|| আপেল গতিবিদ্যা আর ভারাকর্ষণ নিয়ে একটি বই || আজকের লেখায় মৃদুল শ্রীমানী
by
·
Published
· Updated
আপেল গতিবিদ্যা আর ভারাকর্ষণ নিয়ে একটি বই
মহাবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের কথা কে না জানে! তাঁর গতিবিদ্যা সম্পর্কিত তত্ত্ব ও মহাকর্ষ সূত্র বিশ্বনিয়ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যে বইতে তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন তার নাম হল : ফিলজফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা। আজ থেকে ৩৩৪ বৎসর আগে, ১৬৮৭ সালে এমন এক পাঁচ জুলাই এই মহাগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছিল। বইটি লেখা হয়েছিল লাতিন ভাষায়। প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ এডমণ্ড হ্যালি (০৮.১১.১৬৫৬ – ২৫.০১.১৪৭২)।
নিউটনের সমাধিলিপি বা এপিটাফ লিখেছিলেন ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ। সেটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে শোনাবে, “বিশ্বনিয়ম ঢাকা ছিল অন্ধগহনতলে/নিউটনের আবির্ভাবে উঠল আলো জ্বলে।”
মহাকর্ষ বা ভারাকর্ষণের তত্ত্ব এবং গতিবিদ্যা নিয়ে নিউটনের অবদান অনেকেই ছোটবেলা থেকে জানেন। কিন্তু আপেল ফল পড়তে দেখে ভারাকর্ষণের তত্ত্ব আবিষ্কার করা ও গতিবিদ্যা নিয়ে ওইমাপের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা বেশ একটু আশ্চর্যজনক। মুশকিলের কথা হল, নিউটন নিজেও গল্পের ছলে আপেল পড়ার কথাটা বলতেন। আপেলের গল্পটি আরো জনপ্রিয় করে দিয়েছেন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার, যাঁর আদত নাম ফ্রানকয়েস মারি আরুয়েৎ ( ২১.১১.১৬৯৪ – ৩০.০৫.১৭৭৮)। ভলতেয়ার গল্পটি শুনেছিলেন নিউটনের ভাইঝি ক্যাথারিণ বারটনের কাছে। আর ভলতেয়ারের ইচ্ছে ছিল নিউটনের এই অসামান্য মূল্যবান গবেষণার কথা সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। সেই লক্ষ্যে তিনি এই গল্পটিকে জনপ্রিয় করেন। এইসব গপ্পো কথা ভলতেয়ার তাঁর ১৭২৭ সালের এসেজ অন এপিক পোয়েট্রি বইতে লিখেছেন। ততদিনে নিউটন প্রয়াত।
আইজ্যাক নিউটন (০৪.০১. ১৬৪৩ – ৩১.০৩.১৭২৪) বলেছিলেন, অনেক বড় বড় মানুষের কাঁধের উপর চড়ে আমি বিশ্বনিয়ম জানতে পেরেছি। এই বড় বড় মানুষরা ঠিক কারা জানতে গেলে আপেলের গল্পটা একটু হলেও হালকা হয়ে যায়।
পোল্যাণ্ডের বিজ্ঞানসাধক নিকোলাস কোপার্নিকাস ( ১৯.০২.১৪৭৩ – ২৪.০৫. ১৫৪৩) একটি বই লিখেছিলেন। তার নাম দি রেভলিউশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেসটিয়াম। তাঁর মৃত্যু শয্যায় বইটি প্রকাশিত হয়। এই বইতে কোপার্নিকাস দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কেন কিছুতেই পৃথিবীকে তাবৎ বিশ্বজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত বলে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের সপক্ষে বিস্তর সওয়াল করলেও তখনো অবধি তা মেনে নেবার মতো গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন না। গভীর ভাবে হাতে কলমে টেলিস্কোপ বানিয়ে গবেষণা করে সেই সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাটা তুলে ধরলেন গ্যালিলিও গালিলি ( ১৫.০২.১৫৬৪ – ০৮.০১.১৬৪২)। তিনি বই লিখলেন ডায়ালোগো সোপরা ই দ্যু মাসিমি সিস্তেমি দেল মন্দো। সহজ ভাষায় বলতে গেলে প্রধান দুই বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে কথোপকথন।
