আজ শিক্ষক দিবস
বাংলার সব সেরা শিক্ষাবিদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। গরিবের ছেলে। কিন্তু রুচিতে স্পর্ধায় ব্যক্তিত্বের দার্ঢ্যে বাংলার সবসেরা মানুষ।
সংস্কৃতের পণ্ডিত। কিন্তু, গাঁয়ের বাড়িতে সে টোল খুলল না। সারা দেশ জুড়ে এখানে ওখানে ইশকুল বসিয়ে চলেছে। সাহেবরা ওকে ভালও বাসে। সাহেবরা এক আধজন চেয়েছিল এদেশের ছেলেপিলেরা সত্যিকারের পড়াশুনা করতে পাক্। দেশের মানুষ আধুনিক জ্ঞানের আলো পাক্। কিন্তু দেশের রক্ষণশীল লোকেরা তা চায় নি। চাইবে কেন? আলো এসে গেলে ভয় কেটে যাবেনা? ভয় দেখানোর ব্যবসা চালু রাখতে পুরোনো ধাঁচাটা বজায় রাখা দরকার। প্রশাসনের ওপর মহলের বেশিরভাগ লোক ওই লোকজনকে চটাতে চায় না। কি করলে ট্যাকসো আদায়ের ব্যবস্থাটা মজবুত থাকে, সেইটে দ্যাখো। বেশি কিছু ভেবো না। ইংরেজ যা করতে চাইল না, বাঙালি হয়ে ঈশ্বর সে কথা ভাবল।
বলল, গণিত পড়াও। গণিত কেন? না, গণিত শিখলে যুক্তি বুদ্ধি বাড়ে। বিদ্যাসাগর নিজের হাতে গণিতের সিলেবাস গড়ে অপূর্ব সর্বাধিকারী নামে ছাত্রকে বললেন, আমার সময় থাকলে আমিই এই সিলেবাস ধরে গণিতের একটা বই লিখতাম বাপু। এ যাত্রা সেটি হচ্ছে না। গণিত বইটা তুমিই লেখো।
বলল, বেদান্ত নয়, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, ওসব কথার কথা। কথার জাগলারি। পাশ্চাত্য দর্শন আর জ্ঞান বিজ্ঞান পড়তে হবে। আর ওই ব্যাকরণের বোঝা কমাও। বারো বৎসরের ব্যাকরণ পাঠকে ছেঁটে কেটে ছোট করে ছয়মাসের মধ্যে গুঁজে দিল ঈশ্বর।
হিন্দি উৎস বৈতাল পচ্চিসী থেকে আনল বেতাল পঞ্চবিংশতি। শেকসপীয়রের নাটক কমেডি অফ এররস এর আখ্যানভাগ নিয়ে উপন্যাসের মতো করে লিখল ভ্রান্তি বিলাস।
মেয়েরা পড়বে। মেয়েরা শিখবে। আর বাল্যবিবাহ নয়। লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তারপর বিয়ে দাও। শিক্ষিত মায়ের সন্তান নিরক্ষর হয় না।
তখন ঈশ্বরের বয়স তেমন হয়নি। চেহারায় খুব বেশি ভারিক্কি ভাব আসেনি। কলকাতায় মেয়েদের ইশকুল খোলা দরকার বলে মেতেছে। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনকে রাজি করানো হল সামনে থাকতে। তিনি হোমরা চোমরা মানুষ। সরকারি শিক্ষা দপ্তরের উপরের থাকের লোক। তায় সাহেব। রাজার জাতের লোক। ওদের দাপই আলাদা। অমন একটা মানুষ সামনে থাকলে সহজেই কাজ উৎরে যাবে। শুরু হল বেথুন স্কুল। মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁর কন্যাদের পড়তে পাঠালেন। মদনমোহন গুণী মানুষ। তিনিও বড়ো সরকারি আমলা।
মেয়েরা অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে বড় কষ্ট পায়। পড়াশুনা করতে পেলে বাপ মা একটু ভাবতে শিখবে। হাতে একটু সময়ও পাবে। মেয়েদের মনটা একটু খোলামেলা বাতাস পাবে। মেয়েদেরকেও অত্যন্ত যত্ন করে লেখাপড়া শেখানো উচিত। বেথুন স্কুলের যে সব গাড়িতে করে ভদ্রলোকের পরিবারের মেয়েরা আব্রু রক্ষা করে পড়তে আসত, পণ্ডিত সেই সব গাড়ির গায়ে লিখে দিলেন কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যত্নতঃ।
বাচ্চাদের পড়ার ভাল ভাল বই দরকার। যাতে বাস্তব জীবনে চলার উপযোগী বোধ সহজে জন্মায়। ঈশ্বর বই লিখলেন। বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়। আর সংস্কৃত সাহিত্যের গল্পকে বুকে নিয়ে সীতার বনবাস, আর শকুন্তলা। লোকে পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা বলে ছোট করে! তা করুক না। ছোটদের পড়ার কাজের জন্য জুতসই বই কে লিখে দেয় বাপু?
