রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

মৃত্যুর নিপুণ শিল্প – ১০

“আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো”
কতো রকম ভাবেই না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোর কথা বলেন। রক্তকরবী নাটকে যক্ষপুরে নন্দিনী লক্ষ্য করে, কেবল তার আর বিশুর মধ‍্যে চিলতে ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। ৪৭ফ নামে যক্ষপুরের শ্রমিক ছুটি পেলেই মদ্যপান করতে অভ‍্যস্ত। সেই নিয়ে তার সাদামাটা স্ত্রী চন্দ্রা অনুযোগ করে। তখন ৪৭ফ এর মধ্য থেকে ফাগুলাল জেগে উঠে চন্দ্রাকে বোঝায় তারা গ্রামে ছিল মানুষ। সেখানে সূর্যের আলো গ্রামীণ মানুষের কাছে প্রাণদায়ী মদের কাজ করত। সূর্যের আলোকে যে মদ মনে করে অসামান্য নেশা করা চলে, সে নিয়ে ফাগুলালের বক্তব্য আমাকে সচকিত করে। খোলামেলা প্রাকৃতিক আলো হাওয়ার অভাব অনটনের জন‍্যই যক্ষপুরে শ্রমিককে গাঁজিয়ে ওঠা তরল নিয়ে নেশা করতে বসতে হয়।

ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রের অসাধারণ চিঠিগুলির একটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন, প্রকৃতি তাঁর ভিতরে সূর্যের আলো ঢেলে দিয়ে তাঁকে দেবতাদের সমান করে দিচ্ছেন।

২৭ আষাঢ়, ১৩১৭ বঙ্গাব্দে গীতাঞ্জলি কাব‍্যগ্রন্থের ‘সীমায় প্রকাশ’ কবিতায় তিনি লেখেন,

‘তোমার আলোয় নাই তো ছায়া, আমার মাঝে পায় সে কায়া …’

আবার ওই গীতাঞ্জলিতেই ‘যাবার দিন’ কবিতায় ২০ শ্রাবণ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দে লেখেন,

‘এই জ‍্যোতিসমুদ্র মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে তারি মধু পান করেছি ধন‍্য আমি তাই।’

‘পূজারিণী’ কবিতায় আলোকে অন‍্যরকম একটা তাৎপর্য নিয়ে দেখতে পাই। শ্রীমতীর সাথে আমরাও দেখতে পাই, অস্তরবির রশ্মি আভায় উন্মুক্ত বাতায়নের কাছে বসে রাজনন্দিনী শুক্লা কবিতা পড়ছিল। শ্রীমতী নামে দাসীও কি সেই অস্তরবির আলো স্নায়ুতে মনে মেখে অন‍্যমাত্রার জীবন অর্জন করল? সৌরবিভা কি দাসীটির মধ্যে একটি বিদ্রোহী সত্তাকে জাগিয়ে তুলল?

জীবনের উপান্তে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘সে’। সে গল্পে আলো নিয়ে কতো কি বলেন কবি। সে গল্পে বিজ্ঞান মাস্টার এসে বুঝিয়ে যান, বিশ্বজগতে সূক্ষ্ম আলোর কণাই বহুরূপী হয়ে স্থূলরূপের ভান করছে। আরো জানান, আলোকের অণুপরমাণু বৃষ্টির মতো কণাবর্ষণ‌ও বটে, আবার নদীর মতো তরঙ্গধারাও বটে।

সারাজীবন ধরে গানে গানে অসামান্য মাত্রায় আলোর কথা বলে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আলো তাঁর নয়নে, আলো তাঁর হৃদয়ে। আলোর কথা বলতে বলতে গানে গানে এক উত্তরণ ঘটে যায়।

আমাদের বলতে ইচ্ছে করে, “আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো”।

আজ আমরা জানি সূর্যকে ঘিরে পাক খেতে থাকা গ্রহগুলির মধ‍্যে পৃথিবীর চেহারা ছোটর দিকেই। শুক্র, মঙ্গল ও বুধ পৃথিবীর চাইতে ছোট। আর বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন, এই চারটি পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ বড়। আকারে তো বটেই, ভরের প্রশ্নেও। অন‍্য গ্রহগুলির মোট ভর যা, বৃহস্পতির একার ভর তার থেকে বেশি। আর সৌর জগতের সূর্য নিজে, আর গ্রহ, বামনগ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ, ধূমকেতু, কুইপার বেল্ট এমনকি উর্ট ক্লাউড, হেলিওপজ পর্যন্ত পাথুরে জিনিস, তরল, গ‍্যাসীয় ইত্যাদি দূরে কাছে যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সবকিছুর মিলিত ভরের নিরানব্বই শতাংশের বেশি ভর সূর্যের মধ‍্যে রয়েছে।

সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব পনের কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্বটাকে একক ধরে
সৌরজগতের ব‍্যাস মাপা যায়। তবু সূর্য একটা মাঝারি মানের নক্ষত্র। আয়তনে সূর্যের চেয়ে বহুগুণ বড় নক্ষত্র রয়েছে। এর মধ‍্যে জ‍্যেষ্ঠা, আর্দ্রা, স্বাতী বেশ নামকরা। উজ্জ্বলতা বা তাপমাত্রার প্রশ্নেও সূর্যের চেয়ে অনেক বড় নক্ষত্র আছে। মিল্কিওয়ে গ‍্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ব‍্যাস একলক্ষ আলোকবর্ষের কিছু বেশি, আর সেখানে ১০০ থেকে চারশো বিলিয়নের মতো নক্ষত্র রয়েছে। বিলিয়ন মানে একহাজার মিলিয়ন। এক মিলিয়ন মানে দশলক্ষ। এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথ একটি স্পাইরাল গ‍্যালাক্সি। সূর্য তার একটি সর্পিল বাহুর এক কোণে রয়েছে।

আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ব‍্যাস একলক্ষ আলোকবর্ষের কিছু বেশি, আর সেখানে ১০০ থেকে চারশো বিলিয়নের মতো নক্ষত্র রয়েছে। বিলিয়ন মানে একহাজার মিলিয়ন। এক মিলিয়ন মানে দশলক্ষ। এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথ একটি স্পাইরাল গ‍্যালাক্সি। সূর্য এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বহুসংখ্যক সর্পিল বাহুর একটি, ওরিয়ন বাহুর এক কোণে রয়েছে। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অংশের থেকে সূর্য প্রায় ঊনত্রিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ের প্রতিবেশী গ‍্যালাক্সি হল অ্যান্ড্রোমীডা। এরকম আরো শত শত গ‍্যালাক্সি নিয়ে দৃশ‍্যমান মহাবিশ্ব।

স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে চিঠি লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। ইন্দিরাকে বিশেষ আদরে তিনি ‘বব’ বলতেন। আর ইন্দিরার মুখে রবিকা আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘রবকা’ হয়ে গিয়েছিল। সেই সব চিঠি ‘ছিন্নপত্র’ আকারে সংকলিত হয়েছে। তার ৬৭ সংখ‍্যক পত্রটি ০৯ ডিসেম্বর ১৮৯২ তারিখে লেখা।

সেখানে লিখেছেন: ” বহু যুগ পূর্বে যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম।”

আত্মপরিচয় ( ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দ, ১৩১১ বঙ্গাব্দ) এ লিখেছেন: ” একসময় আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলেম, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথ আদিম পৃথিবীর ভাব। এই পৃথিবীটি আমার অনেকদিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালবাসার লোকের মতো আমার কাছে চিরকাল নতুন। বহুযুগ পূর্বে আমি এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলাম। তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে আমি জন্মেছি। আমরা দুজনে একলা মুখোমুখি করে বসলেই আমাদের সেই বহুকালের পরিচয় যেন অল্পে অল্পে মনে পড়ে।”

১৯৩০ এর ৪ অক্টোবর তারিখে অতলান্তিক মহাসাগরের বুক থেকে “প্রবাসী” সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন : “কোথা থেকে জানিনে আমি এসেছি এই পৃথিবীর তীর্থে, আমার পথ আমার তীর্থদেবতার বেদীর কাছে। মানুষের দেবতাকে স্বীকার করে এবং প্রণাম করে যাব আমার জীবনদেবতা আমাকে সেই মন্ত্র দিয়েছেন।” ( রাশিয়ার চিঠি, ৮ নং পত্র)

১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ, ( মে ১৯৩৯) “নবজাতক” কাব‍্যগ্রন্থের উদ্বোধন কবিতায় বলেন: “বিশ্বজনের প্রাঙ্গণতলে লহো আপনার স্থান — /

তোমার জীবনে সার্থক হোক নিখিলের আহ্বান।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৭ তারিখে প্রান্তিক কাব‍্যগ্রন্থে লিখেছিলেন:

