কবি স্মরণে মৃদুল শ্রীমানী

ধর্মমোহ, মানুষের ধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ

অরূপরতন নাটকে একটা চমৎকার গান আছে। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে -/ ন‌ইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?। গানটা অত্যন্ত পরিচিত। ওই গানে দুচারটে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বললেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বললেন আমরা ন‌ই বাঁধা ন‌ই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে। তার আগে বললেন, আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তাঁর খুশিতেই চরি। এক জায়গায় বললেন, মোদের খাটো করে রাখে নি কেউ কোনো অসত‍্যে। প্রজার খুশি সেটা নাকি রাজার খুশির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! আর রাষ্ট্রশক্তি শাসনকার্যে কোনো অসত‍্যের আশ্রয় নিয়ে প্রজার অধিকারকে খাটো করে দিচ্ছে না। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে যে, সে আদতে দাসের রাজা। এইসব কথা বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মনে আধুনিক রাষ্ট্র আর জনপ্রশাসন নিয়ে একটা গভীর অ্যাকাডেমিক প্রশ্ন তুলে দিলেন। ওই গানটি গীতবিতানে স্বদেশ পর্যায়ের গানে দশ নম্বর স্থানে রয়েছে। এগারো নম্বরে যে গানটি, সেটাও বহুল প্রচলিত। সঙ্কোচের বিহ্বলতা গানে রবীন্দ্রনাথ বললেন, মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজের‌ই দিয়ো কঠিন পরিচয়। কাজটা কেমন তার আইডিয়াও দিয়েছেন কবি। দুর্বলকে রক্ষা করা, আর সেই রক্ষা করার কাজে দরকার পড়লে বিপক্ষকে আঘাত হানা, আর স্বনির্ভর হ‌ওয়া। নিজেকে দীন, নিঃসহায় না ভেবে প্রয়োজনে প্রাণ বাজি রাখা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার সন্তান ছিলেন। পরে এক সময় নিজে সেই ধর্ম সম্প্রদায়ের শীর্ষপদে আসীন ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজ নানা কারণে টুকরো টুকরো হয়ে আদি ব্রাহ্ম সমাজ, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ এবং সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে পর্যবসিত হলেও, অন‍্য অংশ গুলির কাছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত‍্যন্ত উঁচু মানের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের দুই উজ্জ্বল মেধাবী তরুণ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ এবং সুকুমার রায় প্রচার পুস্তিকা বের করে বলেছিলেন, কেন রবীন্দ্রনাথকে আমরা চাই। স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনও রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের ধর্মসভায় সভাপতির আসনে বরণ করেছিলেন। এসব থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব, উপনিষদের প্রভাব ও কবীর নানক রামানন্দের মতাদর্শ এবং বাউলের ভাবনা নানা মাত্রায় জড়িয়ে থাকলেও তাঁর মন ছিল আধুনিক মানবতার দিকে। তাঁর বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র চর্চা, উপনিষদ চর্চা তাঁকে সত‍্যচর্চায় উৎসাহিত করেছে; প্রাচীনপন্থার ফেরিওয়ালায় পর্যবসিত করে নি‌
