ক্যাফে ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৬)

অ্যাটমের গহনকথা

 

ডি ব্রগলি ও ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্মিতা।

ইলেকট্রনের চলন ও চরিত্র সম্বন্ধে নতুন কথা নিয়ে এলেন অভিজাত বংশের সন্তান পদার্থবিজ্ঞানী লুই ভিক্টর পিয়ের রেমণ্ড ডি ব্রগলি (১৫ আগস্ট ১৮৯২ – ১৯ মার্চ ১৯৮৭)। ফরাসি উচ্চারণে অবশ‍্য ওঁর নাম লুই দ‍্যু ব্র‌অলি। যাই হোক পিয়ের কুরির ছাত্র ও মেরি কুরির ঘনিষ্ঠ বিজ্ঞানী পল ল‍্যাঙ্গেভিন ( ২৩ জানুয়ারি ১৮৭২ – ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪৬) এর তত্ত্বাবধানে ডি ব্রগলি পারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিলেন। ব্রগলির গবেষণাপত্রের নাম ছিল “রিসার্চ অন দি থিয়োরি অফ কোয়ান্টা (১৯২৪)”। তাতে তিনি বলতে চাইলেন, গতিশীল কোনো কণা বা কোনো বস্তুর সঙ্গে সহভাগী তরঙ্গ থাকে। এতে করে ওয়েভ মেকানিক্স বা তরঙ্গ বলবিদ‍্যা নামে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের একটা শাখা গড়ে উঠল। এটা ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের কথা। অনেক পরে ১৯৫০ এর দশকে বিজ্ঞানী ডেভিড বোহম ( ২০ ডিসেম্বর ১৯১৭ – ২৭ অক্টোবর ১৯৯২) এর হাত ধরে ডি ব্রগলির তত্ত্ব আরো মার্জিত ও পরিশীলিত হয়ে ওঠে।
নিজের পিএইচডি থিসিসে ডি ব্রগলি ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্মিতা নিয়ে ধারণা দিলেন। আরো বললেন, সকল পদার্থের মধ‍্যেই একটা তরঙ্গধর্মিতা রয়েছে। ব্রগলির দেওয়া এই যে ধারণা, একেই বলে ডি ব্রগলি হাইপথিসিস। ডি ব্রগলির দেওয়া এই তত্ত্বকে ঘিরে কোয়ান্টাম বলবিদ‍্যা গড়ে উঠতে থাকল। ব্রগলির দেওয়া এই তত্ত্ব, ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্মিতা নিয়ে তাঁর এই সাড়া জাগানো ভাবনা ব্রগলি বিভিন্ন বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশ করছিলেন। তবে পারমাণবিক পরিসরে পদার্থের যে একটা তরঙ্গধর্মিতা থাকে, ১৯২৪ এ ব্রগলি এমন আভাস দেবার বছর কুড়ি আগেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এ ধরনের কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট আলোকে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে লক্ষ্য করলে তার আচরণ দেখে মনে হবে যেন তারা কণা দিয়ে তৈরি। আইনস্টাইনের এমন ধারণা ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে পায়ের তলায় মজবুত ভিত্তি পেয়েছিল। এই রকম সময়েই সেপ্টেম্বর ১৯২৩ এ ব্রগলি তাঁর ভাবনা চিন্তা জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন। ১০ সেপ্টেম্বর১৯২৩ তারিখে পারীর আকাদেমি অফ সায়েন্সেস এ তিনি ওয়েভস অ্যাণ্ড কোয়ান্টা বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। তবে আলোর দ্বৈত চরিত্র বিষয়টা প্রথম প্রথম বিজ্ঞানীমহলে তত গৃহীত হয় নি, কিন্তু ব্রগলি এর পরে তাঁর ধারণাকে আরো বিস্তৃত করে পদার্থের মধ‍্যে দ্বৈততার কথা বললে ক্রমশঃ তা মান‍্যতা পেতে শুরু করল। পরমাণুর মধ‍্যে ইলেকট্রনের গতি নিয়ে গণনা করতে গিয়ে যে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল, ডি ব্রগলির দেওয়া ধারণা তার উত্তরের দিশা দেখাল। পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে বোঝা যাচ্ছিল, ইলেকট্রনকে নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রকের চারপাশে ছুটে বেড়াতেই হবে, কিন্তু তখনো অবধি বোঝা যাচ্ছিল না যে কেন ইলেকট্রনের গতির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা নিষেধ কাজ করে। ডি ব্রগলির পেশ করা তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ইলেকট্রনের ধারণার ভিত্তিতে তেমন সব বাধা নিষেধযুক্ত গতির একটা সন্তোষজনক ব‍্যাখ‍্যা পাওয়া গেল।
