সতীর্থ। ওঁরা দুজনে ১৯১৩ সালে গণিত বিষয়ে সাম্মানিক স্নাতক হন। আর ১৯১৫ সালে অ্যাপ্লায়েড গণিতে স্নাতকোত্তর হন। উভয় পরীক্ষায় বসু প্রথম হয়েছিলেন, আর সাহা দ্বিতীয় হন।
১৯১৪ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন স‍্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯১৬ সালে বসু এবং সাহা দুজনেই অ্যাপ্লায়েড গণিতের শিক্ষক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তবে দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কাজ চেয়ে নেন।

এরপর বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চলে যান। ক্লাসে ম‍্যাকস প্ল‍্যাঙ্ক এর ল’ এবং আলোর কোয়ান্টা সংক্রান্ত হাইপথিসিস ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে একবার তাঁর মনে হয়, তিনি কিছু একটা ভুল বলে ফেলেছেন। পরে সেই ভুল বলাটা নিয়ে কেন অমন ভুল হল অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি এক মৌলিক আবিষ্কার করে ফেলেন। এ ব‍্যাপারে বসু একটা গবেষণা পত্র তৈরি করে স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি আলোর কোয়ান্টা (অর্থাৎ ফোটন) এর একটি কোয়ান্টাম স্ট‍্যাটিসটিকস তৈরি করেছিলেন। এই গবেষণা পত্রে বসু ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞানের সংশ্রব ছাড়াই ভিন্ন পথে ম‍্যাকস প্ল‍্যাঙ্ক এর কোয়ান্টাম বিকিরণ ল’ দেখিয়েছিলেন। আইনস্টাইন বসুর এই গবেষণা পত্র পড়ে চমৎকৃত হন। তিনি নিজেই এই গবেষণা সন্দর্ভ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে বসুর তরফে ‘জাইটোসক্রিফট ফার ফিজিক’ নামে বিজ্ঞান পত্রিকায় পাঠান। ১৯২৪ সালে সন্দর্ভটি প্রকাশিত হয়।
এই গবেষণার সূত্র ধরে বসু বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কিছু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা করেন। তিনি বিদেশে গিয়ে লুই-ভিকটর দে ব্রগলি, মাদাম মেরি কুরি ও অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে গবেষণা করার সুযোগ পান। বোস- আইনস্টাইন সংখ‍্যায়ন, বোস গ‍্যাস, বোসন কণা, এবং পদার্থের এক নতুন ধরনের অবস্থা বোস- আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বিইসি ইত‍্যাদিতে সত‍্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম জড়িয়ে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে দিয়েছে।
বসু যেমন কণাপদার্থবিজ্ঞানে অসাধারণ অবদান রাখলেন, তাঁর সতীর্থ মেঘনাদ সাহা এগোলেন জ‍্যোতিঃপদার্থবিদ‍্যার ক্ষেত্রে। সাহা আয়োনাইজেশন ইকুয়েশন, থারমাল আয়োনাইজেশন, স্পেকট্রাম টেমপারেচর নিয়ে তাঁর অবদান বিশ্বজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নক্ষত্রের তাপমাত্রা নির্ধারণ ও তার ভিতরে কি কি পদার্থ রয়েছে, তার হদিশ করতে সাহার গবেষণা খুব মূল‍্যবান। সাহা ছিলেন খুব প্রতিভাবান বিজ্ঞান সংগঠক। ১৯৩০ সালে তিনি ন‍্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স গড়ে তোলেন। ১৯৩৪ সালে গড়েন ইণ্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, এবং ১৯৩৫ সালে গড়ে তোলেন ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স।
