|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 বিশেষ সংখ্যায় মৃদুল শ্রীমানী

ব‍্যোম কালি , বোম কালি

সেকালে কালিপূজা এলে বাজি পোড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হত। আমাদের বাড়িতে মিতব‍্যয়িতার চর্চা ছিল বলে অল্পস্বল্প বাজি পুড়িয়ে দীপাবলির উদযাপন করতে হত। কিন্তু পল্লীতে নিতান্ত সাধারণ পরিবারেও কালিপূজার রাতে বাজি ফাটানো ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আমাদের বাড়িতে প্রতিটি শিশুর জন্য দুটি করে রঙমশাল, একটি কি দুটি দড়ি বাজি, এক প‍্যাকেট ফুলঝুরি আর একটি কি দুটি চরকি বাজি আসত। বাবা জানতেন দীপাবলি আলোর উৎসব। তাই রঙিন আলো তৈরি করে এমন বাজি নিয়ে আসতেন। কিন্তু পল্লীর বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতেন কালিপূজার রাতে বিকট শব্দবাজি পোড়াতে হয়। সারারাত ধরে শব্দবাজি ফুটত। জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম আকাশের অন্ধকার চিরে আলোর ফুলকি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে উড়ন তুবড়ি। পাড়ায় পাড়ায় সাড়া পড়ে যেত বসানো তুবড়ি প্রতিযোগিতা নিয়ে। কার তুবড়ি কত উঁচুতে আগুনের ফোয়ারা তুলল, সেই ছিল সার্থকতার পরিমাপ। স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলার দিন থেকেই বাঙালি বোমা বাঁধতে জানত। বাঙালি অন্ধকারে অচেনা লোকজনের গায়ে বোমা ছুঁড়তে মনের ভিতরে বাধা পেত না। মানিকতলা বোমা মামলার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পার্লামেন্টের ভিতরে ভগৎ সিংহের বোমা ফাটানোর কথা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত। তাঁদের ছোঁড়া বোমার বিশেষত্ব ছিল, তাতে শুধু শব্দ তৈরি হয়েছিল। একজনও আহত হননি। ভগৎ সিংহ বলেছিলেন বধিরকে শোনানোর জন্য উচ্চ শব্দের প্রয়োজন। বোমা নিক্ষেপ করে তাঁরা লিফলেট বিতরণ করেন। ধরা পড়লে যুবক বিপ্লবীদের প্রাণদণ্ড হয়েছিল। ভগৎ সিংহের বোমাটি বানিয়ে দিয়েছিলেন এক বাঙালি। তাতে কোনো স্প্লিন্টার ছিল না। সাধারণতঃ মারণ বোমায় লোহার টুকরো দেওয়া থাকে। বিস্ফোরণের ঝোঁকে লোহার টুকরোগুলো বিদ্যুৎ বেগে আঘাত করে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। বোমা নিয়ে গবেষণায় বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল। একদল বিপ্লবী নির্জনে বাগানে বোমা বাঁধতেন। নেতারা সেই বোমার কোয়ালিটি যাচাই করে ছাড়পত্র দিলে আরেক দল বিপ্লবী সেই বোমা রেখে ঢেকে নানা শেল্টারে পৌঁছে দিতেন। বোমা নিক্ষেপ করার কাজটা তাদের দিয়ে করানো হত, যাদের বুদ্ধি বিশেষ পাকে নি, আর যারা ধরা পড়লে সংগঠনের বড়মাপের ক্ষতি হবে না। নেতারা কোনো কারণে ধরা যাতে না পড়েন, সে ব‍্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হত। তবুও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে বহু তথ‍্য ব্রিটিশ সরকার পেয়ে যেত। বাংলার অগ্নি যুগে এই ছিল শক্তি সাধনা। কালিপূজাকে বলা হত শক্তিপূজা। শক্তির মূল পরাকাষ্ঠা ছিল বোমা ও বন্দুক।

