• Uncategorized
  • 0

|| এভারেস্ট || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

এভারেস্ট

আজ কর্ণেল স‍্যর জর্জ এভারেস্ট এর জন্মদিন। এভারেস্ট শিখরের নাম শোনেননি, এমন শিক্ষিত ভারতীয় কম‌ই আছেন। হ‍্যাঁ, পৃথিবীর উচ্চতম এই শিখরটির নাম যাঁর নামে, সেই এভারেস্ট সাহেবের আজ জন্মদিন।
তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জিওগ্রাফার, মানে জরিপ বিশেষজ্ঞ ভূগোলবিদ। ১৭৯০ সালে আজকের দিনে তিনি জন্মেছিলেন। ছিয়াত্তর বৎসর বয়সে ১৮৬৬ সালে ১ ডিসেম্বর তারিখে তাঁর প্রয়াণ হয়।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গের নাম কর্ণেল স‍্যর জর্জ এভারেস্ট এর নামে হল কেন, সে নিয়ে আলোচনা করা দরকার। প্রথমেই বলতে হবে, জর্জ এভারেস্ট এটা চাননি। তীব্র আপত্তিও করেছেন। বলেছেন, স্থানীয় নামেই শিখরটিকে পরিচিতি দেওয়া হোক।
এভারেস্ট শিখরকে স্থানীয় মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে চিনতেন। তাকে নেপালের অধিবাসীরা বলতেন সাগরমাথা। তিব্বতের মানুষ বলতেন চোমোলাংমা। স্থানীয় লোকজন জানত দেওডাঙা বলে। কেউ বলত গৌরীশংকর। আর খুবই যে উঁচু, সেটাও মানুষের জানা ছিল। কিন্তু উচ্চতার গাণিতিক বৈজ্ঞানিক হিসেবটা কারো কাছে ছিল না। ১৮০২ সালে ভারতে গ্রেট ত্রিকোণমিতিক সার্ভে শুরু হল। কাজ শুরু হয় দক্ষিণ ভারত থেকে। ১৮৩০ নাগাদ উত্তর ভারত জুড়ে কাজ আরম্ভ হল। ১৮৪৭ এর নভেম্বরে  ব্রিটিশ ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যাণ্ড্রু ওয়া নিজে গেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার পিছনে আরো উঁচু শিখরটি পরিমাপ করতে। সাথে ভারি ভারি থিওডোলাইট যন্ত্র। পাঁচশো কিলো ওজনের জিনিসটা ব‍ইতে বারোটা কুলি লাগে। ১৮৪৯ সালে কর্তৃপক্ষ পাঠালেন জেমস নিকলসনকে। সাথে পাঠানো হল সবচেয়ে ভালো থিওডোলাইট যন্ত্র। পিক বি, ওটাই তখন নাম ভাবী সর্বোচ্চ শৃঙ্গের। তো পিক বি মাপতে গিয়ে ম‍্যালেরিয়া বাধালেন নিকলসন সাহেব। মারা পড়লেন। এরপর বাঙালি গণিতবিদ রাধানাথ শিকদারের উপর ভার পড়ল। ততদিনে পিক বি হয়েছে পিক XV, পনেরো নম্বর শৃঙ্গ। রাধানাথ দরদী মন নিয়ে নিকলসন সাহেবের খাতাপত্র খু্ঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। হিসেবের কিছু ভুলচুক সংশোধন করতে গিয়ে নিশ্চিত হলেন সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গের সন্ধান মিলেছে। সেটা ১৮৫২ সাল। ছুটলেন বড়কর্তা অ্যাণ্ড্রু ওয়ার কাছে। মাপজোকের কাগজ খুঁটিয়ে দেখে রায় দেবেন তিনিই। রাধানাথ শিকদারের কাজ দেখে বড়কর্তা আহ্লাদিত। পিক XV এর নাম তিনি দিলেন মঁ এভারেস্ট। ইউরোপের মঁ ব্লাঁ এর অনুকরণে। আর রাধানাথকে দায়িত্ব দিয়ে রাখলেন বাকি শৃঙ্গগুলির নামকরণের। পিক পনেরোর প্রস্তাবিত নাম এভারেস্ট জেনে সার্ভেয়ার সমাজের আনন্দ আর ধরে না। জর্জ এভারেস্ট যে সার্ভেয়ার জেনারেল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন এভারেস্ট সাহেব নিজে। তিনি স্থানীয় নাম ব‍্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন। কর্মরত সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যাণ্ড্রু স্কট ওয়া  তাঁর পূর্বসূরী এভারেস্ট সাহেবকে বোঝালেন যে পিক পনেরোর স্থানীয় নাম নানাবিধ। একটি সর্বজনস্বীকৃত নাম দরকার। শেষে ১৮৬৫ থেকে পিক পনেরো শিখরটি এভারেস্ট হিসেবে পরিচিত হতে থাকল। পরের বছর ১৮৬৬ তে এভারেস্ট সাহেব প্রয়াত হলেন। ১৮৭০ এ প্রয়াত হলেন রাধানাথ শিকদার। আর ১৮৭৮ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অ্যাণ্ড্রু স্কট ওয়া।
সর্বোচ্চ শিখরের এভারেস্ট নামটি মনোনীত করেছিলেন রয়‍্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি। সেটা ১৮৬৫ সাল। কিন্তু অ্যাণ্ড্রু স্কট ওয়া সার্ভেয়র জেনারেল হিসেবে এভারেস্ট নামটি প্রস্তাব করে পাঠিয়েছিলেন ১৮৫৬তে। বলা মাত্রই নামটি গৃহীত হয় নি। অনেক দেখে বুঝে সময় নিয়ে তবে নামকরণ চূড়ান্ত হয়েছিল।