সাহা গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানগ্রন্থও রচনা করেছেন। ১৯৩১ সালে তিনি বি এন শ্রীবাস্তবের সঙ্গে একযোগে ‘ট্রিটিজ অন হিট” লেখেন। ১৯৩৪ সালে তিনি এন কে সাহার সঙ্গে “ট্রিটিজ অন মডার্ন ফিজিক্স” লিখেছেন।

সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহার পূর্বে ভারতে তত্ত্বগত পদার্থবিজ্ঞান চর্চায় পথিকৃৎ ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু ( ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ – ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭)। বয়সে সামান‍্যই বড় জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথেষ্ট হৃদ‍্যতা ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতাও লিখেছিলেন। রেডিও তরঙ্গ নিয়ে গবেষণায় জগদীশচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ১৮৯৪ সালে তিনি প্রথম মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ তৈরি করে দেখান। ওয়েভগাইড, হর্ন অ্যানটেনা, সেমি কনডাকটর ও ক্রিসটাল ডিটেকটর তৈরি করে তিনি রেডিও তরঙ্গ গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই ১৮৯৪ সালেই অলিভার লজ এবং আগুস্তো রিঘি স্বতন্ত্র ভাবে রেডিও তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেন। ১৮৯৫ তে গবেষণা করেছিলেন পিওতর লেবেদফ ও আন্দ্রে সি ক্লেভিয়ার।
তবে বলা দরকার, রেডিও তরঙ্গের গোড়ায় রয়েছে মাইকেল ফ‍্যারাডের গবেষণা। তাকেই বিকশিত করে তুলে জেমস ক্লার্ক ম‍্যাকসওয়েল দেখিয়েছিলেন দৃশ‍্যমান আলো, অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি, এগুলি সবই আসলে ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। এই গবেষণার সূত্র ধরেই হাইনরিশ রুডলফ হার্ৎজ ( ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ – ০১ জানুয়ারি ১৮৯৪) ১৮৮৭ সালে রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কার করেন।
জগদীশচন্দ্র বসুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, প্রিয়বন্ধু সম্ভাষণ করে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন:
“… আলোকের আঘাতে তনুতে
প্রতিদিন উঠিয়াছে চঞ্চলিত অণুতে অণুতে
স্পন্দবেগে নিঃশব্দ ঝংকারগীতি
… সতর্ক দেবতা যেথা গুপ্তবাণী রেখেছেন ঢাকি
সেথা তুমি দীপ্ত হস্তে অন্ধকারে পশিলে একাকী…”
রেডিও তরঙ্গের ব‍্যবহারিক যন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গুগলিয়েমো মার্কনি ( ২৫ এপ্রিল ১৮৭৪ – ২০ জুলাই ১৯৩৭) এবং জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ফার্দিনান্দ ব্রাউন ( ০৬ জুন ১৮৫০ – ২০ এপ্রিল ১৯১৮)। রেডিও তরঙ্গের সাহায্য নিয়ে বার্তাপ্রেরণের সরঞ্জাম গড়ে তোলায় মার্কনি ও ব্রাউন ১৯০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
রেডিও তরঙ্গের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হল রেডিও টেলিস্কোপ গড়ে তুলতে। মহাজাগতিক বস্তুগুলি হতে নানাবিধ তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ উৎসারিত হয়। এরমধ‍্যে অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি, এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি এবং রেডিও তরঙ্গ অন‍্যতম। ১৮০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে অতিবেগুনি রশ্মি আবিষ্কার করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী যোহান উইলহেলম রিটটার ( ১৭৭৬ – ১৮১০)।