শাক্তসাধনার এই বাঙালি ঐতিহ্য স্বাধীনতা উত্তর কালেও প্রবাহিত ছিল। ছোট বড় রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সকলেই প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে বোমা ও বন্দুকের উপর নির্ভর করতেন। দলীয় নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণায় বোমা বানানোর কাজ হত বাংলাভূমির ঘরে ঘরে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে এলাকা দখলের ট‍্যাকটিকস হিসেবে বোমাবাজি হত। মুড়ি মুড়কির মতো করে যাতে বোমা ছোঁড়া যায়, তার সাপ্লাই লাইন অব‍্যাহত রাখতে হত। বোমাবাজি করে সাধারণ ভোটারদের হৃৎকম্প উপস্থিত করে বুথের দখল নিত রাজনৈতিক দলের ক‍্যাডার বাহিনী। জালভোট ছাপ্পাভোটে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে বোমার এমত ভূমিকা ছিল।

স্বাধীনতা আন্দোলন চলার দিনগুলি থেকেই বাংলার ছাত্র সমাজ বামাচারী ছিল। নজরুল ইসলামের ভাষায় “তাজা খুনে লাল করেছি সরস্বতীর শ্বেতকমল” কথাটি আক্ষরিক অর্থে বাঙালি ছাত্র আত্তীকরণ করেছিল। নীলকণ্ঠ বামদেব শিবের প্রলয়নাচন ও শিবা শকুনিসজ্জিতা বামাকালীর রক্তপায়ী নৃমুণ্ডমালিনী মূর্তির প্রতি আন্তরিক আনুগত্যে বাঙালি ছাত্র আবেগে থরথর করে আবৃত্তি করত সেই মহাবরষার রাঙাজল…
সহিংসতার পথে রেলের লাইন উড়িয়ে, ফিশপ্লেট খুলে, ডাকঘর লুঠ করে ও থানায় আগুন লাগিয়ে বাঙালি তার তারুণ্যের পরিচয় দিত। তীব্র রোমান্টিক প‍্যাশনে ম‍্যাৎসিনি গ‍্যারিবাল্ডি রোবসপীয়রের ইমেজের সাথে বাংলার যৌবন আন্তরিক আত্মীয়তা অনুভব করত। দাঙ্গা হাঙ্গামার এই পরিবেশেই স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে ঘটে গেল গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং। দেশভাগের আবহে উদ্বাস্তু শিবিরে কত যে তরুণী যুবতী ধর্ষিত হয়েছিল, তার কোনো হিসেব নেই। স্বাধীনোত্তর বাংলায় পরীক্ষায় টুকলি করার অধিকার মান‍্যতা পেয়েছিল। বিশেষতঃ আইনের ছাত্রেরা এই অধিকার অর্জনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ‘পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে’ রব তুলে শিক্ষায়তনের বেঞ্চি টেবিল ভাঙচুর করা ছিল তারুণ্যের স্বাভাবিক প্রকাশ। পরীক্ষার হলে যাতে ইনভিজিলেটরের পিলে চমকে দেওয়া যায়, তার জন্য ডেস্কটপে ধারালো ছোরা গেঁথে রাখা হত। এই প্রক্রিয়ায় সসম্মানে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন অনেক বিশিষ্ট অগ্নিসম্ভব ছাত্রনেতা। তাঁদের আইন ব‍্যবসা করতে হত না। তাঁরা আইনসভার মাননীয় সদস্য হয়ে আইন প্রণয়নের কাজে আত্মোৎসর্গ করতেন।

স্বাধীনতাপূর্ব যুগে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী শক্তির প্রতিভূ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেকালে কংগ্রেসে সভাপতি মহাশয়কে “রাষ্ট্রপতি” বলার চল ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের এহেন রাষ্ট্রপতির কাজ করে দেখানোর পরিসর ছিল না। তাই তিনি গোপনে দেশত্যাগ করেন। জাপানে তিনি যখন ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র শাণাচ্ছেন, তখন জওহরলাল বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র দেশে ফিরলে তরোয়াল দিয়ে অভ‍্যর্থনা করা হবে। অভ‍্যর্থনার রকমটি শ্লেষপূর্ণ। জওহরলালের সাথে সমস্বরে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, সুভাষচন্দ্র দেশে ফিরলে বুলেট দিয়ে অভ‍্যর্থনা করা হবে। এক পা এগিয়ে তাঁরা সুভাষচন্দ্রকে “তোজোর কুকুর” বলতেও দ্বিধা করেননি।