এবার আজ জন্মদিন উপলক্ষে এভারেস্ট সাহেবের একটু পরিচয় নিই। ব্রিটিশ কিশোর এভারেস্ট মাত্র ষোল বছর বয়সে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে যোগদান করে ভারতে আসেন। সেটা ১৮০৬ সাল। ওর কয়েকটি বছর আগে ১৮০২ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে শুরু হয়েছিল গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক‍্যাল সার্ভে। ষোল বছরের কিশোর এভারেস্ট দেশে থাকতে কিছু মিলিটারি শিক্ষা পেয়েছিলেন। অত‍্যন্ত শৃঙ্খলা পরায়ণ, কর্তব‍্যনিষ্ঠ, তৎপর কিশোরটি ওই গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক‍্যাল সার্ভের কর্তা উইলিয়াম ল‍্যাম্বডনের চোখে পড়ে গেলেন। এই উইলিয়াম ল‍্যাম্বডন (১৭৫৩ – ১৮২৩) ছিলেন ইনফ‍্যানট্রি মিলিটারি অফিসার। তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভারতে একের পর এক এলাকা জিতে নিয়েছে। এলাকা সংহত করতে এলাকার খুঁটিনাটি মাপজোক জানা দরকার। ওই লক্ষ্যে মাদ্রাজের কাছে বেস লাইন ধরে ১৮০২ সালে সার্ভের কাজ শুরু হল। ওর আগে জেমস রেনেল সাহেব বাংলায় সার্ভে শুরু করেছিলেন। সেটা ১৭৬৭ সাল। রবার্ট ক্লাইভ রেনেল সাহেবকে সার্ভেয়র হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। মনে রাখতে হবে এর বছর দশেক আগে ১৭৫৭ সালে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছে। পলাশীর যুদ্ধ ছিল একটি নির্ণায়ক ঘটনা। রবার্ট ক্লাইভের কূট কৌশলে কোম্পানির হাতে বাংলার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয় ঘটে পলাশীর প্রান্তরে। ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর। অবশ‍্য কোম্পানির পক্ষে এই জয় হাসিল করতে অনেক সময় লেগেছে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তৈরি হয়েছিল ১৬০০ সালে। তারিখটা ত্রিশ ডিসেম্বর। তারপর ১৬১১ তে তারা মসুলিপত্তনমে প্রভাব বিস্তার করে। তারপর ব্রিটিশদের পক্ষে ধুরন্ধর কৌশলী টমাস রো বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরকে খুশি করে ১৬১২ তে সুরাটে ব‍্যবসা করার অধিকার।
১৭৫৭ থেকে শুরু করে ১৮৫৮ অবধি একশো বছর ধরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলেছে ভারতে। কোম্পানির শাসনে প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তারপর লর্ড কর্ণ‌ওয়ালিশ। ক্রমে ওয়েলেসলি, মিন্টো, হেস্টিংস, আর্মহার্স্ট, বেন্টিংক, হার্ডিঞ্জ, ডালহৌসি। এদের পর  লর্ড ক‍্যানিং হলেন কোম্পানির শাসনে শেষ গভর্নর জেনারেল। ১৮৫৮ সালে ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান হয়ে ব্রিটিশ সরকারের অধীনতা শুরু হয়। ১৮৭৪ সালের ১ জুন তারিখে কোম্পানিটিই উঠে যায়।
যাই হোক, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বা আর্টিলারি বিভাগে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ষোল বছরের কিশোর এভারেস্ট যোগ দেন। উইলিয়াম ল‍্যাম্বডনের সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জন করেন এভারেস্ট। ১৮২৩এ ল‍্যাম্বডনের প্রয়াণ হলে এভারেস্ট হলেন সুপারিনটেনডেন্ট অফ সার্ভে। তখন এভারেস্টের বয়স তেত্রিশ। আর ১৮৩০ সালে তিনি সার্ভেয়র জেনারেল অফ ইণ্ডিয়া হলেন।  মনে রাখতে হবে ভারতের প্রথম সার্ভেয়র জেনারেল ছিলেন কলিন ম‍্যাকেঞ্জি। সময়টা ১৮১৫ – ১৮২১। এর পরবর্তী সার্ভেয়র জেনারেল ছিলেন জন হজসন ১৮২১ – ১৮২৩। এভারেস্ট ওই পদে আসেন ১৮৩০ সালে। ১৮৪৩ সালে এভারেস্ট অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর আসনে অধিষ্ঠিত হন অ্যাণ্ড্রু স্কট ওয়া। ১৮৭১ সালে জেমস টমাস ওয়াকারের নেতৃত্বে গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক‍্যাল সার্ভে তার কাজ সুসম্পন্ন করে সমাধা করে। পরে ওয়াকার সার্ভেয়র জেনারেল হয়েছেন। সেটা ১৮৭৮ – ১৮৮৩। ততদিনে কোম্পানির শাসন অতীত ঘটনায় পর্যবসিত। এমনকি কোম্পানিটি গুটিয়ে গিয়েছে।
হিমালয় তথা পৃথিবীর সর্বোচ্চ তিনটি চূড়া এভারেস্ট, কারাকোরাম এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা, এদের চিহ্নিত করতে, গাণিতিক সূক্ষ্মতায় শিখরের উচ্চতা নির্ধারণ করতে গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক‍্যাল সার্ভের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সেই সার্ভের একসময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতৃত্ব ছিলেন কর্ণেল স‍্যর জর্জ এভারেস্ট।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *