বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ও দুইটি বধূ – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

১। নিরুপমা

ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেটের সাথে বিয়ে। তাও রায়সাহেবের বাড়িতে। সোজা ব‍্যাপার তো নয়! আদরের মেয়ে পরম সুখেই থাকবে। পাত্রের অভিভাবক পণ যা হাঁকলেন, তাতেই রাজি মেয়ের বাপ! ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট পাত্র, রায়সাহেব শ্বশুর! আকাশের চাঁদ। ভাবা যায়! কি করে টাকার যোগাড় হবে না ভেবে চিন্তেই একগলা জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মেয়ের বাপ। পুরো টাকাটা যোগাড় না হলেও বিয়ে আটকালো না। বিয়ে আটকাবে কেন? মেয়ে যে পরমা সুন্দরী! নিরুপমা নামের সাথে মিলিয়ে প্রকৃতি ওকে দিয়েছে কতো না ঐশ্বর্য!
ওইখানেই হল গণ্ডগোল। প্রকৃতি নিরুপমাকে শুধু শারীরিক সৌন্দর্য সৌষম‍্য ঢেলে দেন নি, দিয়েছেন কিছুটা বুদ্ধি, আর উঁচু মানের আত্মসম্মানবোধ। মেয়ে দেখতে পাচ্ছে তার সাধারণ মধ‍্যবিত্ত বাবা তাঁর সবটুকু উজাড় করে দিয়েও বেয়াইবাড়িতে মান পান না। পুরো টাকাটা গুণে দেওয়া যায় নি বলে মেয়ের বাপ সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেন। কেন দিলে বাবা টাকা? বাপের মুখ দেখে মেয়ে বুঝতে পারে, বকেয়া টাকাটা বেয়াই বেয়ানের নাকের ডগায় ছুঁড়ে দিয়ে নিজের সম্মান কিনতে চান বাবা। আর মেয়েকে মাঝে মাঝে বাড়িতে আনবার অধিকার।
মেয়ে দেখতে পায় শ্বশুর শাশুড়ি যেন তাকে ভাল চোখে দেখেন না। বাবা পুরো টাকাটা দিতে পারেননি বলে এত হেনস্থা! মেয়ের ক্ষোভ হয়। এদের তো টাকার লেখাজোখা নেই। কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। তবু কেন এত খাঁই! দিও না বাবা, টাকা দিও না। আমি কি নেহাতই একটা টাকার থলি, যে যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ মান? খবরদার বলছি বাবা, মোটেও টাকা আর দিও না।
মেয়েজীবনটা কি একটা বোঝা? পণ দিতে হবে কেন? বিয়ের সময় তিনি বলেছিলেন, যদিদং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম। বিয়েটা যদি হৃদয়ের সম্পর্কই হবে, তো টাকার জন‍্য হেনস্থা কেন? খবরদার বলছি বাবা, দিও না টাকা।
দাস দাসীরা আড়ি পাতে। শ্বশুরবাড়ির কর্তৃপক্ষের কানে ওঠে নতুন বৌ তার বাপকে কি শলাপরামর্শ দেয়।
স্বামী ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট। কর্মস্থলে এখনো ঠিকমতো বাসা খুঁজে পাওয়া যায় নি। চেষ্টা চলছে। বাসার বন্দোবস্ত হলে সুন্দরী বধূকে কাছে এনেই রাখবেন।
কিন্তু আর যে সয় না! মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে সম্মান পেতে এ কি পাগলামি শুরু করেছেন বাবা? নিজের গোটা পরিবারকে পথে বসানোর পথে নেমেছেন তিনি। বসতবাড়িটুকুই সম্বল। সেটুকুও বেহাত হলে দাদারা কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে কোথায় যায়! এ তুমি কি করলে বাবা? এই জীবনটা যে গরলায়িত হয়ে উঠল বাবা! যে বাড়িতে এসেছিলাম কল‍্যাণী বধূ হয়ে, সেখানে আজ আমি টিটকারির পাত্রী। এ আমার কি দশা হল! আত্মনিগ্রহ শুরু করে নিরুপমা। ঠিক করে খায় না। অবেলায় স্নান করে। ঠিক মতো চুল শুকায় না। এসব দেখে শাশুড়ি ঘিনঘিৎ কাটেন। ব‍্যঙ্গ করে বলেন, গরিবের বাড়ির ভাত ওঁর মুখে রোচে না। নিরুপমার জীবনটা কণ্টকশয‍্যা হয়ে উঠেছে। স্বামীকে কাছে পাওয়া আর হল না তার। তার আগেই জীবনপ্রদীপ নিভে গেল।
নিরুপমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল কে? তার শ্বশুরবাড়ির অর্থগৃধ্নুতা, না কি, তার বাবার আকাশের চাঁদ পাড়ার লোভ?
