ক্যাফে গল্পে মৃত্যুঞ্জয় রায়

বোধ

বড় ক্লান্ত লাগছে, একটু একটু করে সম্পর্কের বাঁধন খুলে যাচ্ছে | আলগা হচ্ছে ধৈর্য্য | দূরে সরে যাচ্ছে অভিমানী মেঘ | একবুক জমা জল | কেউ সাঁতরে পেরোতে এল না আর | থানা পুলিশ,খবর কাগজের অফিস ঘুরে ঘুরে ভঙ্গুর হৃদয়ের ঈশান কোণ| এক টোকাতেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে সব | নিজেকে এতটা অসহায় কখনও লাগেনি ঈশানের, সারাটা দিন রাত মনের মধ্যে একটা খচখচ চলছেই | এতগুলো বছর যে সম্পর্ক মনের মধ্যে অনেকটাই জায়গা দখল করেছিল আজ কিভাবে তাঁকে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলা যায়! হয়ত উপড়ে ফেললেই ঝড় থামবে কিন্তু কিভাবে? অফিসের কাজে মন বসছে না, বাড়িতে ফিরেও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছে না, পাড়ার ক্লাবে যেতে ইচ্ছে করছে না যেন কেউ বুকের ভেতর হিরোশিমা নাগাসাকির দুটো বিস্ফোরণ একসঙ্গে ঘটিয়ে ফেলেছে |

ঈশান চ্যাটার্জী চাকরির সূত্রে কলকাতা ছেড়ে আসানসোলে চলে গেছিল বছর দুয়েক আগে, আবার কলকাতায় ফিরে এল অন্য কম্পানিতে চাকরি নিয়ে, বেশ কিছুটা স্যালারি কম্প্রোমাইজ করেই জয়েন করল| সন্তানের মনের মধ্যে কোনো অস্থিরতা চললে সবার আগে মা বুঝতে পারেন, ঈশানের মা রমা দেবী অনেকবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন,ঈশান বারবার কায়দা করে এড়িয়ে গেছে | কি বলবে? আর বললেই কি মা বুঝবে? এমন একটা অগোছালো সময়ের কি আর ব্যাখ্যা হয়! ওদিকে যে বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে, বিয়ের কার্ড বিলি হয়েই এসেছে প্ৰায় | এইসময় দাঁড়িয়ে কোন সিদ্ধান্ত সঠিক কোনটা ভুল সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে |

ঈশানের বিয়ে ঠিক হয় ঈশিতা মুখার্জীর সঙ্গে | সম্বন্ধটা আসে মামার বাড়ির দিকের এক পরিচিতর মাধ্যমে | মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের মেয়ে ঈশিতা | ঈশিতার সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে কথা হয়েছে ওকে একদম অন্যরকম মনে হয়েছে, ঈশানের কাছে ঈশিতা অনেকটা শান্ত নদীর মতন | কিন্তু তার কাছে সব কিছু লুকিয়ে রেখে তার সঙ্গে জীবনের নতুন অধ্যায় মানে সেই অধ্যায়ে কেবলই অন্ধকার | কিন্তু কি মুখ নিয়ে তাকে সব বলবে! প্রতিরাতে চিন্তায় ঘুম আসছে না | কখনও কখনও মনে জোর এনে ভেবেছে ঈশিতা কে গিয়ে বলবে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব নয়, কিন্তু হয়ে উঠছে না, মন সায় দিচ্ছে না, যতই দেখাশোনা করেই বিয়ে হোক মনে মনে কোথাও ঈশিতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে ঈশান | বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পর থেকে এত এত কথা হয়েছে যে একে অন্যের ইচ্ছে অনিচ্ছে, ভালো লাগা মন্দ লাগা, প্রিয় অপ্রিয় সব মুহূর্তেই যেন একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, হয়ত ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু এইমুহূর্তে সেই ভালোবাসার সমীকরণ যেন জলশূন্য |