সূর্যের আলোর সঙ্গে অবলোহিত রশ্মি ছুটে আসছে, এটা দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ জ‍্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল ( ১৫ নভেম্বর ১৭৩৮ – ২৫ আগস্ট ১৮২২)। সেটা ১৮০০ সাল। ১৮৬০ সালে গুস্তাভ কির্চহফ ও উইলিয়াম কোবলেনৎজ অবলোহিত রশ্মি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তারপর ১৮৭৮ সালে স‍্যামুয়েল পিয়েরপয়েন্ট ল‍্যাঙলে বোলোমিটার যন্ত্র তৈরি করে অবলোহিত রশ্মিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। ওই ১৮৭৮ সালেই টমাস আলভা এডিসন টাসিমিটার নামে যন্ত্র তৈরি করে ২৯ জুলাই তারিখে ঘটা একটি সূর্যগ্রহণের সময়ে সূর্যের করোনা বা কিরীটের তাপমাত্রা নির্ণয় করেন। হেনরি বেকারেল রেডিয়েশন বা বিকিরণ ব‍্যাপারটা আবিষ্কার করেন। পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে রশ্মি নির্গত হয়। একেই বলে বিকিরণ। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড দেখালেন ওগুলি আলফা রশ্মি ও বিটা রশ্মি। এদুটি চৌম্বক পরিবেশে বিক্ষিপ্ত হয়। ১৯০০ সালে পল ভিলার্ড নামে এক ফরাসি বিজ্ঞানী গামা রশ্মি আবিষ্কার করেন। এডুয়ার্ড আন্দ্রেদ নামে বিজ্ঞানী গামা রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ধারণ করেন। ১৮৯৫ সালের ০৮ নভেম্বর তারিখে এক্স রশ্মি আবিষ্কার করেছেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম কনরাড রন্টজেন ( ২৭ মার্চ ১৮৪৫ – ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩) এই এক্স রশ্মি আবিষ্কার করার জন‍্য পদার্থবিজ্ঞানে প্রথমবারের নোবেল পুরস্কারটি তিনি পান। সেটা ১৯০১ সাল।
এক্স রশ্মির উন্নয়নের সূত্রে উইলিয়াম কুলিজ ( ২৩ অক্টোবর ১৮৭৩ – ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫) এর কথাটা আসবে। তিনি এই উন্নতিটা ঘটিয়ে দিলেন ১৯১৩ সালে। আর এই উন্নততর যন্ত্রের সাহায্যে এক্স রে কী রোগ প্রশমনে কী পদার্থের কেলাসের গঠন চেনায় ব‍্যাপক ভূমিকা নিয়ে ফেলল।
ওই যে বদ্ধ কাচনলের ভিতরে পাতলা করে নেওয়া বাতাসের ভিতর জোরালোভাবে বিদ‍্যুৎ চালনা, ওর গোড়ায় আছেন হাইনরিশ গাইসলার ( ২৬ মে ১৮১৪ – ২৪ জানুয়ারি ১৮৭৯)। তিনি ১৮৫৭ সালে বদ্ধ কাচনলের ভিতরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে আলোর খেলা দেখেছিলেন। তাঁকে বদ্ধ কাচনল বানিয়ে দিতে বলেছিলেন আরেকজন জার্মান গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ জুলিয়াস প্লাকার ( ১৬ জুন ১৮০১ – ২২ মে ১৮৬৮)। গাইসলার ও প্লাকার এর কাজের সূত্র ধরে আরো দুই জার্মান বিজ্ঞানী গুস্তাভ রবার্ট কিরচহফ (১২ মার্চ ১৮২৪ – ১৭ অক্টোবর ১৮৮৭) ও রবার্ট উইলহেলম বুনসেন ( ৩০ মার্চ ১৮১১ – ১৬ আগস্ট ১৮৯৯) শেষপর্যন্ত বর্ণালি দেখে পদার্থ চেনার পথ তৈরি করে ফেললেন। গড়ে উঠল স্পেকট্রোস্কপি নামে বিজ্ঞান গবেষণার একটা শাখা। গাইসলার-এর পর ওই কাচনলের ভিতরের বাতাস আরো পাতলা করে আর বিদ‍্যুত প্রবাহের মাত্রা বাড়িয়ে আরো নানাবিধ বিষয় লক্ষ করেন জার্মান বিজ্ঞানী জোহান উইলহেলম হিটটর্ফ ( ২৭ মার্চ ১৮২৪ – ২৮ নভেম্বর ২৯১৪)। এই হিটটর্ফ সাহেব ১৮৬৯ সালে কাচনলে একধরনের আলো দেখতে পেলেন। ইউজিন গোল্ডস্টাইন ১৮৭৬ সালে