মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস
পুঁজি জিনিসটা কী? পুঁজি হল অতীত শ্রমের উদ্বৃত্তমূল্যের জমিয়ে তোলা রূপ; শ্রম থেকেই পুঁজি তৈরী হয়। পুঁজির কাজ হল, শ্রমের উদ্বৃত্তমূল্য যা মজুর শ্রমিক রোজ রোজ তৈরী করছে, তা চুরি করে নিজের ঘরে তোলা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সূচনা হয়েছে প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবিক সুবিধার জোরপূর্বক দখলদারির মধ্য দিয়ে। প্রকৃতি মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ও সমহারে যে সুযোগ সুবিধা আর অধিকার দিয়েছিল; তা মুষ্টিমেয় লোক গায়ের জোরে, লাঠির জোরে নিজেদের কুক্ষিগত করে নিল। আর তাই থেকে কিছু বিশেষ সুবিধা পেতে লাগল তারা। আর ওটাই হয়ে দা়ঁড়াল তাদের আলাদা করে পাওয়া অধিকার, আর এই জিনিসটাই গজিয়ে তুলল আইন আর সরকারকে। একটা বৃহৎসংখ্যক সম্পত্তিহীন নিঃস্ব মানুষের দল না থাকলে পুঁজি জিনিসটা গড়েই উঠতে পারে না। তার মানে মানুষের সমাজে একটা শ্রেণী রয়েছে, যাদের বেঁচে থাকার একটাই মাত্র উপায় রয়েছে, তা হল পুঁজিপতিদের কাছে তাদের শ্রম বিক্রয় করা। পুঁজিবাদকে রক্ষা করে, উৎসাহ দেয়, ধারাবাহিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলে আইন। বাস্তবে পুঁজি হল আইন। আর আইন হল পুঁজি। আমি আপনার বেশি সময় নেবো না। পুঁজি জিনিসটা ছোট্ট করে বলে বোঝানোর সুযোগ নিলাম। এবার বলব শ্রম জিনিসটা কী? শ্রম হল একটা পণ্য যার বাজার দাম হল মজুরি। এই পণ্যের মালিক হল শ্রমিক। আর সে নিজের স্বার্থে, নিজের রুটি রুজির প্রয়োজনে এই শ্রম পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করে । শ্রম হচ্ছে শ্রমিকের শক্তি। তার জীবনীশক্তি। তাকে বাঁচতে গেলে অন্য কারো কাছে তার এই শক্তিটা বিক্রি না করে কোনো উপায় নেই। এই বিক্রি করাটাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। সে বাঁচার স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু তার কাজের পুরোটা তার নিজের জীবনের স্বার্থে নয়। বরং সে এই শ্রমের খানিকটা ত্যাগ করে। তার মানে সে যে শ্রমটা দেয় তার খানিকটা ফ্রি লেবার — বিনা মজুরির শ্রম। সে এটা করতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি তাকে এই বেগার খাটতে বাধ্য করে। সে যেটুকু মজুরি হাতে পায়, সেটা তার শ্রমের মূল্য আদৌ নয়। তার থেকে অনেক কম সে হাতে পায় । যে রেশমি সুতো সে বয়ন করে, যে প্রাসাদ সে নির্মাণ করে, যে আকরিক সে খনি থেকে তুলে আনে, তা তার নিজের জন্য নয়। সে নিজের জন্য যেটুকু পায় তা হল ওই মজুরি। কিন্তু ওই রেশম, ওই আকরিক আর ওই প্রাসাদ ওই প্রাসাদ যা সে হাতে করে গড়ে তুলেছে তার বদলে সে কি পায়? সামান্য একটা শার্ট, কয়েকটা মুদ্রা, আর একটা কুটিরে থাকতে পাওয়া। অন্য কথায় তাকে ঠিক ততটুকুই মজুরি দেওয়া হয় যাতে সে নামমাত্র দিন গুজরান করতে পারে। আর যে টাকাটা তাকে তার শ্রমের বিনিময়ে দেওয়া হল না, সেই চুকিয়ে না দেওয়া উদ্বৃত্তমূল্য, সে জিনিসটা শ্রমবিমুখ পুঁজিপতি শ্রেণীর বিপুল অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলে। অল্প কথায় এই হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিচয়। এই যে পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমের উদ্বৃত্তমূল্য কেড়ে সেবার ব্যবস্থাটা তৈরী করেছে এ থেকেই সংঘর্ষ ঘনিয়ে উঠছে। সম্পত্তিহীন নিঃস্ব শ্রমিকের উপর পুঁজিপতিদের শোষণ, যতটা তীব্র ও ঘনীভূত হচ্ছে এই সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব ততটাই তীব্র হয়ে চলছে। যখন মুষ্টিমেয় অলস ব্যক্তি আরো বেশি বেশি করে ধনী হয়ে উঠতে থাকে আরো বেশি বেশি সংখ্যক মানুষ গরিব হয়ে যেতে থাকে, সেই জিনিসটাই