সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ৩০)
by
·
Published
· Updated
যাপন চিত্র – ২৫
কিছু দলছুটর কথা
মানুষ মাত্রই অনুভূতি ও আবেগপ্রবণ ৷ তবে ব্যাপারটা বড়ই আপেক্ষিক ৷ কেউ কেউ আবেগ প্রবণ হলেও সবার সামনে সমানভাবে প্রকাশ করতে পারে না ৷ তবে যাঁদের অন্যের দুঃখে হিজল পাতার কার্নিস বেয়ে জল পড়ে তারা খুবই সংবেদনশীল হয় ৷ সম্পর্কের সমীকরণে লেগেছে ঘুণ,সব মনের দরজা প্রায় বন্ধ এই পেনডামিক পরিস্হিতিতে ৷
বিশ্বায়নের যুগে অনেক কিছুই পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ৷ মনখারাপের দিনগুলিতে মনের দরজা খুলে দেবার জন্যে সাদা কালোর অক্ষর ছেড়ে আমরা ডিজিটালে অভ্যস্ত হচ্ছি ৷ পৃথিবীটা ছোট হতে হতে ড্রইং রুমের বোকা বাক্স থেকের সরে গিয়ে এখন এক হাতের এক বিঘতের মধ্যে ঘুরছে ৷ আমরা না চাইলেও আস্তে আস্তে আমরা সবাই নিজেরাই নিজেদের চারিদিকে একটা একাকীত্বের মাকড়সার জাল বুনে যাচ্ছি ৷ সম্পর্ক গুলোতে কেমন চামড়া মত টান ধরছে ঝুরি পড়ে যাচ্ছে ৷ আমরা ঘটা করে সোস্যালমিডিয়াতে বাবা দিবস মা দিবস পালন করছি ,ছবি পোস্ট করছি কিন্তু আদৌ কি নিজের পরিবারের সাথে বেঁধে বেঁধে থাকছি ?? পারছি কি সন্তানদের আর্দশ ,নীতিপরায়ণ ,পারিবারিক করে তুলতে ?? হ্যাঁ মানছি সন্তান কিন্তু বন্ধন আলগা হচ্ছে ৷ যে সন্তানকে বাবা মা নিজের জীবন দিয়ে মানুষ করেছেন , তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের হোস্টেলে রেখে পড়িয়ছিলেন কিন্তু যখন বয়সের ভারে একটু মানসিক আশ্রয় খোঁজেন তখন তারা দেখেন সন্তান তার নিশ্চন্তের কাঁধ হতে পারে নি ৷ নিজের কপালকে দোষারোপ করে আমরা আমরা আমাদের দায়ভার এড়াতে চাই কিন্তু একবারো ভেবে দেখি না এই পরিস্থিতির জন্য কি আমারা দায়ী নই ! আমরাই কি বেশী উচ্চকাঙ্খার জন্য সন্তানদের স্বার্থপর হতে শেখাই নি ৷ তাই আপসোস করে লাভ নেই ৷আমরাই বীজ বুনেছি একান্নবর্তী পরিবার থেকে নিজের সরিয়ে নিজেদের স্বার্থপর হতে ৷ ছোটো মনে যেমন ছবি ছাপবে তেমনি ছবিই তো পাবো ৷ মা,বাবা আসলেই স্বতন্ত্র কিছু নয়। মাতৃত্ব অথবা পিতৃত্ব একটি জৈবিক ঘটনা মাত্র। মানুষ হিসেবে যে যেমন,মাতা পিতা হিসেবেও তার তেমনই প্রকাশ। বহু মা তাঁর সন্তানদের স্বার্থপরতার শিক্ষা দেন।।
আসলে মা বাবা চান তাঁর সন্তানের সুখ। একটি জৈবিক ঘটনার মাধ্যমে প্রাপ্ত একটি প্রাণের জন্য তাঁর বাৎসল্যের অনুভূতির নামই মাতৃত্ব বা পিতৃত্ব । এই অনুভব খুব জোরালো,তাই সন্তানের প্রতি ভালোবাসাও তাদের জোরদার কিন্তু অনেক সময় এই অতিরিক্ত স্নেহই তাদের সন্তানকে তাদের থেকে অনেক দূরে করে দেয় ,আবেগ হীন করে তোলে ৷যে মা সন্তানকে শেখান বন্ধুকে টিফিনের ভাগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই,তিনি সন্তানের প্রতি দয়াময়ী হলেও আসলে কুমাতাই। যে মা বলেন তুই কেন হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছিস,তোর বৌ সারাদিন কি এমন রাজকার্য করে,তিনি তাঁর সন্তানের জন্য যতই উদ্বিগ্ন হোন না কেন,আসলে তিনি কুমাতাই। যে মা পুত্র সারাদিনের পর কার্যালয় থেকে ফিরলে পুত্রবধূর নামে নালিশ করতে ভোলেন না,তিনি পুত্রের জন্য প্রাণ দিয়ে দিলেও আসলে কুমাতা। যে মা মেয়ের বিয়ের পর ক্রমাগত মেয়ের কানে জামাই আর শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন,তিনি আপাতদৃষ্টিতে কন্যার ভালো চাইলেও আসলে তাঁকে কুমাতাই বলে।
আমরা বলি পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম। অথচ অনেক ডমিনেটিং পিতার কারণে সন্তান আজীবন হতাশায় ভোগে। ভোগে সেই সন্তানেরা,যাদের পিতা ব্যক্তি হিসেবে খুবই নিম্নরুচির। অনেক পিতাই পিতৃত্ব আসার পর নিজেকে সন্তানের ঈশ্বর বলে ভাবেন। ভাবেন সন্তান আমার প্রপার্টি। পিতার অন্যায় দেখলেও সেই পিতার সন্তানদের কখনো মুখ তুলে কথা বলার অধিকার থাকে না। সেই সব বাবার ছেলেমেয়েরা কখনোই পিতাকে স্বর্গ বা ধর্ম ভাবতে পারে না।বহু মা বাবা থাকেন যাঁরা ছেলে এবং মেয়েকে সমান চোখে দেখেন না। বহু মা বাবাই দুটি সন্তানের মধ্যে একজনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেন। সেই সব ছেলেমেয়েরা পরবর্তী কালে একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। ভাইবোনের সুসম্পর্ক না থাকার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই এই মা বাবারা দায়ী থাকেন।
জৈবিক ভাবে সন্তানের জন্ম হলেই মা বা বাবা কখনো মানুষ হিসেবে বদলান না। সন্তান জন্মালে প্রতিটি মা বাবারই কর্তব্য সন্তানকে প্রতিপালন করা। তার মধ্যে কোনও নতুনত্ব নেই, কোনও প্রশংসনীয় বিষয় নেই। তা না করলেই বরং অন্যায়। সন্তানকে সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বড়ো করার জন্য একজন মা একজন বাবাকে আগে মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নইলে শুধু জন্ম দিলেই সে সুমাতা অথবা সুপিতা হয় না,বরং কুসন্তানের মতো কুমাতা এবং কুপিতারাও পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করতে থাকে।সন্তানেরা যখন মা বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়,আমরা বলি কুসন্তান ,অথচ সেই মনোভাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন মা বাবাই এককালে করেছেন কি না, সে খোঁজ কখনো নিই না।
যাক আজ এই পর্যন্তই থাক ৷ চলুক উৎযাপন ঘটা করে মাতৃদিবস ,পিতৃদিবসের সাথে সাথে কমুক বৃদ্ধাশ্রম এই কামনা করি ৷ সকলে ভালো থাকবেন ৷