ইশকুলে ইশকুলে ঈশ্বর এনে দিল আধুনিক যুগের হাওয়া। না অমাবস্যা পূর্ণিমায় সেকেলে শাস্ত্রসম্মত অনধ্যায় নয়, সায়েবি কেতায় রোববার ছুটি। আর গ্রীষ্মকালীন ছুটি। ছেলেরা আম জাম লিচু খাবে মজা করে।
সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিলেন। বাঙালি বড় অলস। আর শ্রমবিমুখ। মুখেন মারিতং জগৎ। অধ্যাপকেরাও তাই। ডিসিপ্লিন কারে কয় জানতে চান না। বুঝতেও চাননা। সমস্যা হল, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকগণ অনেকেই তাঁরও অধ্যাপক ছিলেন। হলেনই বা অধ্যক্ষের পদে আসীন। বিদ্যাসাগরের শিক্ষক তো বটে। ফাঁকিবাজ শিক্ষক কে শায়েস্তা করতে কি আর করেন বিদ্যাসাগর! কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর শিক্ষক মশায়রা দেরি করে ঢুকলে বিদ্যাসাগর নীরবে ট্যাঁকঘড়িটা বের করে দেখতে থাকেন। অন্য সভ্য জাত হলে লজ্জায় মরে যেত। বাঙালি কি না। লাজলজ্জার বালাই নেই। একদিন এক শিক্ষক বয়সে অনুজ অধ্যক্ষকে বলেই বসলেন, ওহে, তুমি যদি কড়া কড়া কথা বলতে, তাও সহ্য হত। কিন্তু ওই যে কিছু বলো না, খালি ট্যাঁকঘড়িটা দেখিয়ে দেখিয়ে দেখতে থাকো, ওই তে গা আরো চিড়বিড় করে জ্বলে। দুটো কথা বললে, কথার পৃষ্ঠে কথা টেনে আনতে পারতুম। যে লোক কথাটি কয় না, তার সাথে বিরোধ করি কি করে?
এই ঘটনা একদিন ঘটবে নামকরা অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। ছেলেটি যথেষ্ট মেধাবী। আর ব্যক্তিত্ব খুব। যদিও রেজাল্ট সে রকম কিছু নয়। নরেনের বাবা নিজের পরিবারকে রীতিমতো পথে বসিয়ে মরেছেন। বিএ পাশ নরেনের জন্য একটা শিক্ষক তার চাকরি হলে পরিবারটা বেঁচে বর্তে থাকতে পারে। বিদ্যাসাগর নরেন্দ্রকে চাকরি দিলেন। শিক্ষক তার চাকরি। কিন্তু সে ছেলে এখানে সেখানে সভা সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। ক্লাস কামাই করে। ক্লাসেও সিলেবাসের বাইরে কী সব বলে ছেলেরা বোঝে না। এভাবে তো চলতে পারে না। নরেন্দ্রকে চাকরি থেকে হঠিয়ে দেন বিদ্যাসাগর। ভাগ্যিস হঠিয়ে দিয়েছিলেন। নইলে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দের জন্ম হত কি?
