আন্তর্জাতিক বিড়াল দিবসে মৃদুল শ্রীমানী

আজ আগস্টের আট তারিখটি আন্তর্জাতিক বিড়াল দিবস। বিড়ালের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির মানসে গত ২০০২ সাল থেকে সারা পৃথিবীর বিড়ালপ্রেমী মানুষেরা আগস্টের আট তারিখে মার্জারকুলের হিতসাধনার্থ যৎপরোনাস্তি সচেষ্ট হয়েন।
আমি ছোটবেলায় জানতাম বিড়াল হল বাঘের মাসি। আর বাঘ ছিল আমার মাতুলস্থানীয়। তাই বিড়ালের সাথে আমার মাতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক। পরে জানলাম বাঘ, সিংহ, এরা সব ক‍্যাট ফ‍্যামিলি। বাঘকে বিগ ক‍্যাট বলা শিখে নিলাম।
 ছোটবেলা থেকেই আমি লেখাপড়ার ব‍্যাপারে ভীষণ অমনোযোগী। এই কারণে আমার অভিভাবক একজন কড়া গৃহশিক্ষকের সন্ধান করেছিলেন। বাজারে তাঁর সুনাম ছিল যে তিনি ছাত্রদের যত না পড়ান, তার কয়েকগুণ বেশি বেত্রাঘাত করে থাকেন। শিক্ষকটিকে সকলে কানাইমাস্টার বলে ডাকত।
একদিন বিকেলে তিনি এলেন আমাকে দেখতে। হাতে বেত সেদিন আনেননি, তবে ছড়ি ছিল। বিকেলে খেলতে যাওয়া মাথায় উঠল। কানাইমাস্টার সিঙাড়া ও রসগোল্লা সহযোগে জলযোগ করে আমায় বললেন, কি, পড়তে তোমার ভাল লাগে?
শুনে হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছি না, এমন সময় হুকুম হল একটা কবিতা বল।
রবিঠাকুরের কবিতা ছেলেবয়স থেকেই মুখস্থ ছিল।
আমি শুরু করলাম,
আমি আজ কানাইমাস্টার,
 পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি,
আমি ওকে মারি নে মা বেত,
মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
অতটুকু ছেলের কবিতা পছন্দের ধরণ দেখে কানাইমাস্টার বিষম খেলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন কিছুতেই তিনি এমন একটা বদ বাঁদরকে পড়াবেন না। শুনেছি তিনি আমার অভিভাবক কে বলেছিলেন, যে ছেলের হাড়ে হাড়ে এমন বজ্জাতি, তাকে মাস্টার রেখে পড়ানোর চাইতে টাকা কটা জলে ফেলে দেওয়া ভাল। আর মাধ‍্যমিকের গণ্ডি টপকানো এমন ছেলের দ্বারা সম্ভব নয়।
তাই শুনে মাধ‍্যমিক পাশ করা অবধি আমার পিতৃদেব আমাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিলেন। কোনো মাস্টারের কাছে পড়তে হয় নি।
তো বিড়ালের সাথে সম্পর্কের সেই শুরু। বিড়াল নিয়ে প্রবাদবাক‍্য‌ও কানে আসত। শিকারী বিড়াল গোঁফ দেখলেই চেনা যায়। ঠেলায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। বিড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোঁবো না, দীক্ষা নেব, কাশী যাব। তার পরে ধরলুম সুকুমার রায় (৩০.১০.১৮৮৭ – ১০.০৯.১৯২৩)।
বিড়ালকে তিনি রুমাল থেকে বের করে আনতে পারতেন। বিড়ালের সাথে হৃদ‍্যতার আরেক পর্ব শুরু হল। সে অবশ‍্য বুদ্ধিদীপ্ত বিড়াল।
লীলা মজুমদার নিজের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে বিড়ালের কথা বলেছেন। কিশোরী মেয়েদের কোলে বিড়াল কে না দেখেছি! সোফায় বিছানায়  আদুরে বিড়ালের ছড়াছড়ি।