১৯৪৫ সালের আগস্টে আমেরিকার পরমাণু বোমা হামলার ফলে জাপানের শোচনীয় পরাজয় ঘটলে আজাদ হিন্দ বাহিনী ইংরেজের কাছে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আত্মসমর্পণ করে। সুভাষচন্দ্রের কোনোভাবেই কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না বোঝা যেতে, তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে গেল। যে সুভাষচন্দ্র নির্বান্ধব অবস্থায় মূক ও বধির মৌলবী জিয়াউদ্দিন সেজে আত্মগোপন করে একাকী দেশত্যাগ করেছিলেন, তাঁকে হঠাৎ করেই দেবতা বানিয়ে নেওয়া হল। সুভাষচন্দ্র হয়ে গেলেন বাংলার নয়নমণি। তাঁকে দেবতার আসনে বসিয়ে পূজা শুরু করল ছাত্রদল। সুভাষচন্দ্রের সসম্মানে আই সি এস পাশ করা, বিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় গৃহত্যাগ করে সাধুসঙ্গ করা, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অগাধ পড়াশুনাকে পিছনে ফেলে প্রেসিডেন্সীর ছাত্র হিসেবে শিক্ষক নিগ্রহের গল্পটি সামনে চলে এল। ওটেন সাহেবকে ভিলেন বানিয়ে সুভাষচন্দ্রের নামে বীরপূজা শুরু হল। বীরপূজার অন‍্যতম উপচার হয়ে দাঁড়াল শিক্ষক নিগ্রহ। বাম দক্ষিণ নির্বিশেষে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটাতে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গেল বাংলায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যের উপর নিগ্রহের ঘটনা ঘটানোর পিছনে বাম সরকারের উৎসাহ প্রদান লুকিয়ে রাখা গেল না। মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সাধনা সরকারের উপর নিগ্রহও ভোলা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইভাবে শাক্তরীতির সাধনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।

বিরোধিতার পন্থা হিসেবে মূর্তি ভাঙার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা হল কলেজ স্কোয়ারে। বিরোধী নেতার গাড়ির বনেটের উপর মা কালি নাচ শুরু করে দিলেন। নিজের দলের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ নেতার ধুতি টেনে খুলে দিতে দেখল বাংলার জনগণ। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মাতোয়ারা। ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে রক্তাক্ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও বোমাবাজি ছিল প্রধান আকর্ষণ।

কালি করালবদনা মুখব‍্যাদান করে লোলজিহ্বা সঞ্চালন করছেন। শব্দবাজি তাঁর পূজার অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপচার। বোমা পটকা ঘরে ঘরে আদৃত। সোরা, পটাশ, কাঠ কয়লা একত্রিত করে পাটের তন্তু জড়িয়ে পেটো তৈরি দলনির্বিশেষে আদৃত হস্তশিল্প। পরিবেশবিদরা বারে বারে শব্দবাজির ভয়াবহতা নিয়ে পাণ্ডিত্য প্রকাশ করলেও আইনের আসল রক্ষকের আদরের আশ্রয়ে শব্দবাজি তৈরি হয়ে চলেছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বহু চেষ্টা করেও শব্দবাজির প্রতি বাংলার প্রগতিশীল মানুষের আগ্রহে ভাঁটা আনতে পারেন নি। বাংলার মানুষ বলেছে ব‍্যোম কালি। বোমার সাথে কালিপূজার চিরন্তন সম্পর্কটি ওই ‘ব‍্যোম কালি’ শব্দে নিহিত। সেক‍্যুলার বাংলায় থানায় থানায় থানাকর্মীদের অংশগ্রহণে কালিপূজার ঐতিহ‍্য প্রতিষ্ঠিত হল বলে। মা রক্তপিপাসু। বোমা বানাতে গিয়ে কত তরুণ যুবক প্রাণ উৎসর্গ করবেন। পেটের দায়ে অবৈধ বাজি কারখানায় নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে বাজি বানাতে গিয়ে হাত পা খোয়াবে বাংলার শিশু। বাজির আগুনে দগ্ধ ও হতাহতের কান্নায় মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগ সরগরম হয়ে উঠবে।
নৃত‍্যকালী রঙ্গে মেতে উঠে কলহাস‍্যে বলবেন আমি সৎ এরও মা, অসৎ এরও মা। আমি চিন্ময়ী, সদসৎ এর অতীত। সর্বগুণাতীতা পরব্রহ্মময়ী সচ্চিদানন্দরূপা। এইভাবে আমি গুণ্ডা কন্ট্রোল করি। ব‍্যোম কালি!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।