ছোটবেলায় বলতাম, একথালা সুপারি, গুণতে পারে না ব্যাপারী। এটা একটা চালু ধাঁধা। এর উত্তর হল আকাশভরা তারা। তখন ভাবতাম গুণতে না পারার আছে টা কি? ধৈর্য ধরে গুণে গেলেই তো হল! তারপর শুনলাম বীরবলের কথা। বীরবল কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের মত স্থূল রসিকতার কারবারী নন। কিঞ্চিৎ শাণিত গ্রে ম্যাটার তাঁর আছে।
কিন্তু মোল্লা নাসিরউদ্দিন তুল্য সূক্ষ্ম দার্শনিক বোধ কি তাঁর আছে? বাদশা বীরবলকে বললেন আকাশের তারার সংখ্যা গণনা করতে।
বীরবল না কি একটা হৃষ্টপুষ্ট ভেড়া এনে বলেছিলেন এর গায়ে যত লোম আছে, আকাশে তত তারা রয়েছে। বীরবলের পরিবেশ ও সময়ের অনুপাতে বীরবলের ধারণাটি যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিল।
আমার কৈশোরকালে বড় জিনিস গুণে দিলেন অ্যাভোগ্যাড্রো।
লোরেঞ্জো রোমানো অ্যামেদিও কার্লো অ্যাভোগ্যাড্রো ছিলেন ইটালিয়ান ভদ্রলোক। আজ ৯ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। ১৭৭৬ সালে জন্মেছিলেন। বেঁচে থাকলে আজকের দিনে বয়স হত ২৪৪ বৎসর। মারা গিয়েছিলেন ১৮৫৬ সালের ৯ জুলাই।
১৮১১ সালে, যখন অ্যাভোগ্যাড্রোর বয়স পঁয়ত্রিশ, তখন একটি বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লিখে তিনি বললেন, একই রকম তাপ আর চাপে একই পরিমাণ গ্যাসে একই সংখ্যক অণু থাকবে। চাপ ও তাপে গ্যাসের আয়তনের হেরফের নিয়ে বয়েল, চার্লস আর গে লুসাক নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। অ্যাভোগ্যাড্রো বললেন, একই রকম পরিবেশে একই তাপে ও চাপে সম পরিমাণ গ্যাসের প্রাথমিক পদার্থের, সেটা অণু পরমাণু যাই হোক না কেন, তার সংখ্যাটা একই রকম। এটাকে তিনি বললেন প্রকল্প বা হাইপথিসিস। হাইপথিসিস কেন? না, তখনো তো যুক্তি ও বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে জিনিসটা প্রমাণিত হয়নি। ওই যে কথাটা অ্যাভোগ্যাড্রো বললেন, ওই কথার সূত্র ধরে ১৮৬৫ সালে যোহান যোসেফ লসচমিট একটা অণুর আয়তন সম্বন্ধে ধারণা করলেন। ১৯০৯ সালে জাঁ ব্যাপটিস্ট পেরিন এই অণুর সংখ্যা নিয়ে গভীর আলোকপাত করলেন।
অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা বলতে জাঁ ব্যাপটিস্ট পেরিন বোঝালেন, অকসিজেন এর এক গ্রাম মলিকুল পরিমাণে মলিকুলের সংখ্যা। এটাকেই তিনি অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা বললেন। পরে ধারণা করা হল কারবন ১২ র ০.০১২ কিলোগ্রাম পরিমাণে যত সংখ্যক অণু পাওয়া যায়, সেটাই অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা।
অ্যাভোগ্যাড্রোর সমসাময়িক বিজ্ঞানী ছিলেন জন ডালটন ( ০৬ সেপ্টেম্বর, ১৭৬৬ – ২৭ জুলাই, ১৮৪৪)। ১৮০১ সাল নাগাদ জন ডালটন গ্যাসের চাপ নিয়ে সন্দর্ভ লিখেছিলেন। ডালটন সাহেব হাইড্রোজেন এর অ্যাটমিক ভরকে ১ ধরে অন্যান্য পদার্থের তুলনামূলক ভর নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেন। ১৮০২ সাল থেকে নানা গবেষণা করতে করতে শেষ পর্যন্ত সেটা ১৮০৫ নাগাদ প্রকাশিত হয়।
এঁদের সমসাময়িক সুইডিশ বিজ্ঞানী জনস জ্যাকব বার্জেলিয়াস ( ২০.০৮.১৭৭৯ – ০৭.০৮.১৮৪৮) হাইড্রোজেনের পরিবর্তে অকসিজেনকে ১০০ ধরে নিয়ে পদার্থের তুলনামূলক ভর নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন। সেটা ১৮১৮ সাল নাগাদ।