বাংলার নবজাগরণের সূচনায় এক বিদেশী মানুষের কথা না বললেই নয়। তিনি উইলিয়াম কেরি। ছিলেন জোলা, হলেন মুচি। মুচি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন না। মানুষটি একটি গোটা উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির সূচনা করে দিয়ে গেলেন। তিনি উইলিয়াম কেরি ( ১৭ আগস্ট ১৭৬১ – ০৯ জুন ১৮৩৪)। কী করেন নি মানুষটি? বাংলাভাষায় অধ্যাপনা করেছেন। বাংলা সহ আরো আঠাশটি ভাষা ও উপভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছেন। মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে অজস্র পুঁথি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করেছেন। বাংলা সংস্কৃত ও মরাঠি ভাষায় অভিধান রচনা করেছেন। মরাঠি ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন। ভুটিয়া ভাষার ব্যাকরণ সম্পাদনা করেছেন বন্ধুর সাথে মিলে মিশে। জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল স্তরের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। রামায়ণ মহাকাব্য ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কথোপকথন নামে বাংলা কথ্যভাষার পুস্তক লিখেছেন। দুটি উদ্ভিদবিদ্যার পুস্তক সম্পাদনা ও প্রকাশনা করেছেন। কলকাতার আলিপুরে হর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাওড়ার শিবপুরে বটানিকাল গার্ডেনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। শ্রীরামপুর শহরে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে উন্নীত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম যৌবনেই খ্রীস্টীয় ধর্মমত ও দৃষ্টিভঙ্গি সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দেওয়া, ও আলোকচর্চায় উজ্জীবিত করার দায় অনুভব করেন কেরি। অন্য ধর্মের লোকের ধর্মমত পরিবর্তন করিয়ে তাকে আলোকিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত খ্রীস্টানদের দায়িত্ব কি, সে সম্পর্কে একটা পুস্তিকা লিখে ফেললেন।
এরপরই সপরিবারে কলকাতা পাড়ি। সালটা ১৭৯৩। কেরি এলেন কলকাতায়। কেরি চাইছেন শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চাকে অবলম্বন করে প্রাচ্যদেশীয় অশিক্ষিতদের আলোকিত করতে। অথচ ইংরেজ শাসক তা চাইছে না। কেরি চাইছেন সাধারণ ভারতীয়দের খ্রীস্টীয় ধর্মমতে দীক্ষিত করতে। ইংরেজ শাসক তা চাইছে না। শাসক চাইছে স্থিতাবস্থা বজায় থাকুক। কেরি চাইছেন শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের পথে খ্রীস্টীয় রুচির প্রসার হোক।
কেরি এমনকি কলকাতার খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের কোনো সমর্থন পেলেন না। ১৭৯৪ সালে পারিবারিক আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে মেদিনীপুরের এক নীলকুঠিতে ম্যানেজার হিসেবে কাজে যোগদান করলেন।
এই সময় তিনি খ্রীস্টধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বাইবেল অনুবাদ করেছেন। এখানে আমাশয় রোগের শিকার হয়ে পিটার নামে কেরির এক সন্তান বিয়োগ হয়। সেই আঘাতে কেরির স্ত্রী চিরতরে মানসিক ভারসাম্য হারান।
মেদিনীপুরে কেরি পেয়েছিলেন জোশুয়া মার্শম্যান নামে এক বিদ্যালয় শিক্ষককে আর উইলিয়াম ওয়ার্ড নামে এক মুদ্রণ শিল্পীকে।
ব্রিটিশ সরকারের ক্রমাগত বিরূপতা ও বিরোধিতা এড়াতে সদলবলে কেরি সাহেব ১৭৯৯ সালে পাড়ি দিলেন শ্রীরামপুর শহরে। ওটি ছিল ডেনমার্কের দখলে। ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিক এর সম্মানে শ্রীরামপুর শহরের নাম ছিল ফ্রেডরিক নগর। ওখানে ইংরেজ শাসকদের বিরোধিতা তত প্রভাব ফেলতে পারবে না। মার্শম্যান আর ওয়ার্ডের সহযোগিতা নিয়ে ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারিতে কেরি শ্রীরামপুর শহরে একটি পুরোনো সেকেন্ডহ্যাণ্ড ছাপাখানা কিনলেন। সেখানেই শুরু হয় ভারতীয় প্রাচীন পুঁথি ছাপা। বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে একটা যুগ সূচনা করে এই শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা।