বিড়ালকে তাড়া করা বা লাঠিপেটা করা বারণ ছিল। কেননা, তারা ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন। ইন্দিরার ছোটছেলে মা ষষ্ঠীর কৃপার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাইতে তিনি বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। আশির দশকের গোড়ায় বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে বঙ্গের যে পুলিশপুঙ্গব এস‌ইউসির তরুণী মেয়েদের নির্মমভাবে লাঠিপেটা করতে কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করত না, তারাও বেড়ালছানাটি দেখলে লাঠিপেটা করত না।
বেড়ালের সঙ্গে গভীরতর পরিচয় করিয়ে দিলেন পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ। কথামৃত পড়া অভ‍্যাস করেছি সদ‍্যোতারুণ‍্যেই। মা বেড়াল তার ছানাটিকে নিয়ে কার্ণিশ বেয়ে চলে যায়। শিশু নিশ্চিন্তে মাকে জড়িয়ে থাকে। ওই রকম ইষ্টভক্তির কথা বলেছেন পাগল ঠাকুরটি। সাংঘাতিক দেখার চোখ ছিল লোকটার!
বেড়ালের সাথে গাঢ়তর পরিচয় করালেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( ২৭.০৬.১৮৩৮ – ০৮.০৪.১৮৯৪)।
 কমলাকান্তের দপ্তর যে কতবার পড়েছি! ভীষ্মদেব খোষনবীশের কাছে আফিঙখোর কমলাকান্ত তার খাতা রেখে চলে যায়। সেই লেখা থেকে বিড়াল অংশটা গভীরভাবে পড়েছি। খানিকটা শুনতে পারেন –
দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না । মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নরদমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না । তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে ! হায় ! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে ? আমার মত দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে কখন অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা ফাপরে পড়িলে রাত্রে ঘুমায় না—সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর ! ছি ! কে হইবে ? – “দেখ, যদি অমুক শিরোমণি, কি অমুক ন্যায়ালঙ্কার, আসিয়া তোমার দুধটুকু খাইয়া যাইতেন, তবে তুমি কি তাহাকে ঠেঙ্গা লইয়া মারিতে আসিতে ? বরং যোড়হাত করিয়া বলিতে, আর একটু কি আনিয়া দিব ? তবে আমার বেলা লাঠি কেন ?
আরো শুনুন
আর আমাদিগের দশা দেখ—আহারাভাবে উদর কৃশ, অস্থি পরিদৃশ্যমান, লাঙ্গুল বিনত। দাঁত বাহির হইয়াছে—জিহ্বা ঝুলিয়া পড়িয়াছে—অবিরত আহারাভাবে ডাকিতেছি, “মেও ! মেও । খাইতে পাই না —” আমাদের কাল চামড়া দেখিয়া ঘৃণা করিও না ! এ পৃথিবীর মৎস্য মাংসে আমাদের কিছু অধিকার আছে। খাইতে দাও—নহিলে চুরি করিব।” আমাদের কৃষ্ণ চৰ্ম্ম, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ মেও মেও শুনিয়া তোমাদিগের কি দুঃখ হয় না ? চোরের দণ্ড আছে, নির্দয়তার কি দণ্ড নাই ? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কার্পণ্যের দণ্ড নাই কেন ? তুমি কমলাকান্ত, দূরদর্শী, কেন না আফিঙ্গখোর, তুমিও কি দেখিতে পাও না যে, ধনীর দোষেই দরিদ্রে চোর হয় ?
