রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

আফ্রিকা: রবীন্দ্র কবিতার নিবিড় পাঠ

তরুণ প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আফ্রিকা” কবিতার আবেদন অপরিসীম। কবিতাটি সঞ্চয়িতায় সংকলিত হয়েছে। লেখার তারিখ উল্লেখ করা আছে ২৬ মাঘ, ১৩৪৩, অর্থাৎ ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কবিতার প্রথমেই আফ্রিকা মহাদেশের ভূতাত্ত্বিক উদ্ভব ও অবস্থান নিয়ে আলোকপাত করেন কবি। তাঁর বৈজ্ঞানিক পড়াশুনার সঙ্গে নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়ক ধ‍্যানধারণার চমৎকার একটা আঁচ পাওয়া যায় আফ্রিকা কবিতা থেকে। পঁচাত্তর বছর বয়সের বিশ্ববন্দিত রবীন্দ্রনাথ এই  কবিতায় পৃথিবীর ভূবৈচিত্র‍্য ও মানবসভ‍্যতার বিকাশের এক রক্তলাঞ্ছিত অতীতকে তুলে ধরেন। এই মহাজগতে সবকিছুই চলন্ত এবং পরিবর্তনশীল। পৃথিবী যেমন ঘণ্টায় এক হাজার কিলোমিটার বেগে নিজেকে পাক খাচ্ছে, আর এক‌ই সাথে ঘণ্টায় এক লক্ষ কিলোমিটার বেগে সূর্যের চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে, সঙ্গে রয়েছে আরো নানারকম দোলানি এবং লাফানি; তার সাথেই যেন সাযুজ্য রক্ষা করে পৃথিবীর জিওইড চেহারার উপরিতলের নিরন্তর বদল ঘটে চলেছে। এভাবেই সুদূর অতীতের জিওসিনক্লাইন মহাসাগরের মধ‍্যে বিপুল প‍্যানজিয়া মহাদেশ ছিঁড়ে খুঁড়ে আজকের মহাদেশগুলি এবং তার‌ই সঙ্গে অন‍্যতম মহাদেশ হিসেবে আফ্রিকার জন্ম।
প্লেট টেকটনিক তত্ত্বের ছাত্ররা জানেন, পৃথিবীর উপরিতলটি তরল ও অর্ধতরল নমনীয় পদার্থের উপর ভাসমান কতকগুলি খাঁজে খাঁজে মেলানো পাতের সমবায়। এই পাতগুলি চলনশীল। একটি পাতের গায়ে আরেকটি পাত ক্রমাগতভাবে ধাক্কা মেরে চলেছে। তেমন ঠেলার শক্তি পাতগুলিকে যোগায় পৃথিবীর অভ‍্যন্তর ভাগের বিপুল উত্তাপ। তাপের কারণে ভূ অভ‍্যন্তরের পদার্থ হালকা হয়ে ওপরের দিকে ওঠে। ওপরতলার তুলনামূলক ঠাণ্ডা অংশ নিচে নামে। এই পরিচলন স্রোতের কারণে পাতগুলি অত‍্যন্ত ধীরে ধীরে হলেও চলে। এই ঠেলার চোটেই উঠছে রকি আন্দিজ ও হিমালয়ের মতো পর্বত, সৃষ্টি হচ্ছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো গভীর সমুদ্রখাত। এই একটি পাতের সঙ্গে আরেকটি পাতের ধাক্কায় ভূমিকম্প হতে পারে। সমুদ্রের নিচে এমন ধাক্কায় সুনামি হতে পারে। আর আগ্নেয়গিরির কাজকর্মের পিছনেও ভূঅভ‍্যন্তরের গলিত তরল বা ম‍্যাগমার ভূমিকা রয়েছে। এই ভূবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আভাসটা কবি দিয়ে রাখলেন অল্প কয়েকটি শব্দের ইঙ্গিতে। আমাদের চেনা সময়ের আফ্রিকার অনেকখানি অংশ নিরক্ষীয় অঞ্চলের মধ্যে।
এখানে পরিচলন বৃষ্টির কারণে চিরহরিৎ বনভূমি আর সেখানে দীর্ঘ সকল মহীরুহ। এই সকল বনভূমিতে বহু জায়গা আছে, যেখানে ভূপৃষ্ঠে কোনোদিন সূর্যের আলো পৌঁছয় না। আর সেই দুর্ভেদ‍্য জঙ্গলে অজস্র রকম কীট পতঙ্গ ও জীবজন্তুর বাস। গরিলা ও শিম্পাঞ্জি জাতীয় প্রাণীরা দুর্ভেদ‍্য জঙ্গলে নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করে। এখানে তৃণভূমি ও মরুভূমির‌ও বিস্তার যথেষ্ট। সাহারা, কালাহারি