শ্রমিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। এই শ্রমিক আন্দোলনটাকেই আপনারা শ্রমিক সমস্যা হিসেবে চেনেন। সম্পত্তির মালিক হলে মানুষের ক্ষমতা বাড়ে আর মানুষ দীন দরিদ্র হতে থাকলে তার ক্ষমতা কমে। আমার হাতে যদি আরো সময় থাকত তাহলে এখানে উপস্থিত কিছু কিছু ভদ্রজনের মধ্যে যে প্রশ্ন উঠে আসছে, যে বিকল্প ভাবনা মাথা তুলছে তার উত্তর দিতাম। হয়ত আপনার মনেও নানাবিধ প্রশ্ন মাথা তুলছে। কেননা আপনারা তো এই সব বিষয় নিয়ে গভীর চর্চা করেননি। আমার যেন মনে হচ্ছে আপনি বলতে চাইছেন, কেন, শ্রমিকেরা তো স্বাধীন। পছন্দসই জায়গায় গিয়ে পছন্দসই কারখানা বেছে পছন্দসই মালিকের কাছে শ্রম বিক্রি করতে তো এদেশে কোনো বাধা নেই। এটা একটা অবাধ গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু শুনুন, এই আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলোয় শতখানেক বছর আগেও এক ধরনের শ্রমিক ছিল। তাদের বলা হত চ্যাটেল দাসশ্রমিক। ওই জিনিসটার অবসান হয়েছে। আর আপনি বলছেন শ্রম হল মুক্ত। আর ভেবে দেখুন, এই শ্রমকে মুক্ত করতে আমেরিকায় যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমি ঠিক বলছি কিনা ভেবে দেখুন। আজকে যারা মজুর শ্রমিক, তারাই আগে চ্যাটেল দাসশ্রমিক ছিল। তখন প্রভুরা কে কে কাজ করবে এমন দাস পছন্দ করে নিত। আর আজকের মজুর শ্রমিক ব্যবস্থায় মজুর দাস তার মালিককে বেছে নেয়। আগে প্রভু দাসকে বাছাই করত, আজ দাস তার প্রভুকে বাছাই করে। দাসকে কোনো না কোনো প্রভু বাছতেই হবে। আর আমার পাশে আমারই মতো একটা ছোট্ট কুটিরে মাথা গুঁজতেই হবে। একটা প্রভু খুঁজে নিতে আজকের দাস বাধ্য । তাই সাউদার্ন কনফেডারেসির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিস নিউইয়র্ক হেরাল্ড সংবাদপত্রকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে দক্ষিণের প্রদেশগুলির চ্যাটেল দাসব্যবস্থার সঙ্গে উত্তরের প্রদেশগুলির তথাকথিত মুক্তশ্রমিকের তুলনা করে যা বলেছিলেন তা আমার মনে পড়ে গেল। জেফারসন ডেভিস চ্যাটেল দাসশ্রমিক এবং মুক্তশ্রমিকের মজুরি নিয়ে বলতে গিয়ে সোজা সরল ভাষায় বললেন — এই যে বদলটা যা দাসশ্রমিককে তথাকথিত মুক্তশ্রমিক বানিয়ে দিল তাতে মালিকদের বিরাট সুবিধা হয়েছে বলেই উল্লেখ করেছেন। মুক্তশ্রমিকের যুগে শ্রমিকের মৃতদেহ সৎকার করবার দায় তাদের নিজেদের। আর রোগজ্বালা হলে ডাক্তার দেখানোর কোনো দায় মালিকের নেই। শ্রমিকরা কেমন আছে না আছে, তাদের ভালো মন্দ লক্ষ্য রাখার জন্য কোনো পরিদর্শক পোষার ঝক্কি নতুন মালিকের নেই। এখন তারা শ্রমিককে কোনো একটা কাজ করিয়ে নিয়ে তার জন্য বাঁধাধরা একটা মজুরি দিয়ে দেবে। তারা বলবে এই যে, এতটা সময়ের মধ্যে এই কাজটা করে দাও। আর তুমি যদি সময়ের মধ্যে এই কাজটা উতরে না দিতে পারো, পরের শনিবার হপ্তার দিনে যে খামটায় তোমাকে টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয় তাতে একটা চিরকুট দেখতে পাবে, তাতে লেখা: তোমার কাজ থেকে বরখাস্ত করা হল। এখন জেফারসন ডেভিস স্বীকার করেছেন যে, চ্যাটেল শ্রমিকের ঘামের নুন জলে চুপচুপে পোশাকটাই মজুর শ্রমিকেরা গায়ে গলিয়ে নিয়েছে। আজ মজুর শ্রমিকেরা যারা সার্বভৌম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিকদের মোট সংখ্যার দশ ভাগের নয় ভাগ, তাদের স্বাধীনতা মানে নিত্যদিন ক্ষুধার চাবুক খাওয়া। খালি পেটে থাকা আর ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরে দিন কাটানো। এই হল আমেরিকায় স্বাধীন শ্রমিকের চিত্র। আপনি বলবেন মজুর শ্রমিকরা চ্যাটেল দাস শ্রমিকদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে। বলবেন চ্যাটেল শ্রমিকরা তাদের কাজের জায়গা ছেড়ে ভিন্ন জায়গায় যাবার অনুমতি পেত না। বেশ তাহলে একটু সংখ্যাতত্ত্বের দিকে তাকানো যাক্।