না কি, শ্বশুরবাড়ির উৎপাতকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে চলার বুকের পাটার অভাব?
নিজেকে বঞ্চিত করতে করতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে নিয়ে যাওয়া কি ভাল? আত্মনিগ্রহ ভাল?

২। বিনু

পলাতকা কাব‍্যগ্রন্থে ফাঁকি কবিতায় তেইশ বছর বয়সের একটা মেয়ের গল্প লেখেন রবীন্দ্রনাথ। ভারি অসুখ সে মেয়ের। নাম তার বিনু। একে তো শরীর নানা রকমারি রোগে কাহিল, তার উপর রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে মনের গভীর তলে। বছর দেড়েক ধরে চিকিৎসা চলছে বিবাহিত মেয়েটির। রোগের চিকিৎসা যত না হয়, বউটির উপর খবরদারি হয় তার চেয়ে বেশি। চিকিৎসার দাপটে ব‍উয়ের অস্থি জর জর। কিন্তু রোগ বশ মানার কোনো লক্ষণ নেই। পলাতকা কাব্যগ্রন্থে ফাঁকি কবিতায় বিনু নামে বউটি সম্পর্কে কবি লিখেছেন ব‍্যাধির চেয়ে আধি হল বড়। ব‍্যাধি যদি হয় শরীরের সমস্যা, আধি মানে মনের অসুখ। ব‍্যাধির চেয়ে আধি বড় হয়ে উঠলে তখন চিকিৎসার আর তেমন কিছু বাকি থাকে কি? উপায়ান্তর না দেখে শেষের দিকে ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বামী স্ত্রী মিলে চেঞ্জে যেতে।
হায় রে হিন্দু সনাতনী ভদ্রঘরের মেয়ে! বিয়ে বিনুর হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হিন্দু ঘরের বিয়ে মানে শক্তপোক্ত একটা বাঁধন, পলে পলে নিষেধের বেড়ি। তেইশ বছর বয়সের মেয়ের মনের ভিতর ঢুকে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। তার চোখ দিয়ে দেখান ভদ্রলোকের ঘরে বিবাহিত দম্পতির সম্পর্কটা কেমন। নিবিড় ঘন পরিবারের বাঁধন ততোধিক নিবিড়। এতটাই নিবিড় যে বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর কাছাকাছি আসাটাও রীতিমতো ঝঞ্ঝাটের। এমন নিবিড় ঘন পরিবারের ভিতর একটু নিভৃতে আপন করে কাছের মানুষকে পাওয়া ভারি দুর্লভ।
কবি লিখছেন, স্বামীর সাথে বিনুর মিলন ছিল ছাড়া ছাড়া। ওই ‘ছাড়া ছাড়া’ শব্দের ইঙ্গিতে ওদের দাম্পত্যের ফাঁকটাকে বিদ্রূপ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেন, স্বামী স্ত্রীর দেখাশোনা হত, কিন্তু তাল ছিল ভাঙা। কখনো সমে পৌঁছত না। দেড় বছর ধরে চিকিৎসার পরে ডাক্তার যে বিনুর স্বামীকে বললেন ব‍উটাকে চেঞ্জে নিয়ে যেতে, সেটা শারীরিক ভাবে রোগখিন্ন, মানসিক ভাবে আধমরা, আত্মিক ভাবে নিরানন্দ মেয়েটার চিকিৎসার আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না বলেই। এই চেঞ্জে যাওয়ার কথাটা যেন ডাক্তারের শেষ টোটকা।
