T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সুজিত রেজ

সুতো জড়ানো সেতু

 

সুতো জড়ানো সেতু রাহু এবং কেতু
এলাইত শঙ্কা বেহুলা- ধৈর্যের ;
সুতো জড়ানো সেতু একটা জাল, খাঁচা
যা পেতে রেখে নিদডুব নিষাদের ।

 

যত সুতো ছাড়ি জড়িয়ে ফেলো আষ্টেপৃষ্ঠে
টানাপোড়েন চলে অনির্বাণ মোহে
উপোসের দিনলিপি থেকে
পোড়া মদনের নাভির গন্ধ বেরোয়
বুক পকেটে ঢুকে পড়ে মেঘ
বারিধারা অশ্রুত
জীর্ণ মাদুরের আত্মা, ছেদন গ্রন্থির চিৎকার
শুনতেশুনতেবেতারদুপুরকাটে
মোহনাইযদিলক্ষ্যতবেসিধেচলনইতোছিলশ্রেয়
বঙ্কুবিহারীর মতো কটাক্ষ নিক্ষেপের কী কারণ?
চড়াই-উতরাইয়ে পদস্খলন অস্বাভাবিক নয়,
সমতল করতলে কেন এই বিষমীভবন !

 


গান গাইলেই আমার গলা থেকে সুর নয় দুচারটে সুতো বেরিয়ে আসে।আহ্লাদী সূচ নৃত্য করতে থাকে। ভয় করে। হয়তো আমার গলাটাকেই সেলাই করে দেবে। গান গাওয়া দূর ছাড় আমি আর কথা বলতেই পারব না।তারপর থেকে আমি যতবার গান গাই গাছের কোটরে বসে কিংবা আম্রপল্লবে দোল খেতে-খেতে, সুতোগুলো গিলে নি একের পর এক।তাতে আমার হজমশক্তি কিছুটা বেড়েছে।পৌষ্টিক নালির জালিকা তো সুতোরই নকশা।সেইনকশায়শব্দের চোঁয়াঢেকুরওঠেযেননিঃশব্দ গেরিলা।সারাশরীর জুড়েফোটেকবিতার লীলা।কবিতারলীলা— কবিতার লীলা—শুধুই কবিতা।—“ধূম্রলোচননিদ্রাবিহীনমাঘরজনীরসবিতা”—

 

লাভা ফরেস্ট গেস্ট হাউস থেকে মনাস্ট্রি দেখতে যাব বলে বিকেলে বেরিয়েছি।
দেড় কিলোমিটারের মতো হাঁটা পথ। চড়াই। আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বয়স টের পাচ্ছি। মাঝে বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ বসলাম। চা পানের বিরতি। সঙ্গে ক্যাপসির পকোড়া। গরম গরম। মেয়ে বলল, চলো যাওয়া যাক। উঠতে গিয়ে পায়ে টান। শিরায়। তোরা যা বলে মনাস্ট্রি দর্শনে ইতি টানলাম।

এক সন্ন্যাসী আমাকে লক্ষ করছিল।খালিগা।কাছে এসেবললেন:
গেলেন না কেন?
বুদ্ধ দর্শন আমার ভাগ্যে নেই।
ওই তো বুদ্ধ—দেখে নিন।
সত্যি! সূর্য ডুবছে। লালিমায় ঢেকেছে সোনার শৃঙ্গ। তিনি শুয়ে আছেন।

কিন্তু সন্ন্যাসী কোথায় গেলেন— এই তো ছিলেন!

একটু দূরে দেখি আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। সন্ন্যাসী সেখানেই।
গায়ের শালটি খুলে ওঁকে বললাম: নিন, আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।
এটা কী?
শীতবস্ত্র?
বস্ত্র কী?
জানি না।
সুতো জড়ানো সেতু।।

 

আজও সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা।
জিজ্ঞাসা করলাম: আপনি কি বৌদ্ধ ভিক্ষু ?
উত্তর দিলেন না।
তবে, হিন্দু সন্ন্যাসী?
নীরব রইলেন।
জৈন নির্গ্রন্থ?
হাসলেন।
ফকির?

