জাপানি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম – আমাদের প্রিয় কবি তোমাদের এক কবির কথা বলেছেন। সেই জাপানি কবির নাম নোগুচি ।
জাপানের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়েও দরিদ্র চীনের উপর জাপানের আক্রমণকে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার দিয়েছিলেন।
যাতে ওরা যুদ্ধ জিততে পারে তাই জাপানি সেনা কর্মীরা দলে দলে ভগবান বুদ্ধ কে প্রণাম করতে মন্দিরে যাচ্ছিল । যিনি শান্তি ও অহিংসার পক্ষে চিরজীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই বুদ্ধের মন্দিরে গিয়ে যুদ্ধ জেতার বর প্রার্থনার মতো নিষ্ঠুর আর কি হতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ তাই ধিক্কার দিয়েছিলেন সেই জাপানি সমর লোলুপ দের।
তাঁর বুদ্ধভক্তি কবিতায় এসব পেয়েছি। জাপানি মেয়েটিকে এত কথা বলে উঠবার সুযোগ পেলাম না।
১০৬
যাকে মহৎ সাহিত্য বলে, তাকে চিরকাল চিন্তাবিদেরা শ্রদ্ধা করে এসেছেন। কবিতা কি হবে, কেন হবে, তৃতীয় শ্রেণির রাজনীতি করে খাওয়া লোকেরা ঠিক করে দেন নি, দিতে পারেন নি। বাংলায় কাজী নজরুল, সুকান্ত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের মতো বড়ো কবির লেখা পড়ে অনেকেই ভাল কাজ করতে উৎসাহ পান। মহৎ সাহিত্য অনেক সময় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মার্কা মারা লেবেল সাঁটা বোতলে পোরা জিনিস হয় না। মহৎ সাহিত্য নিজের নিয়ম নিজে লেখে। রাজনৈতিক গুরু ঠাকুর পাণ্ডা পুরুতের কাছে তার টিকি বাঁধা নেই।
১০৭
আমার মা তাঁর বিয়েতে কতকগুলি বই উপহার পেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল “দীপিকা” । সেটি নানা ধরণের রবীন্দ্র রচনার একটি চয়ন। কবিতা গল্প প্রবন্ধ রস রচনা মিলিয়ে সেই আমার সিলেবাসের বাইরে রবীন্দ্র পাঠ । তখনো প্রাথমিক স্তরে পড়ি। আর ছিল ” ঘরে ফেরার দিন” । অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা। নাভানা থেকে প্রকাশিত। তখন কি আর জানি যে অমিয় চক্রবর্তী রাশিয়ার চিঠির সাথে যুক্ত ? তিনি মহত্তম কবির সচিবের কাজ করেছেন ? সেই শৈশবে পড়া কবিতা গুলির কয়েকটি এখনো মনে করতে পারি । সে সব দিনে লোকে বিয়েতে বই দিত। সে বই যে পেত সে তো পড়তোই , তার আপন জনেরাও পড়তো। আমি বিয়েতে বই দেবার পক্ষপাতী । কিন্তু সম্প্রতি দেখছি বই উপহার দিলে সে বই যাকে উপহার দিলাম, তিনি পড়ছেন না। জিজ্ঞাসা করলে বিব্রত বোধ করছেন। আমি ঠিক করেছি , যার সাথে কোনোদিন বই পড়ার সুখ নিয়ে তুমুল আলোচনা হয় নি, তার বিয়েতে যাব না। বই উপহার দিতে না পেলে সে সব বিয়েতে আমি নেই।
১০৮
একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে তারিখ দুটো এলে আমাদের খেয়াল পড়ে বাংলা ভাষাটার জন্যে কিছু একটা করা উচিত।
কি করা উচিত ? ছেলেটাকে ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পড়াবো না । আর দপ্তরের কাজে বাংলা ব্যবহার করবো । এরপর আর কি করা যায় ডাল ভাত খাওয়া বাঙালির বুদ্ধিতে আঁটে না। বাংলাভাষাকে ভালোবাসা মানে যে ইংরাজিকে হেয় করা নয় , সেটা আমাদের মস্তিস্কে সেঁধোতে ভয় পায়। আমরা মনে রাখি না, আমাদের সাহিত্যসম্রাটের প্রথম উপন্যাস রাজমোহনের স্ত্রী ইংরাজীতে, আমাদের আধুনিক মহাকবির প্রথম কাব্য ক্যাপটিভ লেডি ইংরাজীতে। জীবনানন্দ দাশ , বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ আমাদের আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎগণ ইংরাজী ভাষায় কৃতবিদ্য ।
সম্প্রতি রঘুনাথপুরে একটি সাহিত্যপাঠের অনুষ্ঠানে এক জাপানী সমাজকর্মী এরিকো কাজিতা এসে বাংলা ভাষায় দু চারটি কথা দিয়ে শুরু করে নিজের ভাষার কবিতা পড়লেন। তার সারমর্ম বুঝানোর চেষ্টা করলেন ইংরাজীতে ।
ইংরাজী না থাকলে জাপানী মহিলাটির পক্ষে কবিতা বোঝানো কঠিন হত। আমরাও বুঝতাম কি?