“আজ ইন্টারন‍্যাশনাল ডে অফ নো প্রসটিটিইউশন” – নিয়ে লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

পেত্নির ছোঁয়া

ভূত পেত্নি বলে কিছু নেই। অমন কিছু হয় না। হতে পারে না। এই কথাটা আমি হাজার বার বলেও শমিতার মাথায় ঢোকাতে পারি নি। সে ভূতে বিশ্বাস করে। পেত্নিতেও। ভগবানেও। তার মুখে সব সময় লব্জ ভগবান উপর থেকে সব দেখছেন, সব বিচার করছেন। তার চিন্তার আকাশে ভূতে আর ভগবানে রোজ দুবেলা এক সাথে ফুটবল খেলে। আর পেত্নি তাদের বাহবা দেয়।
এমনিতে কাজে কর্মে খুব দড় সে মেয়ে। কিন্তু ভূতে এবং ভগবানে তার অচলা ভক্তি। শত অবিচার চোখে দেখার পর সে মেয়ে হাত গুটিয়ে বলবে ভগবান উপর থেকে সব দেখছেন।
সন্ধ্যা বৌদির জন্যেই শমিতার সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিল। নইলে আমি হেন হতভাগাকে বিয়ে করত কে? চালচুলোহীন কাঠ বেকারের জীবন আমার। দর্শন শাস্ত্রে বিএ পাশ করেছি কোনোমতে। এমএ পড়া আর হলো না। টিউশনি পড়িয়ে দিন কাটত। পয়সা জুটত না। যে ছেলে মেয়েরা দর্শন পড়ত, তারা নেহাৎ অন্য কিছু পড়তে পায় নি বলেই দর্শন পড়তে এসেছিল। পড়ার অভ্যাস বা আকুতি, কোনোটাই তাদের বলবার মতো নয়। আমি জানতাম মেধাবীদের জন্য ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং  পড়ার ব্যবস্থা আছে আমাদের দেশে। নিদেনপক্ষে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া। কিন্তু দর্শন! হাসালেন মশায়। মুনি ঋষির দেশে দর্শন পড়ার জন্য মজবুত মনের ছেলে আসবে কেন? সুতরাং গরিবের সাদামাটা ছেলেকে পড়ানো বাবদে আমার পয়সা বাকি থাকত।
সন্ধ্যা বৌদির কাছে ওই জন্যে বিয়ে করতে আপত্তি করেছিলাম। একটা পেট বৌদি, তাই ঠিকমতো সামলে উঠতে পারছি না। দুটো পেট টানব কি করে? ঝামরে উঠেছিল সন্ধ্যা বৌদি। তুমি না পুরুষ মানুষ? পারছি না বললে শুনব কেন?
বললাম, শুনবেন না কেন? দুটো ডালভাতের খরচ জোটাতে গিয়ে জেরবার হচ্ছি, এমন অবস্থায় বিয়ে আমার কাছে বিলাসিতা মাত্র।
আমাকে করুণ মিনতি করে বলেছিল দেখো, তুমি ঠকবে না। মেয়েটা আমার পিসতুতো বোন বলে বলছি না, তুমি একটা উদ্যোগ না নিলে হবে না।
আমার বাড়িতে বাবা মা কেউ ছিলেন না। থাকার মধ্যে জীর্ণ পুরাতন দু কামরার ঘর। বিয়ে উপলক্ষে বাড়িটা যে একবার চুনকাম করা দরকার সে চিন্তাকেও উৎসাহ দিতে পারতাম না।
সন্ধ্যা বৌদির ঢলঢলে মুখখানি আমায় মায়া জাগাত। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শমিতাকে বিয়ে করতে রাজি হলাম।
ঠাকুরপো, দেখো, বিয়ে করছো বলে যেন বেশি কিছু হেঁকে বোসো না। মেয়েদের বাড়ির সামর্থ্য খুব কম। তোমার দাদার ভরসায় মেয়ে পার হচ্ছে। কানে ওর দুল আছে। হাতে চুড়িও। শাড়িটা আমি কিনে দেব। কিন্তু নমস্কারী বাবদে জনে জনে পোশাক আমি দিতে পারব না।
ঠিক হল বিয়ের রেজিস্ট্রি টুকু করে সন্ধ্যা বৌদির বাড়িতে দুই তরফের একটা সম্মিলিত জলযোগ করিয়ে দেব।
সেই শুনে শমিতা আকাশ থেকে পড়ল। সে কি কথা, বিয়ে হবে, শাঁখ বাজবে না, হুলুধ্বনি হবে না, সপ্তপদী হবে না, সে আবার কি রকম বিয়ে?
বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, রেজিস্ট্রি করে বিয়ে আমাদের দেশে যথেষ্টই মান্য। এভাবে পয়সা নষ্ট করিও না।
আমাদের সংসার শমিতা ঝকঝকে তকতকে করে রাখত। আর আমি অবাক হয়ে ওকে দেখতাম। এত  খুঁটিনাটির দিকে নজর মেয়েটার! বিয়ের পর ক’মাস যেতে না যেতেই দুটি চারটি করে ছেলে মেয়েকে ঘরে পড়ানো শুরু করল সে। আমি বাবার রেখে যাওয়া পুরোনো সাইকেলটা একেবারে বেজুত হয়ে যেতে হেঁটে হেঁটেই ছাত্র পড়াতাম। শমিতা আমার কাঁধের ব্যাগে জলের বোতল আর চিঁড়ে বা মুড়ি ভরে দিত। বলত অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম অবাক হয়ে। আমাদের ঘরের পাশে যে আধ কাঠা জমি পড়ে আছে সেখানে শমিতা লাউ কুমড়ো পেঁপে বসিয়েছে। গেরস্ত ঘরে দুচারটে সবজি ফললে শুধু যে টাকার সাশ্রয়, তাই নয়, দেখারও সুখ। ফুল থেকে কেমন একটু একটু করে ফল বেড়ে উঠছে দেখলে মনে একটা আরাম পাওয়া যায়। আমাদের এলাকার জুটমিলটায় গোলমাল চলছে। সময় থাকতে মালিক যন্ত্রপাতির বদল করে নি। শ্রমিক ইউনিয়নের কর্তারাও চোখ বুজে বসে থেকেছে। কেবল মাইনে বাড়াও নারা দিয়ে আজকের দিনের শ্রমিক আন্দোলন হয় না কি? শ্রমিকের শিক্ষা চাই, সুস্থ বিনোদন চাই, পরিবার পরিকল্পনা চাই। নইলে শ্রমিকের জীবনের মান উন্নত হয় না। কারখানা মালিক আর শ্রমিক নেতা দুয়ে মিলে শ্রমিককে পথে বসিয়ে দিয়েছে। কারখানা বন্ধ হলে এলাকায় হাহাকার নেমে আসবে। আমি এমন দু চারবার দেখেছি। কিন্তু শমিতাকে বলতে পারি নি।
একদিন ওর কাছে জানতে চাইলাম বাচ্চা পড়িয়ে কেমন লাগছে?
ও বলল, জানো, আমি ভাবতেই পারতাম না যে আমার কাছে কেউ পড়বে। আমি যে খুব সাধারণ। মাধ্যমিকে আমি সেকেণ্ড ডিভিশনে পাশ করেছিলাম জানো।
আমার খারাপ লাগে। আমিও মাধ্যমিকে সেকেণ্ড ডিভিশন। কিন্তু সেই নিয়ে আমার কোনো হীনমন্যতা নেই। বললাম পরীক্ষার নম্বরটাই তো আর সব নয়। অথচ মনে মনে জানি,নম্বর খুব কম ছিল বলেই এম এ পড়তে পারি নি।
শমিতা হেসে বললো তুমি খুব ভাল পড়াও, সে কথা এখানে সবাই বলে। খুব সুনাম তোমার।
আমার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে। একটা প্রাইমারি স্কুলের চাকরিও জোটাতে পারি নি। আমার চেনা কতজন কলেজে অতিথি শিক্ষক হয়ে পড়াচ্ছেন। খুব সামান্য মাইনে। নামমাত্র। শিক্ষা যদি মানুষের অধিকার হয়, তাহলে উপযুক্ত বেতনে শিক্ষক নিয়োগ হয় না কেন?