এবার তিনি মুখ খুললেন : এত প্রশ্ন কেন? কেন আমায় তোর সুতোয় বাঁধতে চাইছিস?
সুতোয় বাঁধলে গিঁট লেগে যায়। সে এমন গিঁট খোলা যায় না। তার চেয়ে এই যে আমি, এই যে তুই — এটাই সত্য, আর কী চাই?
চা খাবেন?
অনেকেই খায় না।
মুড়ি খাবেন?
অনেকেই পায় না।
তবে চলুন, ওইখানটায় গিয়ে বসি। গল্প করি।
গল্পের কোনো শেষ নেই।

 

চালের নাদায় দুটো ডাঁশানো আম রেখেছিলাম। পাকলে খাব, দুপুরে, চিঁড়েয় মেখে। আজ উপোস। জয় সন্তোষী মা।
বের করতে গিয়ে দেখি একটা নাসপাতি হয়ে গেছে। কী ব্যাপার!

ভাবতে-ভাবতে বারান্দায়। রোদ্দুর নেই। মেঘলা আকাশ। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়েছিল সকালে। কদমগাছের দিকে তাকিয়ে দেখি, জামরুলের ভারে নুইয়ে পড়েছে ডালগুলো।

সেই সময় ” চোখ গেল ” পাখির ডাক শুনতে পেলাম। ও মা! জামরুল খেতে-খেতে একটা দাঁড়কাক ” চোখ গেল ” ডাকছে।
চোখ কি আমার সত্যিই গেল? ডাক্তারের কাছে গেলাম। জোরালো টর্চের আলো ফেলে অনেকক্ষণ ধরে কী যেন খুঁজলেন। অতি উৎসাহের সঙ্গে জানালেন :
দিব্যদৃষ্টি। মায়াপথ ধরে হেঁটে গেলেই ছায়াপথ খুঁজে পাবেন।
চোখ খুলে দেখি, ডাক্তার নয়, দাঁড়িয়ে আছেন সেই সন্ন্যাসী!

 

হারকিউলিস চড়ে স্বর্গে যেয়ো না,স্বর্গে সাইকেল স্ট্যান্ড নেই।

তারচেয়ে স্ট্রান্ডের ধারে এসো ,
আমরা দু’জনা স্বর্গ খেলনা গড়ি।

ইচ্ছে হলে লঞ্চে চেপে জগদ্দলে যাই ;
বিশ্বকর্মাদের জীবনের পাণ্ডুলিপি পড়ি ।
চটকলের গেটে গেটে সুতলি জড়ানো গিঁট
ধৈর্য ধরে খুলে ফেলি বাতুল স্বভাবে ।

গ্রন্থিমোচনের একটি সুতো আছে।
এবং তা টানতে জানতে হয়।
শুধু কি জানা, নিরন্তর চর্চারও প্রয়োজন।

 

আমাকে সে যদি ডাকে যাব না যাব না
কিছুদিন নদীতীরে ঘুরি আর কিছুদিন
অমৃতদুয়ার বন্ধ হয়নি যখন এখনও সুযোগ
পান করে যাই ভাম সিমড্রোমে মরা গাঙে বান

দখিন দুয়ার খোলা শনশনে হাওয়া ফাজিল
দেখতে দেখতে এবং কচ্ছপ বুড়ো হয়ে গেল
আর তিনদিন পর পিরিত সুবর্ণ জয়ন্তী
কলাপাতা ঘষা পিচকিড়ি রং সস্তা মাড়ভাত

