|| রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা “ওরা কাজ করে” || মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা “ওরা কাজ করে”

‘যাত্রা’ নামে কবিতাটি “বিচিত্রিতা” কাব্যগ্রন্থে লেখার অনেক পরে “ওরা কাজ করে” কবিতাটি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। মাঘ সংক্রান্তির শেষে, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ১ ফাল্গুন তারিখে লেখেন কবিতাটি। ইংরেজি দিনপঞ্জীতে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১ এ শান্তিনিকেতনে বসে লেখা কবিতাটি। স্থান পেয়েছে ‘আরোগ্য’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৪১ সাল কবির জীবনের অন্তিম বৎসর। মৃত্যু এসে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে যায় প্রবীণ কবির বোধের দুয়ারে। আর তার ওপারে ইতিহাস ও দর্শনের বোধ দিয়ে মহাজীবনকে খোঁজার চেষ্টা করেন দার্শনিক কবি। অথবা বলা ভাল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবনকে অতিক্রম করে পার্থিব মানবজীবনের ধারাবাহিক সংগ্রাম ও উত্তরণকে লক্ষ্য করেন কবি। ঘটনার ঘনঘটা বিপুল বিকট চেহারা নিয়ে এলেও তার ওপারে সত্যতর যা আছে, গভীর ইতিবাচক বোধ থেকে তাকে চিনতে চান রবীন্দ্রনাথ। “ওরা কাজ করে” কবিতায় সেই বৃহৎ জীবনসত্যকে খোঁজার চেষ্টাটি দেখতে পাই।

 “যাত্রা” কবিতায় কলমের ছোটো ছোটো আঁচড়ে দেখিয়েছিলেন কিভাবে রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাধে। কি করে রাজ দরবারের কুচক্রী কলা কুশলীরা সুতোর টানে কূটনৈতিক জটিলতা পাকিয়ে তোলে। কূটতর্কে মেতে থাকে রাজপ্রসাদজীবী পণ্ডিতের দল। আর তার পাশে ক্লান্ত খিন্ন অবসন্ন জনজীবন যা হোক করে প্রাণটুকু ধারণ করে চলে।

 শৈশব থেকেই সম্ভ্রান্ত স্বচ্ছল সুশিক্ষিত সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবারে বড়ো হয়ে সমাজের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনকে লক্ষ্য করার এক ধরণের পারিবারিক উত্তরাধিকার রবীন্দ্রনাথের ছিল। দেশপ্রেম, ভদ্রতা, সততা ও চরিত্রবল ইত্যাদি গুণগুলিকে কিছুমাত্র তুচ্ছ না করেও অর্থনীতির বিচারে কবির পৈতৃক পরিবার ছিল পরশ্রমজীবী। পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বে পুঁজির পক্ষে। জমিদারি মানসিকতার সমকালীন নজির গুলির কুৎসিত দিকের থেকে অনেক অন্যরকম হলেও গোত্র বিচারে সেই জমিদারতন্ত্রের ধ্বজাধারী ছিল কবির পৈতৃক পরিবার।

সুতরাং দেশ জুড়ে ইংরাজের হাতে গরিব ভারতীয় নিপীড়িত হতে থাকলেও শোষক শোষিতের অমানবিক সম্পর্কের মূলোৎপাটন দূরস্থান, ইংরেজ শাসনের সামগ্রিক অবসানটুকু জমিদারি মানসিকতার লোকেরা ভাবতে চাইতেন না।

 শ্রমজীবী মানুষের মাথা তুলে দাঁড়ানো, শ্রম ও পুঁজির অনিরসনীয় দ্বন্দ্বে শ্রমের মহত্ত্বকে হৃদয় ও মেধা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারার চেষ্টাটাই ভারতীয় জমিদারদের ছিল না। শখ করে তো আর দিনবদল হয় না, বড়ো জোর রঙ বদল হয়। এক ধরণের শাসকের বদলে অন্য ধরণের শাসক, এক রঙের শোষকের বদলে অন্য রঙের শোষক। কিন্তু শাসক শাসিত সম্পর্কটা চিরতরে চুকিয়ে দেব, শোষণের অলাতচক্র নিঃশেষে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব, এমন একটা বিশ্বাসে নিজেকে দেখতে চাওয়া জমিদারি মানসিকতার ব্যক্তির পক্ষে সমস্ত রকম সম্ভাব্যতার বাইরে। রবীন্দ্রনাথের চৈতন্যলোকে সেই অলোকসম্ভব ঘটনাই ঘটেছিল। শ্রম ও পুঁজির অনিরসনীয় দ্বন্দ্বে কবি নিজেকে চিরকালের শ্রমজীবীর পাশে খুঁজে পেলেন।

সাধারণ কলমচি দুটি অন্নের দায়ে কলম পেষেন। মালিক তাঁকে যা লিখতে হুকুম করেন, তাই লিখে যোগান দেওয়া তাঁর অন্নদায়। পণ্ডিতের দল রাজপ্রসাদের লোভে সাদাকে কালো, আর কালোকে সাদা বলতে দ্বিধা করেন না। পুঁথিপোড়োর দল অনুস্বার চন্দ্রবিন্দুর মশলাযোগে রাজার নির্দেশকে ললাট লিখন বলে চালাতে চায়। বণিকের দল ভাবে মানুষের রক্ত মানুষ শোষণ করবে, এটাই চিরকালের নিয়ম। শোষণ, শাসন, প্রতারণা, ঠগবাজির বহু উর্দ্ধে যে কোনো মানুষী অভিজ্ঞান থাকতে পারে, সেটাই তাদের অজানা।