কিন্তু এটাই, এই মরণোন্মুখ মেয়ের জন্য ডাক্তারের এহেন পরামর্শই যেন একটা অসামান্য সুযোগ হয়ে এল তেইশ বছরের মেয়েটির কাছে। কেন, যদি প্রশ্ন করেন, কবি বলবেন, বিয়ের পরে বিনু এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোনোর সুযোগ পেল। তার উপর এবারই সে জীবনে প্রথম রেলগাড়ি চড়বে। বিনু জানে এই মরপৃথিবীতে হেঁটে চলে শ্বাস নিয়ে বাঁচার মেয়াদ তার ফুরিয়ে এসেছে। তবুও সনাতনী ভদ্র হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের প্রথাগত শাসনের নিগড় ছেড়ে এই তো তার একটুখানি বুক ভরে বাতাস নেবার সুযোগ। এই সুযোগটাকে তেইশ বছরের মেয়েটা একটা নতুন রকম বিয়ের মতো ভাবছে। বাছাই করা শব্দযোজনায় রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দেন।
এই বেরোনোর সুযোগটাই বিনুকে কী রকম একটা খুশি খুশি মেজাজ দিয়েছে। একটার পর একটা শব্দ তুলে এনে বিনুর খুশিয়ালির চিত্রটি আঁকেন। বর বধূকে বরণের চিত্রকল্প আঁকেন, শুভদৃষ্টির কথা আনেন, চিরপ্রেমের কথা বলেন। বলেন বিনু নিজের আনন্দকে বিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কল‍্যাণী রূপ নিয়েছে। পুরোনো সংসারটাকে ভাঙা ঘাটের মতো ফেলে রেখে তার একলা ভাসান। ভাসান কথাটিকে এক মেধাবী প্রজ্ঞায় ব‍্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ। দেবীর ভাসান হয়, নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে যায় কৈলাসের দিকে। মেনকা গিরিজায়া চোখে আঁচল চাপা দেন। তেইশ বছরের মেয়ের ভাসানের ছবি আঁকেন রবীন্দ্রনাথ।
কবি লেখেন চলার পথে বিনুর সবটাতেই খুশি। যাত্রাপথে রেলগাড়ি বদল করার কথা বিলাসপুর স্টেশনে। পরের গাড়ি আসতে ছয় ঘণ্টা বাকি। থাকতে হবে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে। হিসেবি, সংসারী, সাবধানী লোকে এই ছয়ঘণ্টা কাল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কাটানোকে আপদ বালাই বলেই মনে করবেন। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের পর প্রথম বেরোতে পারার আনন্দে বিনুর মনটা একেবারে টইটম্বুর হয়ে আছে। গাড়ি বদলের জন্য এই ছয়ঘণ্টা কাল অজানা অচেনা স্টেশনে বিনা কাজে পড়ে থাকাকেও বিনুর মনে হল এ তো বেশ।
কবি বলেন পথের বাঁশি তাকে ডাক দিয়েছে। বলেন যে সে আজ চঞ্চলা। সনাতনী ভদ্র পরিবারের গৃহলক্ষ্মী বিনু। পথের বাঁশি সেই লক্ষ্মীকে চঞ্চলা করে দিয়েছে। প্রবীণ কবি বিনুর মধ‍্যে পৌঁছনো আর চলার সমীকরণ খুঁজে পান। বিনুর যেন পথ চলাতেই আনন্দ।
তার পরের গল্পটা পাঠকের জানা। মরণোন্মুখ বিনু হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া স্বাধীনতাকে আঁকড়ে ধরে মনের খুশিতে কল‍্যাণী রূপ ধরে যাত্রাপথে অভাবী অসহায় মানুষের ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট ঘোচাতে চেয়েছিল। নিরানন্দ ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে নতুন করে পাওয়া আনন্দের ছোঁয়ায় বিনু চেয়েছিল পরের দুঃখে সমব‍্যথী হয়ে নিজের সৌভাগ্যকে একটা স্নিগ্ধ পবিত্র রূপ দেবে।
