সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ৫০)

আত্মসম্মান

ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার গতকাল আলাপ। আলাপটা অবশ্য নেহাতই কাকতলীয়। ভদ্রমহিলার একটা দুর্দান্ত বিউটি পার্লার আছে। গোটা পাঁচেক মেয়ে সেখানে কর্মরত। মহিলা শুধু ইন্সট্রাকশন দেন দেখলাম। আমি ঢুকতেই ওয়েটিং চেয়ারে বসতে বললেন মহিলা। ঠিক তখনই আরেকজন মহিলা বেশ ঝড়ের গতিতে ঢুকলেন পার্লারে।
ঢুকেই একটু চমকে বললেন, আমি আজ ফার্স্ট টাইম এসেছি এই পার্লারে। হেয়ার স্পা করাবো। ভালো হবে তো? ওরা হেয়ার স্পাএর বিভিন্ন রেট বলছিল। ভদ্রমহিলা বললেন, সব থেকে বেশি রেঞ্জেরটা করে দেবেন। তখনই পার্লারের মালকিনের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠলেন- আরে আপনি কি রাজশ্রী ? মানে রাজশ্রী সরকার ?ক্লাস ইলেভেন, রোল নম্বর ২?
মালকিন একমুখ হেসে বললেন, আরে তুই মিতালী না! এখানে তুই?মিতালী জড়িয়ে ধরলেন রাজশ্রীকে। পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে দুজনের মুখেই উচ্ছ্বসিত হাসি। মিতালী উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না তোকে এখানে দেখবো। এটা কি তোর পার্লার? রাজশ্রী বললেন, ইয়েস এটা আমার নিজের পার্লার।
মিতালী বললেন, আমি বড়ো জায়ের বাড়ি এসেছি রে। আর বলিস না। আমার হাজবেন্ডের একটু প্রবলেম হচ্ছে। হাতের আঙুলে মাঝে মাঝে টান ধরছে। আসলে আইটিতে আছে তো, দিনরাত কম্পিউটারে বসে থাকে। সেই থেকেই কিনা জানি না। এখানে বিখ্যাত নিউরো ডক্টর শিরিণ ব্যানার্জিকে একবার দেখাবো। আমার ভাসুরই অনেক চেষ্টা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাতে পেরেছে। তিনমাস আগে থেকে চেষ্টা করছে। আগামী কাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি। ডক্টর দেখিয়ে পরশু আবার আমার এক রিলেটিভের মেয়ের অন্নপ্রাশন। তাই আজ পার্লারটা সেরে নেব।
রাজশ্রী বললেন, তুই এখনও আগের মতোই আছিস। সেই মিষ্টি মিতা ।মিতালী গর্বিত হাসি হেসে বললেন, সেটা অবশ্য আমার স্বামীর কৃতিত্ব। বিয়ের পর থেকে ও আমাকে কোনো চাকরি করতে দেয়নি। এত আদরে রেখেছে, যে এখনও সেই স্কুলবেলায় মতোই আছি। রাজশ্রী মুচকি হেসে বললেন, বাহ খুব ভালো।
মিতালী আবার বললেন, ওর স্যালারি এক লাখের ওপরে জানিস তো। আমি কেন কষ্ট করে কোনো কাজ করতে যাবো বল?রাজশ্রী হেসে বললেন, সে তো বটেই। তোর নিজের যদি এই জীবনে কষ্ট না হয় তাহলে করবি কেন! মিতা ফিসফিস করে বললেন, এই তুই তো পড়াশোনাতেও ভালো ছিলিস। আর কোনো জব পেলি না? রাজশ্রী বললেন, পেয়েছিলাম গোটা দুই জব কিন্তু বিউটিশিয়ান হওয়াটা আমার প্যাশন ছিল জানিস তো। তাই জব ছেড়ে দিয়ে এটাতেই মন দিলাম। পার্লারে ভিড় বাড়ছিল। মিতালী বললেন, তোর হাজবেন্ডের যদি বেশি রোজগার হতো তাহলে কি আর এসব করতে দিতো তোকে? বিশ্বাস কর, তোকে এখানে দেখবো ভাবিনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রাজশ্রী অন্য একজন মহিলার মেকওভারে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার ফেসের সঙ্গে হেয়ার কাটিং কেমন হবে সেই নিয়ে বোঝাচ্ছিলেন।
মিতালী আমার পাশে বসে বললেন, মানুষের কি কপাল। আমাদের ব্যাচের সব থেকে বড়লোক বাবার মেয়ে ও। এমন বিয়ে হয়েছে যে পার্লার খুলতে হয়েছে।
আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, আপনি তো এমন বলছেন যেন ড্রাগের বিজনেস খুলেছে। যথেস্ট ভদ্র প্রফেশন বেছে নিয়েছেন উনি ভালোবেসে। মুম্বাইয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার বা মেকওভার আর্টিস্টদের কি লেভেলের ইনকাম আপনার ধারণা আছে?
