• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ৩২)

যাপন চিত্র 

স্বাধীনতার নীলছবি

নারী শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। ‘ তসলিমার ‘মন্দ মেয়ে’ কবিতাটির এই একটি পঙতি আমায় অভিভূত করে তুলেছে। সত্যিই তাই – ভদ্র সমাজের রক্ত চক্ষুর সম্মুখীন হতে হয় প্রতিবাদী নারীকে প্রতিনিয়ত। সমাজের টেনে দেওয়া সীমারেখাকে যদি কোনও নারী উলঙ্ঘন করতে চায়, সেই নারী হয়ে উঠে সমাজের শত্রু, কলঙ্কিত হয় সেই নারী। নারীর নিজের অধিকার বলে কিছু নেই। যতই বড়ো বড়ো কথা বা লিপি টেনে দেওয়া হোক না কেন। নারী কোথাও তার অধিকার ফলাতে পারে না। নিজের রক্ত মাংস দিয়ে যে সন্তানকে পৃথিবীর আলো স্পর্শ করায় নারী। সেই সন্তানের উপরেই একটা সময় কোন অধিকার থাকে না সেই মাতৃ রূপী নারীর। সমাজের কাছে নারী “কেন ❓”র উত্তর চাইলেই – নারী হয়ে উঠবে কলঙ্কিত। ভদ্র সমাজে নারীর মুখে অশ্লীল ভাষা মানায় না। তবে নারীর কান পরিষ্কার হয় অশ্লীল ভাষার ক্রমাগত বর্ষণে। শিক্ষাগত মাপকাঠিতে নারীকে সমাজ অনেক কষ্ট করে সমানাধিকার দিলেও এই উদার সমাজ মেয়েদের কিন্তু কোন দায়বদ্ধতায় বাধেনি। এই ব্যাপারে সমাজ ভীষণ উদারতার পরিচয় দিয়েছে বলা যায়।
আমি এমন কয়েকজন মেয়েকে জানি যারা বহু সাধনার দ্বারা ডিগ্রি হাসিল করেছে। তারপর যোগ্য পাত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে নিজেকে বেঁধে ভীন দেশে পারি দিয়েছে। ভীন দেশে স্বামী নামক ঐ যোগ্য পুরুষটি নিজের পরিচয় বানিয়েছেন। কিন্তু মেয়েটির যোগ্যতা চাপা পড়েছে – রান্নাঘরের পেয়াজের ঝাঁঝে অথবা সম্ভারের ধোঁয়ায়। স্বামী সাহেব টিকে সুখী করার আপ্রাণ চেষ্টায় – সংসারের যাতাকলে ৫-৬ বছর কেটে গেলে ঐ যোগ্য মেয়েটির সাংসারিক জীবন অধিকতম আনন্দময় হয়ে উঠবে – যার বর্ণনা সে তখন নিজেও যে দিতে পারবে না তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এটাই আমার তোমার সমাজ। যেখানে নারী প্রতিবাদ করে নিজের অধিকার চাইতে গেলে নাকি সংসার ভাঙার ভয় থাকে। যদি সংসার সুখের হয় নারীর গুনে! তবে সংসারে নারী কেন অবহেলিত? কিন্তু পরের কথাটা কেউ কোনোদিন বলে না যে সংসার সুখী হয় রমনীর গুণে ,গুণবান পুরুষ যদি থাকে তার সনে ৷ আসলে সংসার সুখের হবার জন্য নারী ও পুরুষ দুজনেই দুজনের পরিপূরক হতে হয় কিন্তু সুখের হলেও নারীর কোনো কৃতীত্ব মানা না হলেও যদি সংসার সুখের না হয় বা ভেঙে যায় তাহলে তার পুরো অভিযোগের আঙুল ওঠে নারীর উপর ৷ বলে সবাই নারী ও পুরুষ সমান সমান কিন্তু ওটা শুধু কথার কথা ৷ বৈষম্য শুরু জন্মের পর বাড়ী থেকেই ৷ খাবার সময় ভাই আর দাদাদের পাতের সঙ্গে বাড়ীর মেয়েটির পাত চোখে পড়লেই তার তফাৎ বোঝা যায় ৷ খুব কম বাড়ীতেই মেয়েটিকে সমান অধিকার দেয় খাবার পাত থেকে সব কিছুতেই ৷ দিন এগিয়েছে ,যুগ আরো ঝাঁ চকচকে হয়েছে ঠিকই কিন্তু মেয়েরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে ৷