অতি সাধারণের দৈনন্দিন চোখ দেখে মাটির পৃথিবীটা স্থির, আর সূর্যটা পূবদিক থেকে উঠে রোজ অস্তাচলের অভিমুখে আকাশ পরিক্রমা করে। আর বিজ্ঞানীর চোখ দেখতে পায় প্রকাণ্ড নক্ষত্রটি অনেকগুলি গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, আর ধূমকেতুর সংসার নিয়ে সুবিপুল গ্যালাক্সির অগণন নক্ষত্রের মাঝে এক কোণে ঘুরে চলেছে। এমন গ্যালাক্সির সংখ্যাও অনেক। আকার আয়তনের বর্ণাঢ্য বিপুলতায় এই সব গ্যালাক্সি সমন্বিত মহাজাগতিক অস্তিত্বের চেহারা সুদুরতম কল্পনাতে স্থান দেওয়াই অতি সাধারণের পক্ষে শক্ত।

আর বিজ্ঞানী ওই মহাজাগতিক অস্তিত্বের গণনা করবেন বলে চোখে টেলিস্কোপ সেঁটে আঁক কষেন।

ইতিহাসের দৈনন্দিনতায় রোজ রোজ গরিবের মার খাওয়া। গৃহহারা, আব্রুহারা, সম্মানহারা হওয়া তার নিয়মের মধ্যে পড়ে, বার্তাজীবী কলমচি একথা রোজ লেখে। ভিতরের সংবাদ যিনি জানেন, তিনি লক্ষ্য করেন, সংগ্রাম চলছে। বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। ইতিহাসের পাতার লিপিবিন্যাসে বিজ্ঞানীর মেধা মনন অন্তর্দৃষ্টির কুশলতায় দেখা গেল শ্রেণীদ্বন্দ্বই সমাজের চালিকাশক্তি। আর শ্রমজীবী শ্রেণীই সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল। ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সমাজবিদ্যা, দর্শনকে বিজ্ঞানের আলোয় ছেঁকে নিয়ে দার্শনিক বললেন শ্রমজীবীর নেতৃত্বে দুনিয়ার বদল আসন্ন।

দার্শনিক এ কথাটা যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখালেন। সে বিষয়টা নজরে এল অজস্র বুদ্ধিজীবীর, যাঁরা বুদ্ধিকে নেহাৎ জীবিকার খুঁটিতে বেঁধে না রেখে জীবনের স্পন্দনের সাথে মেলাতে চেয়েছেন। পুঁজি যখন সাম্রাজ্য গড়তে চেয়ে একেবারে মানবিক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছে, সেই সংকটক্রান্তিতে বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্রকে চিনলেন দিনবদলের হাতিয়ার বলে। ১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসানে সোভিয়েত গড়ে উঠলো।

কবি রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবোত্তর সংহতিকামী রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। সোভিয়েতের অসামান্য ভাবনাগুলি কতো সার্থকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাও দেখলেন। রাশিয়া ভ্রমণকে বললেন “এ জন্মের তীর্থ দর্শন।”

শত অত্যাচার সত্ত্বেও সর্বহারা শ্রমিক জাগবে এ কথা বুঝতে রবীন্দ্রনাথের সময় লেগেছিল। কিন্তু সততার সাথে, মোহ বিমুক্ত মন নিয়ে সামাজিক সম্পর্ককে চেনার চেষ্টায় তাঁর ফাঁকি ছিল না।

প্রবীণ বয়সে ভারতে ইংরেজ শাসনের বিকট চেহারাটা দেখতে দেখতে, তার বিপরীতে আবেদন নিবেদনের মেরুদণ্ডহীনতায় লক্ষ্য করতে করতে আর হঠাৎ হঠাৎ আবেগের বুদবুদ হয়ে শাক্তপন্থী যৌবনের দিশাহীন ফেটে পড়া দেখতে দেখতে কবি চোখ রাখেন বিশ্বের প্রাঙ্গণে। ভারতীয় চরিত্রের মহত্ত্ব, যা যে টুকু কোনো যুগে ছিল, তা যে নিঃশেষিত হয়ে নতুন করে মাথা তোলা দরকার রবীন্দ্রনাথ সেটা মেধা দিয়ে বুঝেছিলেন। পুঁজির সাম্রাজ্যলিপ্সাই যুদ্ধ ঘনিয়ে তোলে, পুঁজির নিজস্ব চরিত্রে এক সুগভীর অশান্তি রয়েছে, এই উপলব্ধিগুলি প্রবীণ কবির চিন্তায় এক বাঁক বদল ঘটিয়ে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন মানুষের কবি।

“কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন, কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন, যে আছে মাটির কাছাকাছি…”… নিজের মধ্যে নিজেকে তিনি এইভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রাণপণে।

“ওরা কাজ করে” কবিতাটিতে সেই জীবনে জীবন যোগ করার মেধাবী আয়োজন লক্ষ্য করি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।