মিতালী একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, থামুন তো। বিউটি পার্লারের মালিকিন আর ফ্যাশন ডিজাইনার এক হলো? না একে যুক্তি দিয়ে বোঝানো আমার কম্ম নয়। নিজেই বলতে ভালোবাসেন। আবার বললেন, বিয়েটা নিশ্চয়ই ভালো হয়নি। জিজ্ঞেস করতেও পারছি না ওর বর কি করে!
আমি আই ব্রো করতে বসে গেলাম। মিতালীও স্পা করছিলেন।রাজশ্রী দুজনের হেয়ার কাটিং নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
মিতালী বেরোনোর আগে রাজশ্রীকে ওর ফোন নম্বর দিয়ে, একটা সেলফি তুলে বললেন, যে কোনো হেল্প লাগলে কল করবি বুঝেছিস। কোনো হেজিটেশন করবি না। আমি আর আমার হাজবেন্ড সকলকে এমনিতেই খুব হেল্প করি। রাখী মুচকি হেসে বললেন, এই সেলফিটা নিয়ে গিয়ে শিরিণ ব্যানার্জিকে দেখাবি।
বলবি, আমি আপনার বউয়ের বান্ধবী। ফিজটা কম নিতে। শ্যালিকা বলে কথা!
মিতালী হাঁ করে বললেন, শিরিণ ব্যানার্জি তোর হাজবেন্ড?
সত্যি বলছিস, না মজা করছিস?
রাজশ্রী হেসে বললেন, তুই গিয়ে জিজ্ঞেস করিস না, তাহলেই হবে।
মিতা চমকে উঠে বললেন, তাহলে তুই বিউটিপার্লার কেন খুলেছিল?
রাজশ্রী হেসে বললেন, কারণ এটা আমার প্যাশন। এখন পেশা। আমি ডক্টর শিরিণ ব্যানার্জির মত ইনকাম না করতে পারলেও পুজোয়, নববর্ষে তোদের শিরিণদাকে ভালোই গিফ্ট করতে পারি। তার সামনে হাত পাততে হয় না। বিশ্বাস কর এই ‘চয়েস’ পার্লারের প্রতিটা জিনিস আমার রোজগারের টাকায় কেনা। এটা সম্পূর্ণ আমার। তোদের শিরিণদা পার্লারটা করার সময় হেল্প করতে চেয়েছিল, আমি নিইনি।
মিতার চোখে তখনও বিস্ময়। আমি অবশ্য অনেক আগেই বুঝেছি ওনাকে স্বনির্ভরতা, স্বাবলম্বী হওয়া, আত্মসম্মান, আত্মঅহংকার, নিজস্ব পরিচয় তৈরি করার লড়াই এসব শব্দগুলোর মানে বোঝানো এতটা সহজ নয়।
রাজশ্রীও দেখলাম সেদিকে না হেঁটেই বললেন, ফোন করবো তোকে। ভালো থাকিস।
যেসব মানুষের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছেই থাকে না। তারা রাজশ্রীর লড়াইটার মূল্য বুঝবে না কোনদিন।
রাজশ্রীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়…
আত্মসম্মান শব্দের অর্থটা ঠিক কি!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।