বর্ষাতির গল্প শেষ মুখে মুখে ঘুমায় শরীর
যমুনাবতী সরস্বতী নীপবীথি লাল সিঁথি
সন্ধ্যাভাষা ফুঁসলে নিল দোলে দোদুল ঝুলনা
গর্ভগৃহে ভুজ্জি চড়ায় চতুরানন ব্রহ্মা

বাতাসের মতো প্রেম দৃশ্যত অদৃশ্য রক্তকরবীর রাজা
অনুভূতি-দ্বারও বন্ধ কার্বোলিক বিজ্ঞপ্তিতে
দুব্বো ঘাসে হোঁচট খেয়ে কড়ে আঙুল পচনশীল
সোনালি সম্পর্ক সব ড্যাফোডিল হয়ে ফোটে

 

এত ঢেউ এত ঢেউ ওঠে কেন?
শেষমেশ সেই তো বুদবুদ,
হয়ত কিছু কথাবালি হারাবে ঘর…
যাকে তুমি মিছে ভাবো কবিতার চর।

এত চাও এত চাও কেন?
শেষমেশ সেই তো চাটিল পা,
ভবনদী গহন গম্ভীর বেগে বয়…
ভেসে যায় সব শুধু নাভিমূল রয়।

এত কাছে এত কাছে কেন?
শেষমেশ সেই তো সাত ক্রোশ,
ধেয়ে আসে বিচ্ছেদ তরঙ্গ…
খাড়ি জুড়ে কাঁদে নিঃসঙ্গ।

এত গূহ্য এত গূঢ় কথা কেন?
শেষমেশ সেই তো কাপাস তুলো,
উড়ে যায় তত্ত্বীয় পোড়া ছাই…
ভাবগম্ভীর বয়ানে আদর্শ বিকাই।

 

যে-অন্ধকার ঘরে তুমি বাস করছ
তার কোনও দরজা নেই,
তাই ছাদ ফুঁড়ে নির্গমনের পথ নির্মাণের শক্তিতোমাকেই অর্জন করতে হবে।
দুএকটি জানালা আছে,
ইশারা অবিরত,
আর দধীচি-গরাদ।কবেই
তার মজ্জা শুকিয়ে গেছে।

এই রাত শুধু লিখে যায় অন্ধকারের বানান।
কবে আলো এসে
তা যুক্তাক্ষরহীন উচ্চারণ করবে?
সেই আশা নিয়ে,
আমি ছোটো এক টাকার কয়েনের মতো
অপলক ক্ষুৎকাতর দৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকি দুঃখের সানকিথালায়।

জানি,অন্ধকারের কোনও বানান হয় না।

 

বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি , হা করলেও দাঁত দেখা যাচ্ছে না আবার বিশ্বরূপ দর্শনও হচ্ছে না।

পায়ের ছাপ পড়ছে না রাঙা পথের ধুলোয়। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও প্রশ্বাস আটকে থাকছে ফুসফুসে। চিরুনির দাঁড় পটপট করে ভেঙে যাচ্ছে কেশবিন্যাসে।

কথা বলার সময় জিভ ঠেকছে না যথাযথ উচ্চারণ স্থানে। মগজ বলে কিছু আছে বোধ হচ্ছে না একেবারেই। চোখের জলে ভাসছে তার্পিন তেল।

গির্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে মনে হচ্ছে , হুটার বাজিয়ে মন্ত্রী এসে ঢুকে পড়ছে কর্ণকুহরে।

এইসব নেতির মধ্যে সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে , তোমায় দেখে ফেললাম , এইটুকুই যা প্রাপ্তি।

এখন বুঝতে পারছি , রবীন্দ্রনাথ কেন লিখেছিলেন , গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।

 

তৃতীয় নয়ন ছিল না এত ভস্ম এল কোথা থেকে
কোথা থেকে এল এই অশরীরী আগুনবাতাস
ভেলাঘর পুড়ে যায় স্বর্ণকমল সলিলে
সবকিছু ফিরে আসে জোয়ারে, অহঙ্কারও