কমলাকান্তের বিড়াল থেকে আর একটু
অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ আইসে নাই।” আমি আর সহ‍্য করিতে না পারিয়া বলিলাম, “থাম ! থাম মার্জারপণ্ডিতে ! তোমার কথাগুলি ভারি সোশিয়ালিষ্টিক ! সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল । যদি যাহার যত ক্ষমতা, সে তত ধনসঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নিৰ্ব্বিঘ্নে ভোগ করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধনসঞ্চয়ে যত্ন করিবে না । তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হইবে না ।” মার্জার বলিল, “না হইল ত আমার কি ? সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি । ধনীর । ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কি ক্ষতি ?” আমি বুঝাইয়া বলিলাম যে, “সামাজিক ধনবৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।” বিড়াল রাগ করিয়া বলিল যে, “আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কি করিব ?
পড়ি আর ভাবি, এই মার্জারকুলতিলক যদি এই করোনাযুগ দেখত, তাহলে করোনা রোধে কি কি পরামর্শ দিত।  ইয়েস ব‍্যাঙ্কের দায় স্টেট ব‍্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপানো নিয়ে কি বলত, আর তিন হাজার কোটি টাকার স্ট‍্যাচু অফ ইউনিটি নিয়েই বা কি বলত!
বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সেই জমিতে কি হবে, সেই নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যে কমলাকান্তের বিড়াল কিভাবে ব‍্যাখ‍্যা করত ভাবলেও শিহরিত হ‌ই।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭৫ সালে নিজের সাঁইত্রিশ বছর বয়সে কমলাকান্তের দপ্তরের প্রথম সংস্করণ বের করেন।
তার দশবছর আগেই বেরিয়েছে আজবদেশে অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চার। তারিখটা ছিল ১৮৬৫ সালের নভেম্বরের ছাব্বিশ তারিখ।
বেরোনোর পর আজবদেশে অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চার দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে ছিল। সাতানব্ব‌ইটা ভাষায় সে ব‌ই অনূদিত হয়েছে। লেখকের নাম চার্লস লুট‌উইজ ডজসন ( ২৭.০১.১৮৩২ – ১৪.০১.১৮৯৮)।  অ্যালিস’স অ্যাডভেঞ্চার ইন ওয়াণ্ডারল‍্যাণ্ড যতটা শোনা, লেখকের নাম ততটা শোনা নয় মনে হচ্ছে? আচ্ছা। লেখকের কলমের নাম হয় লুই ক‍্যারল।
অ্যালিস নামে বাচ্চা মেয়েটির সাথে দেখা হয় এক চেশেয়ার বিড়ালের। ধ‍্যাৎ, অমনতর কোনো বেড়াল হয় না কি? আরে মশাই কল্পনার বেড়াল। এবং দার্শনিক বেড়াল। সে বেড়ালের বৈশিষ্ট্য হলো তার গোটা চেহারাটা মিলিয়ে যায় শুধু তার দেঁতো হাসিটুকু ঝুলে থাকে। ঠিক আজকের দিনে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার মতোন।
সে শয়তান বেড়াল কি বলে জানেন, বলে , হাউ ডু য়ু রান ফ্রম হ্বোয়াট ইজ় ইনসাইড ইয়োর হেড? তোর মাথার ভিতর যেসব জিনিস কিলবিলোচ্ছে, তার হাত ছাড়িয়ে তুই পালাবি কোথা?
বদমাইশটা  আবার বলে, আমি জানি আজ সকালে আমি কে ছিলুম, কিন্তু তারপর এবেলায় আমি বেশ কবার বদলে গিয়েছি।
আরো বলে, আমি কি পাগল হয়ে গিইচি? ভয় কচ্চে, পাগল‌ই বুঝি হলুম, শোনো, কানে কানে এট্টা কথা ক‌ই, কাউরে কয়ো না কিন্তুক, এই দুনিয়ার সেরা সেরা লোকগুলান সব এক্কেরে পাগল….
এর উপর আর কথা হয় না।..
জীবনানন্দের সঙ্গেও মাঝে মাঝে দেখা হত এক বেড়ালের। তবে তাকে নিয়ে কয়েক পংক্তি কবিতা লেখা ছাড়া তিনি আর কিছু লেখেন নি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।