ওই ১৮০০ সালেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনা করেন ব্রিটিশ সরকার। তারিখটা ছিল ১০ জুলাই। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষাশিক্ষায় তালিম দিয়ে প্রশাসনিক কাজে দক্ষ করে তোলা। লর্ড ওয়েলেসলি ছিলেন গভর্নর জেনারেল। তিনি বাংলা শিক্ষা প্রসার নিয়ে কেরির উদ্যম ও আগ্রহের খবরাখবর রাখতেন। তাঁর আমন্ত্রণে কেরি ওই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপকের আসনে যোগ দেন। এরপর ত্রিশ বছর ধরে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। সংস্কৃত ও মরাঠিও পড়াতেন। ১৮০৫ সালে মরাঠি ব্যাকরণ প্রকাশ করেন।
ইতিমধ্যে ২০ জানুয়ারি, ১৮১৭ তারিখে মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়, ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার, রাজা রাধাকান্ত দেব, রাণী রাসমণি প্রমুখের উদ্যোগে হিন্দু কলেজের সূচনা হয়। ১৮৫৫ সালের পরে এই প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে পরিচিত হয়। বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ও গোপীমোহন ঠাকুরকে গভর্নর করে গরাণহাটার গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে এই কলেজের সূচনা।
এই হিন্দু কলেজ সাধারণ মানুষের জন্য ভারতের প্রথম কলেজ। ১৮১৮ সালে কেরি ও বন্ধুদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা। এটি দ্বিতীয় কলেজ। এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। ১৮২৬ এর আগস্টে জোশুয়া মার্শম্যান ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিক এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাজানুগ্রহে ১৮২৭ থেকে এটি সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি লাভ করে। সেই সূত্রে শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮২০তে কেরি কলকাতার আলিপুরে ভারতের এগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি স্থাপন করেন।
শিক্ষক মহাশয়ের কাজ যদি হয় ছাত্রদের মধ্যে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা ও ধ্যান ধারণার উদ্ভাস ঘটানো, তাহলে বাংলাভূমিতে এক খ্রিস্টান ইন্দো পর্তুগিজ অ্যাংলো শিক্ষক মহাশয়ের কথা বলতে হয়। তিনি ডিরোজিও (১৮ এপ্রিল ১৮০৯ – ২৬ ডিসেম্বর ১৮৩১)।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও ছিলেন একজন খ্রিস্টান ইন্দো পর্তুগিজ পদস্থ চাকুরিজীবী। মা সোফিয়া জনসন ছিলেন ইংরেজ মহিলা। ছোটবেলায় ডিরোজিও ডেভিড ড্রামণ্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনা করেছেন। তবে সে একেবারেই প্রাথমিক শিক্ষা। কিন্তু ড্রামণ্ডের সংস্পর্শে ডিরোজিওর ভিতর নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল।
ডিরোজিও পড়াশুনায় ভাল ছিলেন। এতটাই ভাল, যে তাঁর পরীক্ষায় ফলপ্রকাশের খবর সে যুগে সংবাদ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হত। মাত্র চৌদ্দ বৎসর বয়সে ডিরোজিও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাবার অফিসে কাজ করতে ঢোকেন। তারপর চলে যান ভাগলপুর। সেখানে তাঁর আপনজনের নীলকুঠি ছিল। সেখানেই কাজ করতেন তিনি। আর সেখানে ছিল গঙ্গা নদী। সুরধুনী জাহ্নবীর কলকল জলস্রোতের সংস্পর্শে ডিরোজিওর মনে কাব্যভাবের উন্মেষ হয়।
