• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২)

আমার কথা 


তখন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান নিয়ে খুব হৈচৈ হত। বড় বড় ফুটবল ম্যাচ চলার সময় রাস্তা শুনশান হয়ে যেত। তার পর কোন দল ম্যাচ জিতেছে সেই সূত্রে রাস্তায় হৈ চৈ। দড়ি দিয়ে এপার ওপার খাটিয়ে বড় বড় কচুপাতা ঝোলানো হত। মানুষ তীব্র প্যাশন থেকে ইলিশ মাছ কিনত। আমাদের বাড়ি ছিল নিস্তরঙ্গ। সেখানে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের ঢেউ এসে পৌঁছত না। বাবা ছিলেন মিতব্যয়ী। যুক্তিসংগত ক্ষেত্র ছাড়া তিনি অর্থব্যয় করতেন না।

দুর্গা ঠাকুর বিসর্জন হত কুঠিঘাটের গঙ্গায় আর সে সব দেখে নদীর জল ঘটে করে নিয়ে বাড়ি এসে বেলপাতায় “শ্রী শ্রী দুর্গা শরণম” লিখতে হত। মাটির তৈরী দোয়াতদানি আর খাগের কলমে লেখা। তার পর হোমিও ডোজ এ সিদ্ধি দেওয়া শরবৎ পান। মায়েরা গল্প করতেন কি কি করলে সিদ্ধির শরবতে সাংঘাতিক নেশা হয়। তামার পয়সা ঘষলে না কি অমন হয়। আর শরবতের পর বেশি মিষ্টি খেলেও বেশি নেশা হয় মায়েরা বলাবলি করতেন। বাড়িতে কোনো ধরণের নেশার চল ছিল না। মদ্যপানকে গর্হিত অপরাধ হিসাবে দেখা হত। ধূমপান বাবা জেঠারা কেউ কোনোদিন করতেন না। সেভাবে চা পর্যন্ত খাবার চল ছিল না বাড়িতে। নেশা যদি অতি খারাপ জিনিস তা হলে বারোয়ারি দুর্গাপূজার হিসেব লাল কালিতে ছাপিয়ে খরচের কলমে সর্বপ্রথমে সিদ্ধি কথাটি লেখা হত কেন কে জানে!
অনেক রাতে পাশের বাড়ির একটি পাঁড় মাতাল ফিরতে ফিরতে ভিয়েতনাম আর ইন্দোচীন নিয়ে স্খলিত কণ্ঠে কি সব বলতে বলতে ফিরতেন। ভয়ে কাঠ হয়ে সেটা শুনতে পেতাম। তখনো শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামে কবির কথা, তুষার রায় নামে কবির কথা শুনি নি।

নদীর ধারের রাস্তাকে যে স্ট্র্যান্ড বলে সেটা ইংরেজি কবিতার সাথে বাস্তবে মিলে গিয়েছিল। কুঠি ঘাটের গঙ্গা তীরে ছিল হরকুমার ঠাকুর স্ট্র্যান্ড । আমাদের বাল্যকালে বরানগর থানাটি ছিল গঙ্গা তীরে। ভৌগোলিক ভাবে সেটা বরানগরের একেবারে একটেরে। অমন হবার কারণ কি ছিল কে জানে। ছুটির দিনে সকাল বিকাল গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটার সুযোগ হলেই থানার হাজতটা চোখে পড়ত। হাজতের ভিতর মাঝে মধ্যে দু একজন বসে থাকত। লোহার মোটা গেট আর ভারি তালার আগল ডিঙিয়ে তাদেরকে খুব দুর্বৃত্ত মনে হত না। হাজতটা যে আর যাই হোক, জেলখানা যে নয়, সেটা জানতে সময় লেগেছিল।

সেই সব দিনে, সত্তর দশকের শেষে বাংলার কল কারখানাগুলো নষ্ট হবার বাকি ছিল। বরানগরে চারদিকে কারখানা। আলমবাজারে জুটমিলে বিস্তর লোক কাজ করত। বেঙ্গল ইমিউনিটিতে শিফট চেঞ্জ এর সময় খানিকক্ষণ রাস্তা দিয়ে চলা যেত না। অনেক শ্রমিক কাজ করতেন। সিঁথি মোড় সার্কাস ময়দানে ছিল কার্টার পুলার নামে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। কাশীপুরের অস্ত্র কারখানা ছিল বিখ্যাত। আর ছিল ব্যাটারি ফ্যাক্টরি। গঙ্গার ধারে হরকুমার ঠাকুর স্ট্র্যান্ড এ একটি সাবান কারখানা আর একটি রং কারখানা দেখেছি। আমাদের কালিদাস লাহিড়ী লেনের মুখে একটি কারখানা ছিল। নাম ছিল বরানগর ব্রাস ফাউন্ডরি। লোকমুখে কালী বাবুর কারখানা না কি একটা বলা হত, সে আর আজ মনে নেই। সারাদিন একটা বিরাট লোহার চাকা ঘুরে চলত মনে আছে। বামফ্রন্টের উপর্যুপরি জয় আর নিরবচ্ছিন্ন জনপ্রিয়তায় বরানগরের সব কারখানা গুটিয়ে গেল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।