টুপ করে খসে পড়ে বাঘ রঙা হেতাল বল্কল
মাঝেমধ্যে মনে হয় এইসব তিন পয়সার পালা
আর্তনাদ শুনি এক বায়বীয় বাঁকুড়া ঘোড়ার
তখন প্রেমিক ছিলাম এখন আত্মপ্রতারক

সবুজ টিয়ার ঠোঁটে প্রশ্নচিহ্ন নিরুত্তর
প্রতিভাকে তুলে ধরে পাপেটদক্ষ সিসিফাস
আগ্রহের উজ্জীবন ধারণক্ষমতা অনাচার
ৎ-এর মতন পুচ্ছ নড়ে দৈব হুলাহুলি

সংশয়ী আঙুল ঘষে গান্ধির চশমা মুছি
প্রোফাইল রোদ্দুরনৃত্য স্বচ্ছ মহাহা-ভারত
গোয়ালপাড়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে মহাপ্রস্থান কুকুর
মুগ্ধ লালারসে সিক্ত অচিরার নটনিকেতন

মুষ্টিবদ্ধে ভীষ্ম ভাঙে বেলজিয়াম গ্লাসওয়াল
জৈবসার টুইটার ফেসিয়াল নেটিজেন
দোহার পাসওয়ার্ড কণ্ঠে আকরিক লোভ
মৎসমদির চঞ্চলভেজাইনা তন্বী ছিপ

 

পার্কে পার্কে আঙুরের ছেলেমেয়ে।
বিনিসুতোয় মালা গাঁথা হয় এখানে ,
ঝিঁঝিঁ ডাকার আগেই নেমে
আসে খাজুরাহোর সন্ধ্যা।
বোতলে পোরা বসন্তবৌরি শিস্ দেয় ,
চোখের পাতায় দোল খায় পিঙ্কি রঙের খোয়াব।
আলো ও আলেয়ার সখ্যলীলায়
বারোয়ারি দুর্গা প্রতিমার মতোমুখ বদলে-বদলে যায়।
সারাদিন চুপ থাকার পর
সাঁঝাল আলোয় মৌন পাহাড় কথা বলে।
কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে গিয়ে
অর্ধেক রস নষ্ট করে অনামিকা।
অলীক উল্লাসে ভাঙা হয় বীজধান।
কমা-কোলন সহ্য হয় না— দাঁড়ি দূর ছাড়!

 

নলিতে ধরেছে ঘুন গলিতে বিস্ময় ক্ষত
ঘুমিয়েছে ঝাউপাতা গোঁসাই বাগানে
কারণ খুঁজতে গিয়ে ভেঙেছে চশমার ডাঁটি
গরিব নাদবৌ আমার এনেছে ঈষদুষ্ণ গরম জল

বাথরুমে শুয়ে শুয়ে ধনেশ পাখির ঠোঁটে
গা ঘষে ঘষে সাধু ভাষায় ছিন্ন করেছি
সমাস সন্ধির সন্দেহ পদ
এর আগে কত নদী কুণ্ড হ্রদ তালে তালে
শালপাতা কলাপাতা চৌকো নৌকো
দুগ্ধ দধি ঘৃত আতপ সুমারি
দাও ভাণ্ড নাও অণ্ডের কুষ্ঠকোষ
ষণ্ডচাঁড়াল আমি
খেয়েছি শুধু সাতসকালের খেজুর রস

ফাজিল নেশাড়ু সেজেছি
পুচ্ছ তুলে গুচ্ছ ফুলে উদ্দাম নেচেছি স্বার্থসাথির অনুসন্ধানে
উপহার পেয়েছি মেঘজমি বাইশশো বর্গ ছাদ
খাতাবুক ডাউনলোড করে দেখি
সবই মধুর পরমাদ

বিশ্বাসে দিয়েছিদেহতর্কে বুঝেছি তা ছিলনিস্পন্দ কঙ্কাল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।