‘একদা পরমমূল‍্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়

আগন্তুক! রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ

সূর্য-নক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে

যে আলোক আসে নামি ধরণীর শ‍্যামল ললাটে

সে তোমার চক্ষু চুম্বি তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ

সখ‍্যডোরে দ‍্যুলোকের সাথে;’

কবিতাটি সঞ্চয়িতায় ‘পরমমূল‍্য’ নামে সংকলিত হয়েছে।

প্রান্তিকের আগেও তিনি মহাবিশ্বকে প্রেক্ষিতে রেখে অনেক গান ও কবিতা লিখেছেন। এখানে গানের কথা ক’টা বলা দরকার‌। গানের প্রথম ছত্র, গান রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ও রচনার তারিখ দিয়ে মহাবিশ্বের কথা কিভাবে তাঁর মননে এসেছে খোঁজ নেওয়া যাক।

বত্রিশ বছর বয়সে ১৩০০ বঙ্গাব্দে, ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে লিখেছিলেন ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। চৌত্রিশ বৎসর বয়সে ৪ – ৯ আশ্বিন, ১৩০২ বঙ্গাব্দে লিখেছেন ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’। পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে লিখেছিলেন: ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’। ১৩১৪ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে লিখলেন ‘বিপুল তরঙ্গ রে’। তখন কবির বয়স ৪৬ বৎসর। ১৩১৭ র ৪ বৈশাখ, ৪৮ বৎসর বয়সে লিখলেন ‘বিশ্ব যখন নিদ্রামগন।’ ৪৯ বৎসর বয়সে ১৩১৭ বঙ্গাব্দের জ‍্যৈষ্ঠের ৯ তারিখে লিখলেন ‘কবে আমি বাহির হলেম’, আর আষাঢ়ের ২৮ তারিখে ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’।

৫৩ বৎসর বয়সে ১৩২১ বঙ্গাব্দের ১৩ আশ্বিন, ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ত্রিশ তারিখে রচনা করেছিলেন ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে।’ তার এক সপ্তাহ পরে, ১৯ আশ্বিন, অক্টোবরের ছয় তারিখে লিখেছিলেন ‘বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ’; ওই ১৩২১ বঙ্গাব্দে লিখেছিলেন সারাজীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চা‌ঁদ।

১৯১৫ সালের ২৬ অক্টোবর, বাংলা ক‍্যালেন্ডারে ০৯ কার্তিক ১৩২২ তারিখে কবি লিখেছিলেন আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। তখন তাঁর ৫৪ বৎসর বয়স। ৬১ বৎসর বয়সে লিখলেন প্রথম আলোর চরণধ্বনি। রচনা করার তারিখটি হল ২৫ ডিসেম্বর ১৯২২ । বাংলা ক‍্যালেন্ডারে ১০ পৌষ ১৩২৯। ৬২ বৎসর বয়সে ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে (বাংলা ১৩৩১ সন) লিখেছিলেন আকাশ ভরা সূর্যতারা। আমার প্রাণের গভীর গোপন গানটি লিখলেন ৬৪ বৎসর বয়সে। তখন বাংলা সন ১৩৩২ এর চৈত্র মাসের ২৫ – ২৭‌ । যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি গানটি লিখেছিলেন ১৯২৭ খ্রীস্টাব্দে ১৬ জানুয়ারি ( বাংলা ২ মাঘ, ১৩৩৩) তারিখে। ৭৬ বৎসরের রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন মধুগন্ধে ভরা। সে সময়টা ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস।

সেই গানটিতে লিখলেন,
‘পিয়ে উচ্ছল তরল প্রলয়মদিরা উন্মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা,
কার নির্ভীক মূর্তি তরঙ্গদোলে কলমন্দ্ররোলে।
এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে কার তরণী চলে।’
এই তালিকায় উল্লিখিত গানগুলির বাণী খুঁটিয়ে পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবৎকালে পদার্থবিজ্ঞানের ও জ‍্যোতির্বিদ‍্যার অগ্রগতিটুকু আমাদের নজরে থাকুক।

যে সকল বিজ্ঞানীর ভাবনাপদ্ধতি মানব সভ‍্যতার বিকাশের পথে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে, আইজ‍্যাক নিউটন তাঁদের মধ্যে সবচাইতে উজ্জ্বল একটি নাম। পদার্থবিজ্ঞান, বলবিদ‍্যা, গণিত, জ‍্যোতির্বিজ্ঞান, এমনকি অর্থনীতি, জ্ঞান জগতের কোণে কোণে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা।

