T3 ক্যাফে কলমে – মৃদুল শ্রীমানী

“আন্দোলনরত শিক্ষককে পুলিশ লাথি মেরেছে”
এই ঘটনার বিরোধীতা করতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের একটা শ্রেণী পাল্টা বিবৃতি বা নিদান দিচ্ছেন যে কোনো শিক্ষক শিক্ষিকা যেন ওই পুলিশে কর্মীর সন্তানদের না পড়ান।
এটা আপনাদের কাছে কতোটা যুক্তি সঙ্গত?
ভারতীয় সংবিধান ও নাগরিকদের দায়িত্ব।
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর একা একা ভারতীয় সংবিধানটা লিখে ফেলেছেন, এমন নয়। আর ওই যে সংবিধান সংশোধন করা হয়, ওটা যে ভুলে ভরা একটি সংবিধানকে চলনসই করতে, সেটাও নয়। সংবিধানকে জানা দরকার, সাংবিধানিক অধিকার জানার সঙ্গে সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে শিক্ষা নেওয়া দরকার।
ভারতীয় সংবিধান তৈরি করেছেন কোনো একক ব্যক্তিত্ব নন, একটি টিম, কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি।
ভারত কিভাবে স্বাধীনতা পাবে, ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে পরিচালিত হবে সেই লক্ষ্যে ওই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি তৈরি করা হয়েছিল।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পূর্বমুহূর্তে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বৈঠক বসেছিল।
পরে ১৯৫০ সালে সংবিধান গৃহীত হবার পর এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি আর থাকার দরকার রইল না।
মনে রাখতে হবে, ভারতের স্বাধীনতা গড়ে তোলা আর তাকে সাংবিধানিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করতে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বিপুল ভূমিকা পালন করেছেন।
এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির ধারণাটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এনেছিলেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়। পরে তিনি র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজমের কথা বলতেন। সেটা ১৯৩৪ সাল। রায়ের চিন্তা কংগ্রেস নেতাদের প্রভাবিত করে। কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি ওঠে। ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি স্বীকৃত হয়। এই দাবির সূত্রে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের ১৯৩৫ সালের গভর্ণমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বর তারিখে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি ব্রিটিশ সরকারের সামনে উচ্চারণ করেন। তিনি প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গড়ে তোলার কথা বলেন। শেষমেশ ১৯৪০ সালের আগস্টে ব্রিটিশ সরকার এই দাবি মেনে নেন।
প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলিগুলি ভোটের মাধ্যমে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গড়ে তোলে। মোট ৩৮৯ জন সদস্য নিয়ে এই সভা গড়ে তোলার কথা হয়। এর মধ্যে প্রদেশগুলি থেকে ২৯২ জন, প্রিন্সলি স্টেটগুলি থেকে ৯৩ জন, চিফ কমিশনারের স্টেটগুলি থেকে আরো চার জন, এই হিসাব হয়। কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে। উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ২০৮ জন ও মুসলিম লীগের তরফে ৭৩ জন। এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের রাজেন্দ্র প্রসাদ। তিনি ছিলেন আইনবিশারদ পণ্ডিত, সাংবাদিক ও অর্থনীতির অধ্যাপক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন দুইজন, হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় এবং ভেঙ্গল থিরুভেঙ্কটাচারি কৃষ্ণমাচারি। মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষাবিদ ও খ্রিস্টান নেতা, এবং কৃষ্ণমাচারি ছিলেন আইসিএস ও গুণী প্রশাসক। কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সাংবিধানিক উপদেষ্টা ছিলেন বি এন রাউ। সংবিধান রচনা করা এই কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সংবিধানের খসড়া তৈরি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর। ২৯৯ জন সদস্য দুই বছর এগারো মাস আঠারো দিন ধরে পরিশ্রম করে ভারতের সংবিধান তৈরি করেছেন। এই কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ১৯৪৯ এর ২৬ নভেম্বরে অ্যাসেম্বলি এই খসড়া সংবিধানকে অনুমোদন দিয়েছিল। তারপরে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত রাষ্ট্র একে গ্রহণ করেন।
বহু গুণী মানুষের বহুদিন শ্রমের ফসল এই ভারতীয় সংবিধান। তার প্রাণসত্ত্বাকে রক্ষা করতে হবে।