 কারু, ডানাকিল, চালবি, নামিব, গুবান, নাইরি, আফ্রিকার মরুভূমির সংখ‍্যা বেশ কয়েকটি। এর মধ‍্যে সাহারা মরুভূমির বিপুল বিস্তার। আফ্রিকার তৃণভূমিগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় সর্বত্র। আইভরি কোস্ট, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো, ক‍্যামেরুন, গায়েনা, গিনি, চাদ, জিম্বাবোয়ে, নাইজিরিয়া, মালি, মোজাম্বিক, সুদান, সেনেগাল, আফ্রিকার প্রায় সব কয়টি দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তৃণভূমি, তা কোথাও সাভানা আর কোথাও ভেল্ড জাতীয়। এখানে রয়েছে জেব্রা, জিরাফ, উটপাখি, বাইসন, হাতি, গণ্ডার আর সিংহ ও হায়েনার মতো প্রাণী। আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি তৃণভূমির জগৎজোড়া পরিচিতি।

আফ্রিকা মহাদেশের উল্লেখযোগ্য বৃহৎ নদীগুলির মধ‍্যে সবচাইতে বেশি পরিচিত হল নীল কাগেরা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কঙ্গো চামবেশি, তৃতীয় স্থানে নাইজার, এরপর জাম্বেজি, উবাঙ্গি উয়েলে, অরেঞ্জ, কাসাই, লিম্পোপো, সেনেগাল, শেবেল, কুবাঙ্গো ওকাভাঙ্গো ইত‍্যাদির স্থান। আফ্রিকা মহাদেশের এই বনভূমি, মরুভূমি, তৃণভূমি আর নদীজলে নানাবিধ প্রাণবৈচিত্র্য। সেখানে প্রকৃতির নিয়মেই তৈরি খাদ‍্যশৃঙ্খল আর খাদ‍্য খাদক সম্পর্ক। আফ্রিকার বন‍্যপ্রাণের মধ‍্যে হিংস্রতা যথেষ্ট। কিন্তু সে হিংস্রতা খাদ‍্য খাদক স্বাভাবিক নিয়মের প্রকাশ। সে হিংস্রতা প্রকৃতির নিয়মের বলেই সীমিত। কিন্তু সভ‍্য মানুষের লোভ সীমাহীন। আফ্রিকা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কলমের সৌকর্যে সেই বিষয়টিতে আমাদের ভাবিত করেন।নৃতাত্ত্বিকদের অনুমান, আফ্রিকার কোনো একটা কোণে গ্রেট এপ প্রজাতির প্রাণীর কোনো শাখা থেকে আদি মানবের মাতার উদ্ভব। মানুষ একদিনে গ্রেট এপ থেকে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স স্তরে পৌঁছয় নি। তার মধ‍্যে রয়েছে হোমিনিড জাতীয় প্রাণীর নানা বিকাশ ও বিবর্তন এবং ছড়িয়ে পড়ার গল্প। হোমো ইরেকটাস, পিথেকানথ্রপাস, নিয়ানডারথাল ম‍্যান, এদের মধ্যে নানা সংঘর্ষের ইতিহাসে আমাদের অতীত ছিল অন্ধকার। মানুষের কাছাকাছি এইসব প্রাণীকে নিশ্চিহ্ন করেই হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স সারা পৃথিবীতে একাধিপত‍্য গড়েছে।
বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে এখন একমত যে পৃথিবীর সমস্ত মানব‌ই এই আদিহোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স‌এর  সন্তান।  কিন্তু এই সব হোমো ইরেকটাস, পিথেকানথ্রপাস, নিয়ানডারথাল ম‍্যানের রক্তে হোমো সেপিয়েন্সের দুই হাত রঞ্জিত। হোমো সেপিয়েন্স সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে নানা সংঘর্ষে নিজের জয়পতাকা ঊর্ধ্বে তুললেও পৃথিবীর নানা কোণে জীবন ধারণের প্রকরণের বৈচিত্র্যে তার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। তবু, মানবসভ‍্যতার আঁতুড়ঘর যে মূলতঃ আফ্রিকায়, তা নিয়ে এখন আর কোনো অস্পষ্টতা নেই। সূর্যের কিরণ ও জলবায়ুর কারণেই হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্সের গাত্রত্বকের বর্ণ নানারকম। চার হাত পায়ে চলা প্রাণীর থেকে বিকশিত হবার সময়েই তুলনায় বড়গোছের মগজ নিয়ে আদি মানবের মাতার উদ্ভব। তার অঙ্গসংস্থানেও জলবায়ু আর বাসভূমির পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে। যেখানে সূর্যের কিরণ তীব্র সেখানে মানুষের গায়ের রঙ হয়েছে কালো বা ঘন। আর যেখানে সৌর আলোর ঘাটতি, সেখানে শরীরের প্রয়োজনে আলোকে পাকড়াও করার কৌশল হিসেবেই মানুষের গায়ের রঙ ফ‍্যাকাশে।