নিউটন যখন জন্মেছিলেন, সেদিন তারিখটি ছিল পঁচিশ ডিসেম্বর, ১৬৪২। পরে ক‍্যালেণ্ডারের সংশোধন করা হলে তারিখটি দাঁড়াল ০৪ জানুয়ারি, ১৬৪৩। একত্রিশ মার্চ নিউটনের প্রয়াণদিবস। ১৭২৭ সালে ৩১ মার্চ তারিখে তিনি প্রয়াত হন।

১৬৬৯ সাল থেকে ১৭০২ সাল পর্যন্ত নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৬৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিখ্যাত ব‌ই ফিলজফিয়া ন‍্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম‍্যাথমেটিকা। আর ১৭০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আলোকসংক্রান্ত বিপুল গবেষণা সংকলন অপটিকস।

আলোর ধর্ম ও চারিত্র‍্য এবং ভারাকর্ষণের নিয়ম এর পরবর্তী যুগে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে। বিশ্বনিয়ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

নিউটনের সমাধিলিপি বা এপিটাফ লিখেছিলেন ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ। সেটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে শোনাবে, “বিশ্বনিয়ম ঢাকা ছিল অন্ধগহনতলে/নিউটনের আবির্ভাবে উঠল আলো জ্বলে।”

মহাকর্ষ বা ভারাকর্ষণের তত্ত্ব এবং গতিবিদ‍্যা নিয়ে নিউটনের অবদান অনেকেই ছোটবেলা থেকে জানেন। কিন্তু আলোক নিয়েও তাঁর গবেষণার সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে। ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে নিউটন লক্ষ করেছিলেন, একটি প্রিজমের মধ‍্যে আলোকরশ্মি প্রবেশ করলে তা ভিন্ন ভিন্ন কোণে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের আলোকরশ্মি হিসেবে প্রতিসরিত হয়। এ থেকে নিউটন ধারণা করলেন যে বর্ণ বা রঙ জিনিসটা আলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

যাতে বিভিন্ন বর্ণের আলোর ভিন্ন ভিন্ন মাপের প্রতিসরণের জন‍্য গবেষণার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি না দেখা দেয়, তার জন্য ১৬৬৮ সালে নিউটন নিজের মনের মতো একটি প্রতিফলক দূরবিন বানিয়েছিলেন। ১৭৭২ সালে তাঁর তৈরি দ্বিতীয় দূরবিনটি তিনি রয়‍্যাল সোসাইটিতে দান করেন।

নিউটন বলেছিলেন, আলো কতকগুলি কণা বা করপাসলের যোগে তৈরি। এই কারণে আলো লঘুতর মাধ‍্যম থেকে কোনো ঘনতর মাধ্যমে প্রবেশ করলে তা ভিন্ন ভিন্ন রঙের ছটায় ভেঙে গিয়ে প্রতিসরিত হয়।

অবশ‍্য ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস (১৪.০৪.১৬২৯ – ০৮.০৭.১৬৯৫) ১৬৭৮ সালে প‍্যারিসের সায়েন্স আকাদেমিতে আলোকের তরঙ্গ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা পাঠিয়েছিলেন। ১৬৯০ সালে হাইগেনস এর আলোকসংক্রান্ত গবেষণার ব‌ই বেরোলো ট্রেইট দে লা লুমিয়ের। হাইগেনস বলেছিলেন, আলো তরঙ্গ হিসেবে চলে। হাইগেনস নিউটনের থেকে বয়সে চৌদ্দ বছরের বড় ছিলেন। নিউটন হাইগেনস এর তত্ত্ব মানলেন না। জোর দিয়ে বললেন, আলো কণা আকারে চলে। নিউটনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল হাইগেনস এর তুলনায় অনেক বেশি। সে সময় আলো সম্পর্কে লোকে নিউটনের কণাতত্ত্বকে মান‍্যতা দিয়েছিল। হাইগেনস এর তরঙ্গতত্ত্ব গুরুত্ব পায় নি। পরে দুই তত্ত্বের সমন্বয় ঘটান অগাস্টিন জাঁ ফ্রেসলেন এবং টমাস ইয়ুং। একেবারে হাল আমলের গবেষণায় জানা গিয়েছে মহাজগতে সবকিছুই তরঙ্গধর্মী।