পথের কাঙাল ভিক্ষা করে। বিনু নিজের হাতবাক্স থেকে তার অতি সামান্য সঞ্চয়ের একটু একটু অংশ তাদের দিতে চায়। ছুটন্ত রেলগাড়ি থেকে সুস্থির সৌজন্যপূর্ণভাবে ভিক্ষা দেবার পরিস্থিতি নেই। চলন্ত গাড়িতে থাকা যাত্রীর পক্ষে পথের কাঙালকে ভিক্ষা দিতে চাইলে পয়সা ছুঁড়ে না দিয়ে উপায় থাকে না। বিনুর পক্ষেও তাই। তাকেও পয়সা রেলগাড়ির জানলা গলে ছুঁড়েই দিতে হয়। কিন্তু কবি বলেন, বিনু পয়সাটুকু ছোঁড়ে কাগজে মুড়ে। তার দেহ রোগজর্জর, তার মন ছিল শ্রান্ত অবসন্ন, কিন্তু তার নতুন পাওয়া ছুটি তার অন্তরতর কল‍্যাণী রূপকে সঞ্জীবিত করেছে। পয়সা ছোঁড়ার সময়ে সেটি কাগজে মুড়ে দেবার যত্নটুকুতে বিনুর সেই চেহারাটা দেখতে পাই।
হিসেবি সংসারী সাবধানী মানুষের চোখে পথে ছুটতে ছুটতে এভাবে ভিক্ষা দিয়ে যেতে থাকা একেবারে অপচয়ের নামান্তর। রুকমিণি নামে যে কুলিবউটা রেল স্টেশনের যাত্রীঘরের শৌচাগারে সাফাইয়ের কাজ করে, তাকে কন‍্যাদায় থেকে উদ্ধার করার জন্য বিনুর মাতৃস্নেহকে হিসেবি ভদ্রলোক তাঁকে দেউলিয়া করে দেবার মতলব ঠাউরালেন। ঝামরু কুলির বউটাকে আড়ালে ডেকে চোখ পাকিয়ে কড়কে দিলেন ভদ্র গৃহস্থটি। এমন কি সাফাইকর্মী মেয়েটির চাকরি খেয়ে দেবার ভয় দেখাতেও তাঁর বাধল না। অথচ এই ভদ্রলোক বিনুর কাছে ভান করলেন স্বামী হিসেবে বধূর আবদারটুকু যেন তিনি মিটিয়েছেন।
এইখানেই ফাঁকি। ভদ্রগৃহস্থ উপলব্ধি করতে পারেন না যে মরণোন্মুখ বিনু কী অসহায় আশায় জীবনকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। ঝামরু কুলির মেয়ের বিয়ে বাবদে পঁচিশটা টাকার খয়রাতি বিনুর সেই আকুতির কাছে অতি নগণ্য। কিন্তু তা ইংরেজি নভেল পড়া বাবুর বোঝার বাইরে রয়ে গেল। সংসারে থাকতে তাদের মিলন ছিল ছাড়া ছাড়া। কবি বলেছেন দাম্পত্য ছিল ভাঙা লয়ের তালে। সে সময়ে ধারে পাশে ছিল শ্বশুর ভাশুরের কড়া উপস্থিতি। এমন পরিবেশে দাম্পত্য ছিল আড়ষ্ট। প্রেমের সহজ উদ্ভাস ছিল কল্পনার বাইরে। স্বামী স্ত্রীর নৈকট্য ছিল নিশুতি রাতের ঘেরাটোপের আড়ালে। বাইরে বেড়াতে এসেও নভেল পড়া বাবুর ভিতরের সেই গেড়ে বসা ঘেরাটোপ ঘুচল না। মরণাপন্ন স্ত্রীর প্রকৃত জীবনসাথী হয়ে ওঠার চাইতে, বধূর অন্তিম লগ্নের ইচ্ছাপূরণের চাইতে টাকা পয়সার হিসাবটি বড়ো করে দেখলেন ভদ্রলোক। আর নিজের অনুদার মনটাকে আড়াল করে একটা কৃত্রিম পরিবেশ জারি রাখলেন। এইখানেই ফাঁকি।
“পলাতকা” কাব্যগ্রন্থে “ফাঁকি” কবিতায় এক অসহ্য যন্ত্রণায় প্রেমবিবর্জিত এক দাম্পত্যকে উন্মুক্ত করে দেখান রবীন্দ্রনাথ।
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে নিরুপমা আর বিনু আমায় খুব ভাবাচ্ছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।