পরমাণুর কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস। তার আধান আছে। সেই নিউক্লিয়ার আধানের প্রভাবে পরমাণুর মধ‍্যে থাকা কোনো তরঙ্গ নির্দিষ্ট সীমার মধ‍্যে আবদ্ধ থাকবে। তেমন তরঙ্গের চেহারার উপরেও সেই নিউক্লিয়ার আধানের কর্তৃত্ব থাকবে।এই গতিশীলতার মধ‍্যে যে তরঙ্গের চেহারা পরমাণুটির সীমার মধ‍্যে খাপ খাবে না, তাকে পরমাণুটির বাইরে হঠে যেতে হবে। কিন্তু ১৯২৩ এ যখন ডি ব্রগলি এসব কথা বললেন, তার ভিত্তিমূলে সেভাবে কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা হতে প্রাপ্ত তথ‍্যাদি ছিল না। অথচ সেই সময়ে ইলেকট্রনের কণাধর্মিতা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ‍্য দিয়ে বিজ্ঞানী মহলে খুব ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কেউ কেউ জানতেন, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ইলেকট্রন বিকীর্ণ শক্তির মতো আচরণ করে।
এই রকম একটা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ডি ব্রগলির পেশ করা ইলেকট্রন সম্বন্ধে নতুন ধ‍্যানধারণা একটা হঠাৎ আলোর ঝলকানি হয়েই দেখা দিল। ডি ব্রগলির দেওয়া নতুন এই ধারণা, যা তখনো বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি নয়, স্রেফ ইনটুইশন, বাংলাভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে যাকে স্বজ্ঞা; অনুভুতি; স্বতঃলব্ধ জ্ঞান; কোনো সচেতন বিচার-বিবেচনা বা যুক্তি-তর্ক ছাড়া কোনো বিষয়ে অব্যবহিত জ্ঞান, এভাবে বলতে পারি, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ডি ব্রগলির দেওয়া ম‍্যাটার ওয়েভ বা পদার্থ তরঙ্গের ধারণা প্রথম যখন প্রকাশিত হল, তখন তা পদার্থবিজ্ঞানী মহলে বিশেষ পাত্তা পেল না। কিন্তু তাঁর ডক্টরাল থিসিসের একটি কপি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আইনস্টাইন এই গবেষণাকে শুধুমাত্র প্রকাশ‍্যে সুপ্রচুর অভিনন্দন জানিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, এই তত্ত্বকে আরো বিকশিত, আরো অগ্রসর করে তোলায় ব্রতী হলেন।
খোদ আইনস্টাইন ডি ব্রগলির তত্ত্বকে প্রশংসা করছেন, ঘষামাজা করছেন জেনে অস্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী আর‌উইন শ্রয়ডিঞ্জার ( ১২ আগস্ট ১৮৮৭ – ০৪ জানুয়ারি ১৯৬১) ইলেকট্রনের এই তরঙ্গধর্মিতা নিয়ে বিশদে জানতে আগ্রহী হলেন, এবং ডি ব্রগলির দেওয়া ধারণাকে ভিত্তি করে ওয়েভ মেকানিক্স বা তরঙ্গ বলবিদ‍্যা নামে একটি গাণিতিক পদ্ধতি ও প্রতীতি গড়ে তুললেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় একটি অপরিহার্য কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল।
এর কয়েকটি বছর পরে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানীদ্বয় ক্লিন্টন জোসেফ দাভিসসন ( ২২ অক্টোবর ১৮৮১ – ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮), এবং লেস্টার হ‍্যালবার্ট জার্মার ( ১০ অক্টোবর ১৮৯৬ – ৩ অক্টোবর ১৯৭১), এই দুজনে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আর পৃথকভাবে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জর্জ পাজিট টমসন ( ৩ মে ১৮৯২ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) স্বাধীনভাবে গবেষণা করে ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্মিতা নিয়ে পরীক্ষাভিত্তিক প্রমাণ পেলেন। টমসনের সঙ্গে তাঁর ছাত্র আলেকজান্ডার রেইড গবেষণা করেছিলেন। বলা দরকার টমসনের এই ছাত্র‌ই প্রথম দিকের পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলি করেছিলেন। পথদুর্ঘটনায় রেইডের অকালমৃত্যু হলে টমসন বাকি গবেষণা একাই করেছেন। দাভিসসন-জার্মার এবং টমসনের শ্রমে ও মেধায় ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্মিতা নিয়ে ডি ব্রগলির ধারণা বড়মাপের স্বীকৃতি পেল। ডি ব্রগলি তাঁর গবেষণার সূত্রে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর দাভিসসন ও টমসন যৌথভাবে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।