শমিতা আমাকে প্লেটে করে একটা অমলেট দিল। আমি বললাম ডিম পেলে কোথায়? সকালে আনতে বলেছিলে, আনতে পারি নি। পয়সা ছিল না।
সে বলল, ঘরের সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছিল, দেখে আর থাকতে পারি নি। চারটে কিনেছি।
কামড় দিয়েই বুঝলাম হাঁসের ডিম। বললাম হাঁসের ডিমের দাম তো অনেক।
ভেতরের কথাটা মেয়ে বুঝল। বলল ধারে কিনি নি গো। আজ একজন মাইনে দিয়েছে।
আশ্চর্য, সারা মাস খেটে সামান্য ক’টা টাকা মাইনে পেয়ে প্রথমেই বরের পছন্দের খাবার জিনিস কিনেছে। এদেশের মেয়েরা এত ভালবাসতে জানে!
মায়ের হাতে যখন সংসার ছিল, মা কয়লার উনুনে রাঁধতেন। ঘরের বাইরে চালা ঘরে রান্না। খুব বৃষ্টির দিনে তোলা উনুনে রান্না হত। শমিতা বলল জ্বলন্ত উনুন নিয়ে হাঁটা চলা বিপজ্জনক। আমি বললাম কেরোসিন স্টোভও বিপজ্জনক। মা যদি সামলে সুমলে পেরে থাকেন, তুমিও পারবে। শমিতা কিছু বলল না। আমি ভাবলাম কথাটা তার পছন্দ হয় নি। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে পড়ল মা কিভাবে সংসার চালাতেন। বাবার ওপর কোনো রকম চাপ দিতেন না। পরে মনে হল, বাবাকে মা ভয় পেতেন। শমিতা আমায় ভয় পায় না। ভয় পেলে কি ঠিক হত?
আমি মনে মনে হিসেব করতে থাকি গ্যাস নেবার খরচ খরচা কি রকম। নাঃ , আমি একটা নেহাতই বেআক্কেলে লোক। সাংসারিক খোঁজ খবর কিছুই জানি না।
কদিন বাদে শমিতা আল্টিমেটাম দিল দু দিনের মধ্যে গ্যাস যদি এনে দিতে না পারো, আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।
বলে কি মেয়েটা? বাপ নেই, মা নেই, কাকাদের সংসারে হাঁড়ি ঠেলে মানুষ। একটা মোটে এক কামরা ঘর সেখানে। বিয়ের পর থেকে সেখানে এক বারও যায় নি। কাকারা খোঁজ পর্যন্ত নেয় নি। আর সেই বাপের বাড়ির দেমাক দেখায় শমিতা? আচ্ছা আহাম্মক তো? সেখানে গেলে খাবে কি? শোবে কোথায়?
রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে পড়তে যাব, এমন সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসিতে ভেঙে পড়ল শমিতা। বাব্বা, রাগলে তোমাকে কি গম্ভীর দেখায়।
আমি বললাম ভয় করো না আমাকে?
শমিতা বলল, তুমি কি ভূত, যে তোমাকে ভয় পাবো?
বললাম, ভূত হলে ভয় পেতে নিশ্চয়?
আমার মুখে দ্রুত হাত চাপা দিয়ে সে বলে উঠল বালাই ষাট। কি অলুক্ষুণে কথা দ্যাখো।
তার মেয়েলি স্পর্শ আমার বুক ভরিয়ে দিল।
বিকেলে সে মেয়ে কাগজ দেখালো গ্যাসের কানেকশন আসছে। বললাম দরখাস্ত করলে কবে?
মুখ টিপে হাসে শমিতা। বলে বলব কেন?
আমি বললাম আমার নাম করে দরখাস্ত জমা দিলে, আমাকে কই বলো নি তো?