আলোর কথা বলি। আলো দিয়ে যে মহাজাগতিক হিসেব নিকেশ করা যায়, তা দেখিয়েছিলেন প্রাচীন গ্রীকবিজ্ঞানী এরাটোস্থেনিস। তিনি মিশরের বিখ‍্যাত আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে বসবাস করতেন। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বেশ কিছু দূরে আরো একটি বিখ‍্যাত জনপদ ছিল সাইন। এরাটোস্থেনিসের কানে গিয়েছিল যে বছরের কোনো একটি দিনে মধ‍্যদিনের সূর্যালোক সাইন নগরীর একটি গভীর কূপের একেবারে তলদেশে পৌঁছায়। কিন্তু ঠিক ওই তারিখে কখনোই আলেকজান্দ্রিয়ার কোনো কূপের তলদেশে সৌর আলোক পৌঁছয় না।

যেদিন সাইন নগরীতে সৌর আলো কূপের একেবারে তলদেশে পৌঁছে যাচ্ছে, সেদিন বিজ্ঞানী এরাটোস্থেনিস আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সৌর অবস্থানের কোণটি মাপলেন। সেটা ছিল সাত ডিগ্রি। এরাটোস্থেনিস সাত ডিগ্রিকে পূর্ণবৃত্ত অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রির পঞ্চাশ ভাগের একভাগের নিকটবর্তী ধরে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সাইন নগরীর দূরত্বকে পঞ্চাশ দিয়ে গুণ করলেন। এভাবে তিনি পৃথিবীর পরিধি মেপে ফেললেন। এরাটোস্থেনিসের গণনা আজকের দিনের সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক গণনার সাথে পুরোপুরি মিলে না গেলেও, খুব একটা ভুল ছিল না। মাত্র পাঁচ শতাংশের হেরফের হয়েছিল।

সেই থেকে বহু বিজ্ঞানী আলো নিয়ে মহাজাগতিক হিসেব নিকেশে কৌতূহলী হয়ে পড়েন।

নিকোলাস কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক জগতের সন্ধান দিয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ব‌ই ‘ডি রিভলিউশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেসটিয়াম’ বেরিয়েছিল ১৫৪৩ সালে। কোপার্নিকাসের যুগে বিজ্ঞানীর হাতে টেলিস্কোপ ছিল না। চশমার কাচ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ১৬০৮ সালে হান্স লিপারসে একটি চোঙের দুই প্রান্তে লেন্স লাগিয়ে দূরের জিনিসকে কাছে এনে দেখার সরঞ্জাম তৈরি করেন। এই বিষয়টি শুধুমাত্র কানে শুনে লেন্সের ফোকাস দূরত্ব হিসেব করে গাণিতিক সূত্র দিয়ে টেলিস্কোপ বানালেন গ‍্যালিলিও। সেই হল প্রথম বৈজ্ঞানিক টেলিস্কোপ। সেটা ১৬১০ সাল। এই টেলিস্কোপ বাগিয়েই গ‍্যালিলিও বৃহস্পতির চারিচন্দ্র ক‍্যালিস্টো, ইউরোপা আইও আর গ‍্যানিমিড দেখে ফেললেন। দেখলেন শনির বলয় আর পৃথিবীর চাঁদের এবড়ো খেবড়ো পৃষ্ঠতল।

১৬১১ সালে জার্মান জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলার লেন্স এর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে ব‌ই লিখেছিলেন ‘ডায়োপট্রিসে’। ১৬২১ সালে ডাচ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী উইলব্ররড স্নেল দেখালেন, দুই ভিন্ন ধরণের মাধ‍্যমের মধ্য দিয়ে যাবার সময় আলো ভিন্ন ভিন্ন গতিবেগে চলে। এদের গাণিতিক সম্পর্ক‌ও তিনি দেখালেন।

১৬৩৭ সালে ফরাসি গণিতজ্ঞ দার্শনিক রেনে দেকার্তে ‘লা ডাই অপট্রিক’ নামে ব‌ই লিখলেন। ১৭৫৭ সালে বিজ্ঞানী পিয়ের দ‍্য ফার্মা বললেন, একটি বিন্দু থেকে আরেকটি বিন্দুতে যেতে আলো আলো সেই পথটিই বেছে নেয় যাতে সময় লাগবে সবচাইতে কম।