বিজ্ঞানের এই সূক্ষ্ম জিনিসটা বুঝে উঠতে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, তা খুব সহজে অর্জিত হয় নি। অনেকেই হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্সের এক গোষ্ঠীর বহিরঙ্গের দেহবৈশিষ্ট‍্যকে আদর্শ ধরে নিয়ে সেই রকম পুরুষ ও স্ত্রীর মিলনে উচ্চস্তরের মানবের কথা ভেবেছেন। ইউজেনিকস নাম দিয়ে উচ্চতর মানবসম্পদ গড়ে তোলার নেশায় মজেছেন অ্যাডলফ হিটলারের মতো নিষ্ঠুর একনায়ক। অনেক বিজ্ঞানীও সেই উদ্ভট নেশায় সামিল হয়েছিলেন। এক অংশের মানুষ আরেক অংশের মানুষকে দেখে অপর ভেবেছে। হীন ভেবেছে। এমনকি, মনুষ‍্যেতর প্রাণীর সামিল করে ভেবেছে। আজও মানুষের সমাজ‌ এই ভ্রান্তি ও বিকৃতি থেকে মুক্ত নয়। এই সূত্রে আমরা হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্সের জিন মানচিত্র নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এ ব‍্যাপারে পথিকৃৎ বলতে হবে গ্রেগর জোহান মেন্ডেলকে। অনেক পরে ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেমস ডি ওয়াটসন মানুষের জিন ব‍্যাপারে গভীর আলোকপাত করেন। ১৯৯০ থেকে শুরু হয়ে ২০০৩ সালের ১৪ এপ্রিল মোটামুটি ভাবে সমাধা হয়েছিল হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট। নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস কলিনস। এ ব‍্যাপারে আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব‍্যক্তিত্ব হলেন জে ক্রেইগ ভেন্টার। অতি সম্প্রতি চলতি ২০২১সালের মে মাসে হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট বেরিয়েছে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্সের জিন মানচিত্র, আর ডিএনএর ডবল হেলিক‍্যাল প‍্যাঁচে প্রোটিন অণুর শৃঙ্খল সংস্থান বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। বিভিন্ন জিনের আলাদা আলাদা মিউটেশনের কারণে কোথাও মানুষের ঠোঁট মোটা, চোয়াল উঁচু, কপাল চ‌ওড়া। আবার কোথাও মানুষ খর্বনাসা, এবং চোখ ছোট। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিচারে পৃথিবীর সবকোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষেরা সমস্তটাই এক অভিন্ন মানব প্রজাতি, তা নিয়ে আজ আর সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন দেশে দেশে অত‍্যাচারীরা অনেক নৃগোষ্ঠীকে তাদের দেহবৈশিষ্ট‍্যের ভিন্নতাকে অপর ভেবে, হীন আখ‍্যা দিয়ে নির্যাতন করেছে; উচ্ছেদ করেছে; এমনকি নির্বিচারে গণহত‍্যা করেছে। দেহবৈশিষ্ট‍্যের ভিন্নতার কারণে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর লোকজনকে মেরে শেষ করে দিয়েছে। একে বলতে হবে এথনিক ক্লিনজিং।
 ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন। প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন একনায়ক। ভার্সাই চুক্তিতে আহত জার্মান জাতি অহমিকাকে পুঁজি করে, আর ইহুদি জাতিঘৃণাকে মূল স্ট্র‍্যাটেজি করে গোটা জার্মান রাষ্ট্রকে হিটলার মুঠোবন্দী করে ফেলেছিলেন। তিনি ইহুদিদের কীটপতঙ্গের সামিল বলে মনে করতেন। তাদের বলতেন গেগেনরেস। মশা মাছি বা জোঁক তাড়াতে মানুষ যেমন এক মুহূর্ত‌ও চিন্তা করে না, ঠিক সেইভাবে হিটলার ইহুদি বুদ্ধিজীবী, ইহুদি অধ‍্যাপক বিজ্ঞানী, ইহুদি আইনজীবী এবং ইহুদি ব‍্যবসায়ীদের দেশছাড়া করেছেন। সাধারণ ইহুদি নাগরিকদের ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্পে। সেখানে তাদের উপর উদ্ভট সব পরীক্ষা করিয়েছেন। জ‍্যান্ত অবস্থায় ছাল ছাড়িয়ে দেখেছেন কেমন লাগে। গ‍্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে বিষাক্ত গ‍্যাস দিয়ে মেরেছেন। সে রকম গ‍্যাস চেম্বারে ঢোকানোর আগে পোশাক খুলে হাঁটতে বাধ‍্য করেছেন। মানুষের চর্বি দিয়ে বানানো হয়েছে সাবান। সোনায় বাঁধানো দাঁত থাকলে সোনাটুকুর জন‍্যে তা উপড়ে নিয়েছেন। কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্প মানবসভ‍্যতার এক বিরাট ক্ষতচিহ্ন।
আরো আগেই আমরা লক্ষ করেছি, গোটা ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের উপর একটা কুটিল ঈর্ষা। ইহুদিদের বুদ্ধিবৃত্তি এবং ব‍্যবসায়িক পরিশ্রমকে ক্রূর চোখে দেখার চেষ্টা। শেকসপিয়র এর মার্চেন্ট অফ ভেনিস পড়লে ইউরোপীয় সমাজে অন্তর্লীন ইহুদি বিদ্বেষকে টের পাওয়া যায়। শাইলক চরিত্রটি নানাবিধ বৈষম্যপূর্ণ ব‍্যবহারের শিকার। আধুনিক সমালোচকের মত হল, শাইলক চরিত্র তৈরি করে তার প্রতি সংখ‍্যাগরিষ্ঠের ঘৃণাপূর্ণ আচরণ দেখিয়ে ইউরোপের মানসিক গঠনে ইহুদি বিদ্বেষের চেহারাটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মহান সাহিত‍্যিক।
ইউরোপ থেকে অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস সান্টা মেরিয়া, পিন্টা ও নিনা, এই তিনটি জাহাজে পাল তুলে গিয়ে পৌঁছেছিলেন এক নূতন পৃথিবীতে। অতলান্ত সাগরে ভেসে কলম্বাস ইণ্ডিয়া খুঁজতে বেরিয়ে ১৪৯২ তে যেখানে পৌঁছলেন, আমেরিগো ভেসপুচি জানালেন সে আসলে আমেরিকা।   ইউরোপীয় জাতিগুলি ইংরেজ ফরাসি, স্পেনীয়, সবাই সারা পৃথিবী জুড়ে নিজের নিজের উপনিবেশ গড়ে নিয়েছিল। কলম্বাসের সম সময়েই আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ১৪৯৮ সালে ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন ভাস্কো ডা গামা। ইউরোপীয় জাতিগুলি সারা পৃথিবীকে নিজেদের মেজাজ মর্জিমতো ভাগ করে নিয়েছিল। আর শুরু করেছিল নতুন এক ধরনের লুণ্ঠনের ইতিহাস। উপনিবেশ থেকে কাঁচা মাল আর শস্তা শ্রম বন্দুকের জোরে ছিনিয়ে এনে ইউরোপে গড়ে উঠছিল পুঁজিবাদ। আমেরিকার বিরাট বিরাট প্রান্তরে বনভূমি ধ্বংস করে স্থাপিত হয়েছু গম, ভুট্টা ও কার্পাস তূলার ক্ষেত। সেখানে কাজ করবে বলে আটলান্টিকের অপর পাড় আফ্রিকা থেকে ধরে আনা হত মানুষ। যাদেরকে চেনানো হত ক্রীতদাস বলে। ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত মানুষেরাই আমেরিকায় মালিক সেজে বসেছিল, আর তাদের দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায় ক্রীতদাস ক্রীতদাসীর রক্তে অশ্রুতে মিশে পঙ্কিল হয়ে উঠল ধূলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “সভ‍্যের বর্বর লোভ / নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।”