ঈশানের বাবা সমীরণ চ্যাটার্জী মারা গেছেন বছর পাঁচেক হল | বাবার মৃত্যুর পর এমনই একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে, সেই সময় থেকে এখন অনেকটাই বেরিয়ে এসেছিলো ঈশান, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যেন সেই অস্থিরতা আবার দপ করে জ্বলে উঠতে চাইছে | সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর বুকে একটা আনচান হতে শুরু হয় সমীরনের, সেই সময় ক্লাবের ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে ব্যাস্ত ঈশান | রমা দেবী দু’বার ফোন করেছিলেন ছেলেকে কিন্তু ঈশান ভেবেছিলো হয়ত গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে ঠিক হয়ে যাবে, ব্যাস সন্ধে হতে হতেই সব শেষ | সেই দিনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য আজও অনুশোচনা হয় | অপরাধবোধ গিলে খায় | মন কেমন করে | রমা ছেলের অস্থিরতা বোঝে তাই সেই নিয়ে আর কোনোদিন কথা এগোয়নি, ছেলের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়নি, বরং ছেলের পাশেই থেকেছে, ছেলেকে মন থেকে শক্ত হওয়ার সাহস জুগিয়েছে |

ঈশান কে একার হাতেই সব সামলে নিতে হচ্ছে | বাড়ি ভাড়া থেকে ক্যাটারিং কোনো কিছুতেই ত্রুটি রাখছে না | রমার প্রথম দেখাতেই ঈশিতাকে পছন্দ হয়ে যায়, তারপর ঈশান কে এতবার করে ঈশিতার কথা বলেছে যে ঈশান মায়ের পছন্দতেই সায় দিয়ে ফেলে | তারপর কথাবার্তা এগোয়, ঈশান ঈশিতার দেখা হয়, আলাপ হয়, জল গড়ায় সম্পর্কের | যখন প্ৰায় সবকিছুই গুছিয়ে উঠেছে ঠিক সেদিন বিয়ের কার্ড নিয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে ফেরার সময় হঠাৎ নন্দিনীর সঙ্গে দেখা | দুজন মুখোমুখি | একরাশ নিস্তব্ধতা | জীবনের মোড় ঘুরে যায় এক ঝটকায় |

নন্দিনী কলেজ স্ট্রিটে এক পাবলিশার্সে চাকরি করে, টাইপিং এন্ড প্রুফ দেখার কাজ | নন্দিনীও বুঝে উঠতে পারেনি সেও জীবনের এমন একটা অধ্যায়ে এসে আবার দাঁড়াবে | ঈশানের হাতে বিয়ের কার্ড দেখে খুব একটা অবাক হয়নি নন্দিনী, এটাই তো স্বাভাবিক | কিন্তু ঈশান তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, ঈশানের নিঃশ্বাস পড়ছে তাঁর গায়ে, শরীর মন যে অসাড় হয়ে আসবেই | ঈশানও স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে | কিছুক্ষণ পর দুজনেই দুজন কে সামলে নেয় | কফি হাউসে গিয়ে বসে | কি বলবে কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না দুজন | প্ৰায় বছর দুয়েক ওরা একে অন্যের থেকে পালিয়ে বেরিয়েছে |

নন্দিনীর সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্ব কলেজ জীবন থেকেই, একে অন্যকে জীবনের অনেকটাই সময় দিয়েছে | তারপর সময় যখন একে অন্যের দায়িত্ব নেওয়ার মুখে এসে দাঁড়ায় তখন ঈশান বড় উদাসীন হয়ে পড়েছিল| ঈশান তখনও তেমন চাকরি জোটাতে পারেনি, তবে চেষ্টা করে চলেছে, অন্যদিকে নন্দিনীর বিয়ের প্রস্তাব আনে তার ছোট পিসি, ছেলে আমেরিকায় থাকে ভালো চাকরি করে,ভালো আয়, এমন পাত্রকে কোন পরিবার ছেড়ে দিতে চায়! নন্দিনী বাড়ির অমতে বেরিয়ে আসতে চাইলেও ঈশান সাহস দেখায়নি বরং নন্দিনীর কাছ থেকে পালিয়ে গেছিল | নন্দিনী একপ্রকার অসহায় হয়েই বিয়েতে পরিবারের সঙ্গে সহমত হয়ে যায় | নন্দিনীর বিয়ে হলো সূত্রায়ণ বসুর সঙ্গে, NRI পাত্র, যেমন সুন্দর দেখতে তেমন স্মার্ট, কিন্তু এই সুন্দর পুরুষ সমুদ্র হয়ে পথ ভোলা নদী কে কাছে টেনে নিলো না, বিয়ের পরেও নন্দিনী একা একা বইলো আপন খেয়ালে| বিয়ের পর পরই সূত্রায়ণ আমেরিকায় চলে যায় | বছরে দু একবার বাড়িতে এলেও নন্দিনীকে সঙ্গে করে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায় না | নন্দিনী বুদ্ধিমতী মেয়ে, যত দিন গড়ায় সে বুঝতে পারে সূত্রায়ণ আসলে বিয়ে করে বাড়িতে বাবা মা কে দেখাশোনার জন্য বিনে পয়সায় লোক নিয়ে এসেছে | সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ে, নিঃসঙ্গতা বাড়ে, নন্দিনীর একাকিত্বে লক্ষণরেখা পেরিয়ে নন্দিনীর জীবনে আবার ফিরে এসেছিল ঈশান |