কবিতা লিখতে শুরু করেন আর সেই কৈশোরের উচ্ছ্বাসপূর্ণ কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে ইণ্ডিয়া গেজেটে। সালটা ১৮২৫। জন গ্রাণ্ট ছিলেন ইণ্ডিয়া গেজেটের সম্পাদক। ডিরোজিওর কলমের সামর্থ্য তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি কিশোর ডিরোজিওকে ইণ্ডিয়া গেজেটে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর হিসেবে টেনে নেন। ইংরেজি ভাষায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তির জোরে ১৮২৬ সালের মে মাসে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। তখন তাঁর মাত্র সতেরো বছর বয়স।
শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মনের মধ্যে দেদীপ্যমান জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নশীলতা জাগ্রত করেছিলেন ডিরোজিও। প্রমাণ ও যুক্তি ছাড়া কোনো কিছুই বিশ্বাস করব না, এমন মনোভাবে তিনি ছাত্রদের উজ্জীবিত করেন। এই ছাত্ররা ইয়ং বেঙ্গল হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
ডিরোজিওর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন রাধানাথ শিকদার (১৮১৩ – ১৮৭০), দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জি ( ১৮১৮ – ১৮৮৭), প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪ – ১৮৮৩), রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০ – ১৮৫৮), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩ – ১৮৯৮) প্রমুখ।
এঁদের উদ্যোগে উৎসাহে অংশগ্রহণে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে বিতর্ক সভা বা ডিবেটিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়। শিক্ষক ডিরোজিও ছিলেন ওঁদের পথপ্রদর্শক ও প্রথম সভাপতি। সালটা ছিল ১৮২৮।
যুক্তি ও প্রশ্নশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও ডিরোজিও ছিলেন কবি। আর আদ্যন্ত স্বদেশপ্রেমী। “টু ইণ্ডিয়া- মাই নেটিভ ল্যাণ্ড” তাঁর বিখ্যাত কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।
সমসাময়িক হিন্দু সম্প্রদায়ের সমাজপতিরা ডিরোজিওর তীব্র ব্যক্তিত্বকে সহ্য করতে পারেন নি। ছাত্রদের তিনি নষ্ট করছেন, এই অভিযোগ তুলে সমাজপতিরা তাঁকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত করেন। তখন ১৮৩১ সালের এপ্রিল মাস। ওই একই বৎসরে ২৬ ডিসেম্বর তারিখে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ডিরোজিও প্রয়াত হন। তখন তাঁর বাইশ বছর বয়স। ডিরোজিওর দীপশিখাকে ইয়ং বেঙ্গলরা মরতে দেননি। ডিরোজিও প্রয়াত হলে, তাঁরা ডেভিড হেয়ার ( ১৭৭৫ – ১৮৪২) এর সভাপতিত্বে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৮৩১সালে ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে ১৮৩৯ অবধি এই সংস্থা জীবিত ছিল। এর মধ্যেই ১৮৩৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে তারানাথ চক্রবর্তী, রামগোপাল ঘোষ ও প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখের উদ্যোগে সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ গড়ে ওঠে। ভারতপ্রেমী শিক্ষাবিদ ডেভিড হেয়ার এই সভার সাথেও যুক্ত ছিলেন।