১৬৬৫ সালে ফ্রানসেসকো গ্রিমালডি আলোকের প্রতিসরণ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরলেন। বললেন, বাধা পেরিয়ে যাবার সময় আলো কোনো বস্তুর ছায়া এলাকার মধ‍্যেও কিছুটা ঢুকে পড়ে। ১৬৭৬ সালে ডেনিশ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে খ্রীস্টেনসেন রোমার আলোর গতিবেগ নির্ণয় করলেন। এঁদের সকলের বহু আগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা ভেবেছিলেন। তাঁর লাস্ট সাপার ছবিটি লক্ষ করলে বোঝা যায়, আলো সম্পর্কে তিনি কত গভীর ভাবে ভেবেছিলেন।

আলো হাতছানি দিয়েছে পরবর্তী কালের মহাবিজ্ঞানীদের‌ও। বিদ‍্যুৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল দেখালেন, দৃশ‍্য আলো, অতিবেগুনি রশ্মি ও অবলোহিত রশ্মি, সবগুলিই আসলে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের তড়িৎ চুম্বক তরঙ্গ মাত্র।। আলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, লুই ভিক্টর ডি ব্রগলি, আর্থার কম্পটন, নিলস বোর প্রমুখ বিস্তর গবেষণা করে বললেন, সকল কণার‌ই একটা তরঙ্গধর্মিতা আছে। আবার, সব তরঙ্গের‌ই কিছু কিছু কণাধর্মিতা আছে। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এই প্রশ্নটিকে আরো বিকশিত করে কোয়ান্টাম ধারণাকে গড়ে তুললেন। ১৯০২ সালে বিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড দেখিয়েছিলেন, ধাতুর উপর আলো পড়লে তা থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে। এবং সেই বেরিয়ে আসা ইলেকট্রনের পরিমাণ আলোর তীব্রতা নয়, কম্পাঙ্কের উপর নির্ভর করে। ১৯০৫ সালে ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট নিয়ে গবেষণা করে আইনস্টাইন দেখালেন, আলো থেকে শক্তি শোষণ করে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বিকীর্ণ হয়। ১৯২৪ সালে লুই ভিক্টর ডি ব্রগলি দাবি করলেন, সকল পদার্থের একটা তরঙ্গধর্মী আচরণ আছে। পরে জর্জ প‍্যাগেট টমসন এবং ক্লিন্টন জোসেফ ডেভিসসন ও লেস্টার হ‍্যালবার্ট জার্মার বিজ্ঞানী ডি ব্রগলির তত্ত্ব প্রমাণ করে দেখান। বিজ্ঞানী ব্রগলি তাঁর তত্ত্বের জন‍্য ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর তাঁর তত্ত্ব প্রায়োগিক পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠা করে টমসন ও ডেভিসসন যৌথভাবে ১৯৩৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন।

মহাকর্ষ নিয়ে ‘ফিলজফিয়া ন‍্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম‍্যাথমেটিকা (১৬৮৭)’ এবং আলোকতত্ত্ব নিয়ে ‘অপটিক্স (১৭০৪)’, আইজ‍্যাক নিউটনের এই দুটি বিখ্যাত ব‌ইয়ে ধৃত ধারণাগুলি আত্মস্থ করে, বিকশিত করে, ও বিনির্মাণ করে পরবর্তীকালে পদার্থবিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। পরবর্তীকালের সবসেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, তারার আলো যদি সূর্যের কাছ দিয়ে আসে, তাহলে সেই আলো সূর্যের মহাকর্ষের প্রভাবে কিছুটা বেঁকে যাবে। আইনস্টাইন আরো বলেছিলেন যে, তারার আলোর এই বক্রতা কেবল সূর্যগ্রহণের সময়েই লক্ষ করা যাবে, কেননা সাধারণ দিনে সূর্যালোকের তুলনায় দূরাগত নক্ষত্রের আলোকে নিতান্তই ম্লান দেখাবে। আলোর উপর ভারাকর্ষণের প্রভাব সম্পর্কে আইনস্টাইনের এই বক্তব্য ১৯১৯ সালের ২৯ মে তারিখে ঘটে যাওয়া একটি সূর্যগ্রহণে ইংরেজ বিজ্ঞানী আর্থার স্ট‍্যানলি এডিংটন ( ২৮ ডিসেম্বর ১৮৮২ – ২২ নভেম্বর ১৯৪৪) এবং ফ্রাঙ্ক ওয়াটসন ডাইসন ( ০৮ জানুয়ারি ১৮৬৮ – ২৫ মে ১৯৩৯) প্রমাণ করে দেখান। মহাকর্ষ ও আলো নিয়ে যে বিপুল গবেষণা নিউটন করেছিলেন, আইনস্টাইন যেন তাকে অন‍্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।