নন্দিনী আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি ঈশানের পরিণত ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পন করে | ওদের সম্পর্কের রসায়ন আরও গাঢ় হয়ে ওঠে | একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে, ওলোট পালট করে আদর করে, দুজন দুজনের কাছে ভাঙতে ভাঙতে সমতল হয়ে যায় | নন্দিনী যখন বুঝতে পারে যে সে কনসিভ করেছে ঠিক সেই সময় থেকে সে ঠিক করে সূত্রায়ণের সঙ্গে সাজানো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবে, আত্মসমর্পন করবে ঈশানের কাছে, কিন্তু ভবিতব্য যে ছিল অন্যরকম | ঈশান হঠাৎ করেই এড়িয়ে চলতে শুরু করে, এমনকি সে চায়নি তাদের সন্তান জন্ম নিক | ঈশান বাচ্চা চায়না এমন নয় কিন্তু এই মুহূর্তে নয়, সে সবসময় একটু ভালোভাবে থাকতে চায়, তার এই ছন্নছাড়া জীবনে আরও একজনের দায়িত্ব নেওয়া যে খুব কঠিন | ঈশান ইনিয়ে বিনিয়ে নন্দিনীকে বোঝাতে চেয়েছিল এই মুহূর্ত থেকে বেরিয়ে তারা ভবিষ্যতে ভালো করে বাঁচবে | যদিও ঈশান তখন একটা ছোট ফার্মে চাকরি করছে | সামান্য মাইনে | সেই মাইনে দিয়ে ঘর বাঁধলেও সংসার চলে না | সে নন্দিনীকে বোঝাতে চায় সে আরও ভালো চাকরির চেষ্টা করবে কিন্তু নন্দিনী বুঝতে চায়না, সে যে অল্পতেই গুছিয়ে নিতে চায়, কিন্তু বারবার হেরে যেতে হয় ঈশানের জেদের কাছে | একটা সময়ের পর মনের মধ্যে জমানো অভিমান নিয়ে ঈশানের থেকে সরে আসতে চায় নন্দিনী| সেই মুহূর্তে নন্দিনীর কাছে ঈশান একটা ভীতু দায়িত্বহীন পুরুষ ছাড়া কিছুই নয় | দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে | নন্দিনী ঈশানের সঙ্গে যোগাযোগ আর রাখতে চায়নি |

এতদিন পর দেখা কথা শুরু হল ভাঙাচোরা শব্দে | নন্দিনীর ডিভোর্স হয়েছে, তার একটা মেয়ে আছে ঈশানি| সে একা একাই কারোর আশ্রিতা না হয়ে দারুণ ভাবে সব সামলে নিয়েছিল,কিন্তু বিধাতা যে তার জীবনে আরও বড় লড়াই লিখে রেখেছিলেন| ঈশানির ব্লাড ক্যান্সার | ডাক্তার বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তবু মনের মধ্যে ভয় আতঙ্ক জমিয়ে বসে আছে | এখানেই থামে নন্দিনী | ঈশানের বুকের ভেতর বিস্ফোরণ হয় | নন্দিনী বারবার বুঝিয়েছে ঈশানি কেবল তার মেয়ে | ঈশানের অসহায়তা চোখে মুখে ফুটে ওঠে | মুখ সাদা হয়ে যায় |