কিছুদিন আগে আমার এক ভদ্রলোকের সাথে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম, উনি ওনার অর্ধাঙ্গিনীকে জীবন-যাপনে পুরো স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। কথাটা শুনে আমি কিছুক্ষণ বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম। তারপর বললাম -‘বাহ বেশ ভালো’। আর ভাবলাম হে নারী তুমি আজও পরাধীন। ঐ ভদ্রলোকের গর্বিত কণ্ঠস্বর আমার শ্রবণেন্দ্র ছেদ করে মাথার ঠিক মাঝ বরাবর ধাক্কা মারতে লাগল।
হায়রে পুরুষ! যে শক্তি রূপী মাকে হাত জোড় করে পূজো করো, সেই মাতৃ রূপী ভগবান ও তো নারী। তুমি আবার গলা বাজিয়ে বলছ সেই নারী কেই দিয়েছ তুমি স্বাধীনতা। পুরুষ তুমি আর নারী দুজনেই ছিলে মাতৃগর্ভে ১০ মাস ১০ দিন। একই প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে জন্ম দেয় একজন মা তার সন্তানকে। জন্ম নেওয়ার পর সেই সন্তান কন্যা বা পুত্র সন্তান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে সমাজে। জীবনের চলার পথে স্বাধীনতা পাওয়ার সময় পুত্র আগে যায়, কন্যা দেশ স্বাধীনতার গল্প শোনে। একটা সময় সেই কন্যাটি স্বামী নামধারী ব্যক্তির বাড়ি যায় সেই বাড়ির লক্ষী হয়ে। ঐ লক্ষীকে স্বাধীনতা দেয় তার স্বামী নামক মহাপুরুষটি। সমাজের কি অসাধারণ নিয়ম। প্রত্যেকটি মানুষের ইচ্ছে হয় একটু উল্লাসে জীবন কাটাতে। কিন্তু উদ্দমতা কেবল ছেলেদের জন্য। মেয়েদের উল্লাসিত জীবন ও উদ্দামতা কে নাকি ভয় পায় পুরুষেরাও। ব্যভিচারীতা শব্দটি ছেলেদের সাথে মানায়, মেয়েদের জীবনে মানায় না। এটাই সামাজিক প্রথা। ঘরের বাইরের উচ্ছসিত মেয়ে বা মহিলাকে দেখলে ভীষণ ভাবে পরকীয়া করতে মন চাইলেও ,সেই সব বিবাহিত পুরুষেরা কিন্ত আবার ভীষণ ভাবে চায় নিজের ঘরের বৌটি যেন ঘর কন্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। সেই মহান পুরুষ টিই আবার নারী স্বাধীনতার গান গায়। যেই নারী এই চিন্তাধারার প্রতিবাদ জানায় সেই নারী হয় অহংকারী বা মুখরা। যেই নারী মেকী হাসি হেসে চুপ করে থাকে পুরুষেরা সেই নারী নিয়ে খেলতে ভালবাসে। সমাজটা পুরুষশাসিত নয় মানুষ শাসিত হওয়া উচিত। শুধু খাতা কলমে বা সোস্যাল মিডিয়াতে নয় নিজস্ব চিন্তাধারারও বদল প্রয়োজন। ভালো থাকবেন- সুস্থ থাকবেন। আপনার সু- চিন্তাই সু – কর্মের পরিবাহক। তবে কিছু ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে যেখানে মেয়েদেরও সমান অধিকার সমান খাদ্য সমান সম্মান দেওয়া হয় ,যারা মনে করেন বাড়ীতে একটা উপযুক্ত মেয়ে থাকা দশটা ছেলের সমান ,তবে সেই সংখ্যা খুবই সীমিত তবে আমরা আশাবাদী একদিন নারীরা সমাজের অযথা কুসংস্কার মুক্ত হয়ে ,মিথ্যার মাকড়সার জাল ছিঁড়ে প্রকৃত আক্ষরিক অর্থে নারী স্বাধীনতা পাবে ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।