অ্যাভোগ্যাড্রো একটা কাজ করলেন। তিনি মলিকুল এবং অ্যাটম, অণু এবং পরমাণুর ধারণার গোড়াপত্তন করে দিলেন। অ্যাটম নামটি তিনি দিয়ে উঠতে পারেন নি, কিন্তু অমন ছোট্ট একটা জিনিস যে আছে, তা তিনি বলে গিয়েছিলেন। ওই যে একই রকম পরিস্থিতিতে, একই রকম চাপে ও তাপে একই পরিমাণ আলাদা আলাদা গ্যাসের অণুর সংখ্যার অভিন্নতা নিয়ে বললেন অ্যাভোগ্যাড্রো, যাকে পরে চেনানো হল “মোল” বলে, সেই মোল কথাটা জার্মান উৎস থেকে কুড়িয়ে আনলেন বাল্টিক জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিডরিশ উইলহেল্ম অসওয়াল্ড ( ০২.০৯.১৮৫৩ – ০৪.০৪.১৯৩২)। ১৮৯৪তে তিনি কথাটা চালু করতে শুরু করলে, ১৮৯৭ থেকে বিস্তর বিজ্ঞানী মোল কথাটাকে গ্রহণ করলেন। অসওয়াল্ড তাঁর কাজের জন্য ১৯০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
বার্জেলিয়াস পদার্থের তুলনামূলক ভর নির্ধারণের প্রশ্নে অকসিজেনকে মান্য ও গ্রহণযোগ্য ধরে নিয়ে কাজ করলেন।
জাঁ ব্যাপটিস্ট পেরিন (৩০.০৯.১৮৭০ – ১৭.০৪.১৯৪২) ছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী। তিনিই “অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা” এই শব্দটি চালু করেন। সেটা ১৯০৯ সাল। এক গ্রাম মলিকুল অকসিজেন ১৬ এ অণুর সংখ্যাকে অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার আগে ১৯২৩ সালে ওই পদার্থবিজ্ঞানেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবার্ট অ্যাণ্ড্রুজ মিলিকান ( ২২.০৩. ১৮৬৮ – ১৯.১২. ১৯৫৩)। তিনি ১৯১০ সালে পরমাণুর অতি ক্ষুদ্রকণা ইলেকট্রনের চার্জ নির্ধারণ করে এই সম্মান পেয়েছেন।
১৯৬০ এর দশক থেকেই অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যাকে আরো নিখুঁত করে জানতে চেয়ে নির্ভরযোগ্য পদার্থের আসন থেকে অকসিজেন ১৬ কে সরিয়ে দিয়ে কারবন ১২ এর কথা ভাবা হতে থাকে। বলা হয়, বারোগ্রাম কারবন ১২ তে যতগুলি প্রাথমিক পদার্থ রয়েছে সেটাই হল অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা। ১৯৭১ সালে বিআইপিএম বা ইন্টার ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ওয়েটস অ্যাণ্ড মেজারস এর চৌদ্দতম কনফারেন্সে তা গৃহীত হল। তবে কারবন ১২ দীর্ঘদিন মান্য পদার্থের আসনে থাকতে পারল না। বিজ্ঞানের আসরে কোনো জিনিসটাই স্থির ও অনড় নয়। যুগে যুগে তার পরিশীলন ও পরিবর্তন হয়। ২০১১ সালে সি জি পি এম বা জেনারেল কনফারেন্স অন ওয়েটস অ্যাণ্ড মেজারস এর চব্বিশতম চিন্তন বৈঠকে এই এককটিকে বদলে দেবার মতলব আঁটা হয়। কাজ এগোতে এগোতে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে ফ্রান্সের ভার্সাইতে ওই সিজিপিএম এর ৬০ তম কনফারেন্সে বলা হল ৬.০২২১৪০৭৬ কে একের পিছনে তেইশখানা শূন্য দিয়ে গুণ করলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায়, ওটাই অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা।
আজ অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যা বিজ্ঞানের একটা নিয়ম বলে পরিগণিত। বহু দেশের বহু বিজ্ঞান সাধকের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় তা হাইপথিসিস থেকে নিয়মের মান্যতা পেয়েছে।