১৬৩২ সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ডায়ালগ বইটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ হল। এই বইটি ইতালীয় ভাষায় লেখা হয়েছিল। এই বইতে গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতবাদের সঙ্গে টলেমির মতবাদের একটা তুলনামূলক আলোচনা পেশ করেছেন। পোপ অষ্টম আরবানের সৌজন্যে ইনকুইজিশন আদালত থেকে রীতিমতো লাইসেন্স আদায় করে ফ্লোরেন্স থেকে বইটি বেরোলো। গ্যালিলিওর ডায়ালগ বইতে আধুনিক গতিবিদ্যার ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বই লিখেছেন জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানস কেপলার ( ২৭.১২. ১৫৭১ – ১৫.১১. ১৬৩০)। ১৬০৯ সালে কেপলার লিখেছেন অ্যাসট্রোনমিয়া নোভা, আর ১৬১৯ সালে লিখেছেন হারমোনিয়াস মুন্ডি। কেপলার তাঁর বইতে প্রমাণ দেখিয়ে বললেন, গ্রহগুলি সূর্যকে একটা ফোকাসে রেখে উপবৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করে। আরো বললেন, গ্রহগুলি এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সদাসর্বদা সমগতিতে ছুটে চলে না। গতিবেগের হেরফের হয়। একটা গ্রহ সূর্য থেকে কতদূরে রয়েছে এবং সেই গ্রহ কতটা সময়ে সূর্যকে পাক খাচ্ছে, তার বর্গের মধ্যে তিনি একটা স্পষ্ট সম্পর্ক দেখালেন হারমোনিয়াস মুন্ডি বইতে।
এরপরে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে ( ৩১.০৩.১৫৯৬ – ১১.০২.১৬৫০) ১৬৪৪ সালে বই লিখলেন প্রিন্সিপিয়া ফিলজফিয়া। ওতে তিনি মহাজাগতিক বস্তুর পারস্পরিক টানাটানি নিয়ে কিছু কথা বললেন।
আর বলতে হয় ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস ( ১৪.০৪.১৬২৯ – ০৮.০৭.১৬৯৫) এর কথা। তিনি হরলজিয়াম অসিলেটোরিয়াম সিভ দে মতু পেণ্ডূলোরাম বইতে পেণ্ডুলামের দোলনসূত্রে গতিতত্ত্বের আলোচনা করেছেন। ১৬৫০ সালেই এই সব ভাবনা হাইগেনস ভেবে থাকলেও বই বের করতে করতে ১৬৭৩ সাল এসে পড়ল।
ছাত্রাবস্থায় নিউটন এইসব বইপত্র নাড়াঘাঁটা করেছেন। শুধুমাত্র নেড়েচেড়ে দেখাটুকুই নয়, কলেজ ছাত্র নিউটন তাঁর এইসব পড়া নিয়ে রীতিমতো নোট লিখতেন। এই নোটবইটির নাম হল কোয়ায়েশচনেস কোয়ায়েদাম ফিলজফিকায়ি। সহজ বাংলা ভাষায়, দর্শন বিষয়ে প্রশ্নসমূহ।
এইসব পুস্তকজাত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিউটন নিজের ভাবনাচিন্তাকে পরিপুষ্ট করছিলেন।
গতিবিদ্যা নিয়ে চর্চাভাবনা করছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক ( ২৮.০৭.১৬৩৫ – ০৩.০৩.১৭০৩) ১৬৬৫ সালে তিনি বই লিখেছেন মাইক্রোগ্রাফিয়া।
১৬৮৪ সালের জানুয়ারিতে এডমণ্ড হ্যালি (০৮.১১.১৬৫৬ – ২৫.০১.১৭৪২), রবার্ট হুক আর ক্রিস্টোফার রেন গতিবিদ্যা নিয়ে তর্কে মেতেছিলেন। এডমণ্ড হ্যালি ধূমকেতুর চলন নিয়ে কাজ করে বিখ্যাত। গতিবিদ্যার কিছু কিছু প্রশ্নে ঠেকে যেতে সবাই মিলে স্থির করলেন সমস্যা সমাধানের জন্যে নিউটনের দ্বারস্থ হবেন।
হ্যালি নিউটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে নিউটন খুব অবাক হয়ে জানালেন, এই বিষয়টা নিয়েই তিনি চিন্তায় ডুবে আছেন। হ্যালি বয়সে নিউটনের থেকে ছোট ছিলেন। কিন্তু এই হ্যালির আন্তরিক আগ্রহে নিউটন কয়েকটি পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন। নয় পৃষ্ঠার ওই পাণ্ডুলিপির নাম দিলেন ডি মতু করপোরাম জাইরাম বা কক্ষপথে চলমান বস্তুর গতি বিষয়ে। এই সময়টা হল ১৬৮৪ সালের নভেম্বর। হ্যালি ছিলেন কৃতবিদ্য মানুষ। তিনি রয়্যাল সোসাইটির বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নয় পাতার উপক্রমণিকাটি নেড়েচেড়েই বুঝে গেলেন একটি বহুমূল্য হীরকখণ্ড গড়ে উঠছে। লেখার ভিতরের যুক্তিবিন্যাস ও বক্তব্যের গভীরতা হ্যালিকে বিশেষভাবে আলোড়িত করল। এরপরে হ্যালি তাগাদা চালিয়ে যেতে নিউটনও লেখার ঝোঁকে ডুবে গেলেন।
আপনা গন্ধে ফিরি মাতোয়ারা কস্তুরী মৃগসম… এই মাপের উন্মাদসম আকুলতায় নিউটন লিখে ফেললেন ফিলজফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা। এডমণ্ড হ্যালির অর্থব্যয়ে সেই বই প্রকাশিত হল। লাতিন ভাষায়।
নিউটনের মৃত্যুর পর ওই বইটির ইংরেজি সংস্করণ বের হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে যে সমস্ত বই সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ, তার শীর্ষ স্থানে রয়েছে এই প্রিন্সিপিয়া।