শিক্ষক দিবসে ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫ – ১৮৪২) কে স্মরণ না করে পারছিনা। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের লোক। পেশায় ছিলেন ঘড়ি ব্যবসায়ী। ঘড়ি সারানোর কাজ করবেন বলে কলকাতায় এসেছিলেন যুবক ডেভিড হেয়ার। সেটা ১৮০০ সাল। তখন তাঁর মোটে পঁচিশ বছর বয়স। ডেভিড হেয়ার ধর্মীয় লোক ছিলেন না। এদেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় অনুভূতিকে পরিবর্তন করার কোনো আগ্রহ বা উৎসাহ কোনোটাই তাঁর ছিল না। হেয়ারের আগ্রহ ছিল মানুষের পার্থিব বাস্তব জীবনের উন্নতি সাধনে। ঘড়ির দোকান খুলে ঘড়ি সারাতে সারতে ক্রেতাসাধারণের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন তিনি। নানাবিধ সামাজিক বিষয়ে নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আদানপ্রদান করতে ভালবাসতেন ঘড়ির ব্যবসায়ীটি। এইভাবে একদিন আলাপ হয়ে গেল রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে। বলা দরকার, রায় ও হেয়ার প্রায় সমবয়সী ছিলেন। রায় জন্মেছিলেন ১৭৭২ সালে, আর হেয়ার ১৭৭৫ সালে। দুই সমবয়সী শিক্ষাপ্রাণ মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা গড়ে উঠল সহজে। সালটা ছিল ১৮১৪। হেয়ারের বয়স তখন ঊনচল্লিশ, আর রায় বেয়াল্লিশ বছরের সুগম্ভীর মানুষ। হৃদ্যতা বাড়তে ১৮১৬ সালে স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগে হেয়ার রায়ের আত্মীয় সভার আলোচনা সভার একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সেদিন সেখানে কলকাতায় ইংরেজি স্কুল স্থাপনা নিয়ে কিছু আলোচনা হয়। বাবু বুদ্ধিনাথ মুখার্জি সেসব কথা তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস স্যার এডোয়ার্ড হাইড ইস্টের কানে তোলেন। ইস্ট সাহেব নিজের বাড়িতে ১৮১৬ সালের মে মাসে গুণী ও ভদ্র বাঙালি সমাজপতিদের নিয়ে একটা বৈঠক করেন। একলক্ষ টাকা চাঁদা ওঠে। বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ও গোপীমোহন ঠাকুরকে গভর্নর করে, গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ, রাধামাধব ব্যানার্জি, গঙ্গানারায়ণ দাস, এই কয়জনকে ডিরেকটর করে, ও বাবু বুদ্ধিনাথ মুখার্জিকে সেক্রেটারি করে একটি ক্ষমতাশালী কমিটি তৈরি হয়। ১৮১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে হিন্দু কলেজ স্থাপনা হয়। পরে ১৮৫৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম হয় প্রেসিডেন্সী কলেজ। আজ এটা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত।
ডেভিড হেয়ার এই হিন্দু কলেজ স্থাপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি হিন্দু স্কুল ও হেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠার সাথেও যুক্ত ছিলেন। ছাত্রদের সাথে হেয়ারের অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
১৮১৭ সালের মে মাসের ছয় তারিখে স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। ১৮১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক তারিখে স্থাপিত হয় ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি। রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের সাথে হেয়ার এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছেন। ১৮২৪ সালে এদেশীয় মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করতে চেয়ে লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন স্থাপিত হয়। সেখানেও হেয়ারের অংশগ্রহণ ছিল। ডিরোজিও যখন মারা গেলেন সেই ১৮৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইয়ং বেঙ্গলদের অন্যতম বন্ধু ও সুহৃদ হয়ে উঠলেন হেয়ার। তখন তাঁর ছাপ্পান্ন বছর বয়স। তবু নবনবীনের জয়ধ্বনি গাইতে হেয়ারের ক্লান্তি ছিল না।
ডিরোজিওর মৃত্যুর বছর এগারো পরে ১৮৪২ সালের ১ জুন ডিরোজিওর মতোই কলেরায় ভুগে হেয়ারের মৃত্যু ঘটে। হেয়ার ধর্মাচরণ মানতেন না, এমন সন্দেহ করে খ্রিস্টান ব্যক্তিরা খৃস্টানদের নির্দিষ্ট সমাধিভূমিতে তাঁঁর মরদেহ সমাধিস্থ করতে দেননি। হেয়ার স্কুলের বিপরীতে কলেজ স্কোয়ারে তাঁর মরদেহ ঘুমিয়ে রয়েছে।