এই সূত্রে আমরা হ‍্যারিয়েট বিচার স্টো কে মনে করতে পারি। ১৮৫২ সালে দুইখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আঙ্কল টমস কেবিন। ক্রীতদাসরাও যে আসলে মানুষ, এই কথাটা খুব চমৎকার ভাবে ফুটে উঠল তাঁর কলমে। ১৮৫২ সালে মার্চ মাসের কুড়ি তারিখে বেরোনোর আগে দি ন‍্যাশনাল এরা কাগজে ১৮৫১ সালের ৫ জুন থেকে ১৮৫২ সালের ১এপ্রিল অবধি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। হ‍্যারিয়েট বিচার স্টো (১৪ জুন, ১৮১১ – ১জুলাই, ১৮৯৬) ছিলেন এক শিশু সন্তান হারানো মা। আঠারো মাস বয়সে সন্তানের মৃত্যু তাঁকে জীবনের প্রতি পরম সংবেদনশীল করে গড়ে তোলে। ১৮৩২ সালে সদ‍্যেতরুণী মেয়েটি ক্রীতদাস দের উপর নিগ্রহের ঘটনাগুলি জানতে পারেন। সহানুভূতি থেকে তিনি তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে থাকেন। কুড়ি বৎসর ব‍্যবধানের পর বেরোলো আঙ্কল টমস কেবিন। তখন হ‍্যারিয়েট চল্লিশোর্ধ্বা। তাঁর কলম এই ক্রীতদাসত্বের অবসানের দাবিতে লড়াইয়ে শক্তি জুগিয়েছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ আব্রাহাম লিঙ্কনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল হ‍্যারিয়েট এর। তাঁকে দেখে লিঙ্কন না কি অবাক হয়ে বলেছিলেন, তুমিই সে? স্টো-র কলমে ক্রীতদাস জীবনের প্রতি এতখানি সমবেদনা আমেরিকার মুক্তি সংগ্রামীদের সকলের পছন্দসই হয় নি।

মুক্তির সংগ্রাম বড়‌ই জটিল এবং বিচিত্র। ক্রমেই সে অন‍্য কারো বন্দিত্বকে মূলধন করে ফেলে। ইংরেজ চলে গেলে সংখ‍্যাগরিষ্ঠের আক্রমণের মুখে পড়ে সংখ্যালঘুরা, দলিতেরা, বনবাসী জনজাতির মানুষেরা। এ আমরা ভারতের ইতিহাসে দেখেছি। স্বাধীনতার মানে সকলের কাছে সমান হয় না। ঈশ্বরের মন্দির গড়বার নাম করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করা হয়। দাঙ্গা হাঙ্গামার স্ক্রিপ্ট লেখা হয়। স্বাধীন দেশেও নারীদের উপর অত‍্যাচার থামতে চায় না। এ কথাটাই রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরলেন। নারীকে দুর্বল আখ‍্যা দিয়ে তার উপর আক্রমণ করা। গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে আসছে। একের পর এক চিত্রকল্পে তথাকথিত সভ‍্যতার আলখাল্লা ও নামাবলী ধরে টানাটানি জুড়ে দিয়েছেন কবি। মহিলা কমিশন এবং আইনের নানা বিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন ঘটে চলেছে। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছিলেন, শোষিতদের মধ‍্যে নারীরা চূড়ান্ত ভাবে শোষিত। সর্বহারাদের মধ‍্যে নারীরা আরো বীভৎস রকম সর্বহারা। আফ্রিকা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বলেন, “দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে”, তখন যেন এঙ্গেলস এর কথাটিই কানে রিনরিন করে বাজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ওই মানহারা মানবীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করার মধ্যেই সভ‍্যতার পরিচয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।