তার নাম রাখলেন ক‍্যাথোডস্ট্রাহলেন বা ক‍্যাথোড রশ্মি। উইলিয়াম ক্রুকস ( ১৭ জুন ১৮৩২ – ০৪ এপ্রিল ১৯১৯) বদ্ধ কাচনলের ভিতরে লঘুচাপের বাতাসে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য মাত্রা জুড়লেন। তিনি করলেন কি, কাচনলের ভিতরে বাতাসের চাপকে দারুণ রকম কমিয়ে ফেলার কৌশল আবিষ্কার করে ফেললেন। সাধারণ ভাবে সমুদ্রের উপরিতলে বা সমুদ্র সৈকতে বাতাসের যে চাপ, তাকে বলে এক এটিএম। এটা সাতশ ষাট সেন্টিমিটার পারদ স্তম্ভের সমান চাম। বাতাসের চাপের অন‍্য দুই একক রয়েছে। তা হল পাস্কাল এবং টর। এক এটিএম হল ১০১৩২৫ পাস্কাল ও ৭৬০ টর এর সমান। যাই হোক বদ্ধ কাচনলের ভিতর বাতাসের চাপ কমাতে কমাতে এক এটিএম এর দশলক্ষ ভাগের একভাগ মাত্রায় এনে ফেললেন। গণিতজ্ঞের কাছে “দশলক্ষ ভাগের একভাগ” এর অর্থ হল দশমিকের পর পাঁচটি শূন‍্য লিখে তার পর এক লেখা। বাতাসকে এই মাত্রায় লঘু করে তার মধ‍্যে উচ্চমাত্রায় বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা ব‍্যাপারটা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নতুন নতুন আবিষ্কার ও চিন্তা ভাবনার দিক দিগন্ত খুলে দিল। এই সময়টা হল ১৮৭০ সাল।
কণাপদার্থবিজ্ঞানের যেন জন্ম হল বলতে হবে। অনেক আগে, খ্রীস্টজন্মের পাঁচ শ বছর আগে ডিমোক্রিটাস ভেবেছিলেন সব কিছুই অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। আইজ‍্যাক নিউটন (০৪ জানুয়ারি ১৬৪৩ – ৩১ মার্চ ১৭২৪) ভেবেছিলেন আলোও ছোট ছোট কণার আকারে আসছে। কিন্তু উইলিয়াম ক্রুকস যেভাবে ১৮৭৫ সালে ক্রুকস নল তৈরি করে দিলেন তার সূত্রে ইউজিন গোল্ডস্টাইন ক‍্যাথোড রশ্মি এবং ক‍্যানাল রশ্মিকে আলাদা আলাদা ভাবে চেনাতে পারলেন। এই ক‍্যানাল রশ্মির নাম পরে হল অ্যানোড রে (১৮৮৬)। এটা একটা ধনাত্মক কণার স্রোত হিসেবে তিনি চেনালেন। এই সূত্রে প্রোটনের আবিষ্কার সম্ভব হল। যদিও অনেক আগে, ১৮১৫ সালে উইলিয়াম প্রাউট তত্ত্বগতভাবে এমন ধনাত্মক কণার কথা বলেছিলেন, গোল্ডস্টাইনের অ্যানোড রশ্মি আবিষ্কার তাকে একটা বাস্তব ভিত্তি দিল। এই গবেষণার সূত্র ধরে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ৩০ আগস্ট ১৮৭১ – ১৯ অক্টোবর ১৯৩৭) ১৯২০ সালে প্রোটন আবিষ্কার করে ফেলেন।
এই ক্রুকস নলে কাজ করতে করতেই ১৮৯৭ সালে ক‍্যাথোড রশ্মিকে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রনের স্রোত হিসেবে দেখালেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ জন টমসন ( ১৮ ডিসেম্বর ১৮৫৬ – ৩০ আগস্ট ১৯৪০)। তিনি অবশ‍্য ইলেকট্রন নামটি দেন নি। তিনি ওই অতিক্ষুদ্র ঋণাত্মক কণাকে করপাসল বলে ডেকেছিলেন।
ক্রুকস নলে ক‍্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করতে করতে অ্যান্টিম‍্যাটারের ধারণা আনেন জার্মান ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স‍্যর ফ্রানজ্ আর্থার ফ্রিডরিশ সুসটার ( ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৫১ – ১৪ অক্টোবর ১৯৩৪)। সুসটারের গবেষণা কণাপদার্থবিজ্ঞানে একটা অন‍্যরকম রাস্তা খুলে দিল। তাঁর গবেষণার রেশ ধরে পল ডিরাক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। এই সূত্রে অ্যান্টিম‍্যাটারের ধারণা গড়ে ওঠে। পল ডিরাক, বা পল আড্রিয়েন মরিস ডিরাক ( ০৮ আগস্ট ১৯০২ – ২০ অক্টোবর ১৯৮৪) কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিষয়ে গভীর ও মৌলিক আলোকপাত করে সুপরিচিত। পল ডিরাক কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তাঁর অবদানের জন‍্য ১৯৩৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে একত্রে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন আরেক যুগন্ধর বিজ্ঞানী শ্রয়ডিঞ্জার, বা আরউইন রুডলফ যোসেফ আলেকজান্ডার শ্রয়ডিঞ্জার ( ১২ আগস্ট ১৮৮৭ – ০৪ জানুয়ারি ১৯৬১)। ১৯৩৫ সালে শ্রয়ডিঞ্জার বিড়ালকে নিয়ে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের এক বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্ব পেশ করেন। এই সঙ্গেই জানতে হবে উলফগ‍্যাং আর্নস্ট পাউলি ( ২৫ এপ্রিল ১৯০০ – ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৮) এবং ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ( ০৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ – ০১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬) এর কথা। হাইজেনবার্গ ১৯২৭ সালে তাঁর বিখ্যাত অনিশ্চয়তা সূত্র পেশ করেন। তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ‍্যা ও ম‍্যাট্রিকস তত্ত্বেরও স্রষ্টা। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৩২ সালে। আর পাউলির বড় মাপের অবদান ছিল কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে। তিনি ওই বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পরে, ১৯৪৫ সালে। প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা বিচার বিশ্লেষণ করতে গেলে ডিরাক, শ্রয়ডিঞ্জার, পাউলি ও হাইজেনবার্গ এর কথাটা আমরা একটু মনে রাখব।

পদার্থবিজ্ঞান চর্চায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কী রকম আগ্রহ ছিল তা ওঁর “বিশ্ব পরিচয়” বই পড়ে যেমন জানা যায়, আরো জানা যায় “সে” বইটি পড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সে’ গল্পে লিখেছেন:
তোমাদের বিজ্ঞান-মাস্টার তো সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বজগতে সূক্ষ্ম আলোর কণাই বহুরূপী হয়ে স্থূল রূপের ভান করছে। …
দেউলে হয়ে যাওয়ার মানেই তো আলো হয়ে যাওয়া।
আমি কোন্ রঙের আলো হব দাদামশায়।
সোনার রঙের।
আর তুমি?
আমি একেবারে বিশুদ্ধ রেডিয়ম।
(রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণ, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৮)
যে রশ্মি বেগনির সীমা পেরিয়ে গেছে তাকে দেখা যায় না বলেই সে মিথ‍্যে নয়, সেও আলো।
( তদেব, পৃষ্ঠা ৪৫৯)
সায়ান্সে অনেক বুজরুকি করছে। মরা মানুষের গান শোনাচ্ছে, দূরের মানুষের চেহারা দেখাচ্ছে, আর শুনছি সীসেকে সোনা করছে।
(তদেব, পৃষ্ঠা ৪৫৯ – ৪৬০)
সেদিন তো তোমাদের অধ‍্যাপক প্রমথবাবুর কাছে শুনেছিলে আলোক অণু পরমাণু বৃষ্টির মতো কণাবর্ষণও বটে আবার নদীর মতো তরঙ্গধারাও বটে। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, হয় এটা নয় ওটা; কিন্তু বিজ্ঞানের বুদ্ধিতে একই কালে দুটোকেই মেনে নেয়।
….
সত‍্যযুগের পুপে আপনার সীমানা বাড়িয়ে দিত বেড়ালের মধ‍্যে। সীমানা লোপ করত না। তুমি তুমিও থাকতে, বেড়ালও হতে।
( তদেব, পৃষ্ঠা ৪৬০)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।