সে আমার কোলের কাছে ঘেঁষে এসে বলল আমি এই সংসারের রানি। আমার যা খুশি তাই করব।
আমি ওর মাথাটা কোলে নিতে নিতে মনে মনে বললাম, তাই কোরো।
গ্যাসে তরকারিটুকু হয়। আর দুধ ফোটে। রুটি বাইরে থেকে আনায় শমিতা। দুজনের রুটি কটা বাড়িতে করতে পারো না?
না, পারি না। বাইরে থেকেই রুটি আসবে। গ্যাস আমি উল্টোপাল্টা খরচ হতে দেব না।
জুটমিলটা বন্ধ হলোই। এলাকায় নামল কান্নার রোল। আমি দূরে দূরে তেমন বাড়ি দেখে টিউশনি খুঁজে নিলাম, যাঁরা জুটমিলের উপর নির্ভরশীল নন।
হাতে পয়সা নেই দেখে শমিতা কুড়িটা টাকা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিল। বলল ফেরার পথে রুটি এনো।
দেশে সাংঘাতিক অব্যবস্থা চলছে। ঋণ নেবার ছলে ব্যাঙ্কগুলিকে পথে বসিয়ে বিদেশে পালাচ্ছে প্রতারকের দল। আশ্চর্য, এদের খুঁটির জোর কম না। আর্থিক দুর্নীতিতে দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ জড়িয়ে রয়েছে। প্রশাসন আছে কি না, টের পেতে কষ্ট হয়। দলে দলে চাষী আত্মহত্যা করছে। নারী ও শিশুর উপর অত্যাচার সাংঘাতিক রকম বেড়ে গিয়েছে। ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাবার আগ্রহ কমছে। কর্মসংস্থান তলানিতে।
ভাবতে ভাবতে আনমনে পথ চলি আলো আঁধারিতে। সহসা এক মহিলা আমায় জাপটে ধরে। সারি সারি ট্রাক। ট্রাকের আড়ালে ছেলে মেয়ের মুখে দুটি অন্ন দেবে বলে দেহ বেচছে চাষি বৌ। দীর্ঘ যৌনতাবঞ্চিত ট্রাক ড্রাইভার দুটো পয়সার বিনিময়ে নারীমাংস কিনছে। এই আমার ভারতবর্ষ।
কুড়িটা টাকা মহিলাকে দিয়ে রেহাই পেলাম। সে যেভাবে আমায় আঁকড়ে ধরেছিল, টাকা কটা না দিলে ছাড়তই না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হাঁচড় পাঁচড় করতে গিয়ে কোথাও একটু আঁচড়ে গিয়েছে। বাড়ি গিয়ে ডেটল দিয়ে নিতে হবে।
আমাকে মাথা নিচু করে খালি হাতে ঘরে ফিরতে দেখে অবাক হল শমিতা।
রুটি পাও নি, তাই না?
অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম রাতে আজ ভাত খাব।
কোনো প্রশ্ন না তুলে শমিতা ভাত বসিয়ে দিল। আমি ওর ঘাড়ের কাছে চুলগুলি একমনে দেখছিলাম।
রাতে নিরালায় সে মেয়ে প্রশ্ন করলো টাকা কটা অন্য কোথাও কাজে লেগেছে, তাই না?
আমি তাকে ট্রাকের আড়ালে দেহ ব্যবসার কথা বলতে পারলাম না।
বললাম, জানো, আজ একটা পেত্নি আমার পকেট থেকে টাকাটা নিয়ে নিয়েছে।
শমিতা বলল সে কি? পেত্নি বলে কিছু হয় না কি?
আমি বললাম হয়, হয়। এই দ্যাখো, আমায় খামচে দিয়েছিল।
শমিতা নীরবে উঠে আমার ক্ষতে ডেটল লাগিয়ে দিল।
তার পর আলো নিভিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে রইল।
আমি কিছুতেই ওকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে আজ সত্যি একটা পেত্নি আমাকে পাকড়াও করেছিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।