আসানসোলে ফিরে গেলেও চাকরিতে কিছুতে মন বসছে না ঈশানের| অস্থিরতা বাড়ছে | মনকে স্থির করে ঠিক করে আর নয় সে এবার নন্দিনীর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে | নন্দিনীর কাছে অসহায় হয়েই ধরা দেয় | নন্দিনীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে | কথা হয় নিয়মিত | ঈশানের দিন শুরু হয় মেয়ের ছবি দেখে আবার রাতে ঘুমোনোর আগে মেয়ের ভিডিও না দেখলে ঘুম হয় না | মেয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে ঈশান | এদিকে ঈশিতার সঙ্গে কথা হয় ঠিকই কিন্তু কোথাও যেন সেই সম্পর্কে টান কমছে | নন্দিনী এই মুহূর্তে ঈশানের কাছে নতুন জন্ম তার যত দায়িত্বজ্ঞাহীনতা ছিল সেই চক্রব্যূহ থেকে মুক্তির পথ | কোনো কিছু না ভেবেই কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ঈশান | নন্দিনী কে বলে সে কলকাতায় ফিরে এসে নতুন করে জীবন শুরু করবে, ঈশিতাকে সব সত্যি বলবে, হয়ত সবকিছু ওলোট পালট হয়ে যাবে তবুও বলবে | কলকাতায় ফিরে আসে ঈশান| মেয়ের জন্য প্রচুর খেলনা কেনে, নন্দিনীর জন্য শাড়ি কেনে | ট্রেনে জানলার ধারে বসে থাকতে থাকতে শুধু মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করার ভাবনাই ভেবেছে | মনে মনে হেসেছে | নিজেকে বেশ পরিণত মনে হয়েছে |

কলকাতায় ফিরেই নন্দিনী কে অনেকবার ফোন করেছে ঈশান, নন্দিনীর ফোন সুইচ অফ, পাবলিশার্সের অফিসে গিয়ে জানতে পারে নন্দিনী চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, নন্দিনীর ভাড়া বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে দেখে সেখানেও নেই, এক অদ্ভূতভাবেই নন্দিনী নিখোঁজ হয়ে যায় | কোথাও কোনো যোগাযোগের সূত্র রেখে যায়নি নন্দিনী | হয়ত রাখতেই চায়নি, এক ভাসমান ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছে ঈশান কে | ঈশানের বুকের মধ্যে তছনছ করে দিতে চেয়েছে ইচ্ছে করেই, হয়ত প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে অথবা চেয়েছে ঈশান যেন ঈশিতার প্রতি দায়িত্ব না এড়িয়ে যায় | নন্দিনী কি চেয়েছিল সেই জানে | কেন করল এরকম? এদিকে বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে নিজেকে আরও বেশি অসহায় ও অপরাধী মনে হচ্ছে | মাঝে মাঝেই চোখের সামনে নন্দিনীর অসহায় মুখ ভেসে উঠছে, ঈশানির মুখ ভেসে উঠছে| ছটফট করছে ঈশান |

নিজের ছায়া যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে বলে ‘এতদিন তুমি দায়িত্ব ছেড়ে পালিয়েছ আর এখন দায়িত্ব তোমার থেকেই দূরত্ব রেখে চলছে’ | বুকের এই হট্টগোল কে বুঝবে? জীবনের নতুন অধ্যায় লেখা হলেও সেটা যেন অসম্পূর্ণ |

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে শাস্ত্র মতে বিয়ে হলো ঈশিতা ঈশানের | ভাবনার মারণ অসুখ থেকে গেল বুকের ভেতরই | বিয়ের পর ঈশান সুখে থাকার কেবল অভিনয় করেই বেঁচে থাকল আর ভেতর ভেতর প্রতিদিন মরছে জল থেকে ডাঙায় ওঠা মাছ | চোখের সামনে ভেসে উঠছে স্পষ্ট অসুখ | এই অসুখ কি প্রেমিকার জন্য নাকি এক পিতার?

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।