সাধারণ ভাবে ধর্ম বাস্তব জগতে আচার অনুষ্ঠান হয়েই সীমিত থাকে। ইতরজনের ধর্মভাবনার গোড়ায় ভয়। ভয়ের উৎসকে অজ্ঞ মানুষ দেবতা করেছে। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৈবেদ্য কাব‍্যগ্রন্থের ত্রাণ কবিতায় বললেন, দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়। প্রার্থনা কবিতায় বললেন এমন এক রাষ্ট্রিক ও সামাজিক পরিবেশের কথা, যেখানে মানুষের চিত্ত ভয়শূন‍্য হবে। যেখানে তুচ্ছ আচার ন‍্যায়বিচারকে গ্রাস করবে না। সতর্ক করে আরো বলছেন, ক্ষমা পরম ধর্ম, কিন্তু তা যেন ক্ষীণতা ও দুর্বলতার নামান্তর না হয়ে ওঠে। এই এক‌ই ব‍্যাপারে ন‍্যায়দণ্ড কবিতাতেও তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। বলছেন, প্রত‍্যেকের হাতে ন‍্যায়ের দণ্ড রয়েছে; শাসনভার প্রত‍্যেকের ভিতর রয়েছে। ন‍্যায় ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সচেতন নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সে কাজে ভীত হলে চলবে না। এমনকি মানুষ সর্বশক্তিমানের সম্মান রাখতে, প্রয়োজন হলে তাঁর বিচারাসনে নিজের স্থান অধিকার করবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় এই সর্বশক্তিমানের সঙ্গে মরপৃথিবীর মানুষের সমকক্ষতা ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ করা দরকার।
যে ভক্তি অধৈর্য, বিহ্বলতাময়, ভাবোন্মাদনায় লিপ্ত, আর জ্ঞানহারা উদভ্রান্ত, তেমন ধরনের ভক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনাকাঙ্ক্ষিত‌ । নৈবেদ্য কাব‍্যগ্রন্থের অপ্রমত্ত কবিতায় এই চিন্তাধারা ধরা পড়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে আরো অন‍্যরকম ভাবে তিনি বিষয়টিকে লক্ষ করেছেন। ১৩৩৩ সালের ৩১ বৈশাখ রেলপথে যেতে যেতে লেখা ধর্মমোহ কবিতায় তিনি বলেন, অনেক যুগের লজ্জা ও লাঞ্ছনা,/ বর্বরতার বিকার বিড়ম্বনা/ ধর্মের নামে আশ্রয় দিল যারা/ আবর্জনায় রচে তারা নিজ কারা -। ওখানেই লিখেছেন, শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো/ শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো। আরো বছর পাঁচেক বাদে আরো স্পষ্ট, আরো সূচিমুখ বলিষ্ঠ কণ্ঠে পরিশেষ কাব‍্যগ্রন্থের প্রশ্ন কবিতায় বলেন, যারা পরিবেশ দূষিত করছে, বিচারকে কলুষিত করছে, অসহায় মানুষের উপর নিষ্ঠুর আক্রমণ হানছে, ভগবান তাদেরকে ক্ষমা করেছেন কি না, এবং ভালোবেসেছেন কিনা। ভেতরের ভাবখানা যেন এইরকম, যারা পৃথিবীর শান্তি ও সুস্থিতি বিনষ্ট করছে, তারা ক্ষমা ও ভালবাসা পাবার অযোগ্য। যদি ঈশ্বর তাদেরকে ভালবেসে থাকেন, ক্ষমা করে থাকেন, তাহলে ঈশ্বরের সে কাজটা ভাল হয় নি। এইখানেই দেখা গেল ঈশ্বর বা পরম ব্রহ্মের সমালোচনায় নশ্বর মানুষ মুখর হয়ে উঠছে। সেই ন‍্যায়দণ্ড কবিতার ঋজু ও স্পষ্ট উচ্চারণ, যেন রসনায় মম/ সত‍্যবাক‍্য ঝলি উঠে খরখড়্গ সম, শুধু এখানে আর ‘তোমার ইঙ্গিতে’ ব‍্যাপারটা নেই। ঈশ্বরের বিচারাসনে মানুষ নিজের স্থানটা নিয়ে নিয়েছে।
ধর্মধ্বজীদের কল্পনায় যে ঈশ্বর সত্ত্ব রজঃ তম, এই তিনগুণের ঊর্ধ্বে, যিনি ত্রিগুণাতীত নির্গুণ গুণময়, তাঁর বিচার করছে নশ্বর মানুষ। এ যেন সেই চণ্ডীদাসের কথা – শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত‍্য, স্রষ্টা আছে বা নাই।
অনেক আগেই, ১৩৩৩ সালে তিনি বলেছিলেন দেবতার শয়তান ভজনার কথা। আর ১৩৪৬ সালের ৯ পৌষ তিনি লিখছেন, মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি- / ঘাতক সৈন‍্যে ডাকি মারো মারো ওঠে হাঁকি। দুর্জনের যুদ্ধাস্ত্রে ঈশ্বরের নাম খোদাই হচ্ছে এও তাঁর চোখে পড়েছে। প্রথাগত ঈশ্বরের সঙ্গে যেন ত্রাসের রাজার একটা মেলবন্ধন ঘটে গিয়েছে। ঈশ্বর আর ধর্ম যেন শোষণ শাসনের অঙ্গ হয়ে উঠল। লক্ষ করেন, যারাই মানুষকে পায়ের নিচে রাখতে চেয়েছে তারা ধর্মমোহকে অস্ত্র করেছে। শেষ অবধি যেন ঈশ্বর ভাবনাকে ছেড়ে এক মানবভাবনার দিকে তাঁর যাত্রা। জীবনের একেবারে উপান্তে বাংলা ১৩৪৮ সালের বৈশাখের প্রথম দিনে (১৪.০৪.১৯৪১) শান্তিনিকেতনে বসে তিনি লিখছেন, ওই মহামানব আসে। লিখছেন, জয় জয় জয় রে মানব অভ‍্যুদয় মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।