।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় মৌসুমী মণ্ডল দেবনাথ

কুয়াশা পুরুষ

আজকের বিকেল-যাত্রার বৃষ্টিতে ঘুঙুরের শব্দ ছিলনা।
কেমন সন্নাসী মেঘ রয়ে গেছে সন্ধের আকাশটুকুর কাছে। শিশিরে
ভেজা ভেজা নিঃশ্বাস ঢুকে পড়ছিল ক্যামেলিয়া আর নীল নীল অর্কিডের বুকে।
বাসে যেতে যেতে দেখছিলাম কেমন অস্পষ্ট ল্যাম্পপোস্টের আলোটুকু ঘরে তুলে রাখছে কুয়াশানগরীর পুরুষ ও নারীরা। মায়ের পাশে পাশে আপেলের মতো টুসটুসে আদুরে শিশুরা কেমন জোনাকি আলো বিলিয়ে যাচ্ছে।
যেমন করে ঘুমের পর্দার ওপারে যত্নে রাখা থাকে মায়ের বানানো লিজিবিজি ডিজাইনের আকাশী রাত পোশাক… তেমনি করেই শান্ত সমাহিত পাহাড় শ্রেণীবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেন কোনও অলীক জগতের আহ্বান জানাচ্ছে।
লিমো সাংমা। বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ। রাস্তার পাশেই একটি কালভার্টের উপরে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। মাথায় কাউবয় হ্যাট। গায়ে একটি মাত্র স্লিভলেস আধময়লা ডেনিমের জ্যাকেট। যেন এই কনকনে শীতকে সে কেয়ারই করে না একদম। হাতের সিক্স প্যাক মাসলের উপরে ট্যাটু করা ড্রাগনের ছবি আঁকা। এখন এই কুয়াশানগরীর পুরুষের চোখমুখ থেকে ক্যারলের উপাসনার দাগ মুছে গেছে। ঝাপসা হয়ে গেছে কবেই শৈশব থেকে গুটিয়ে রাখা স্বপ্নেরা। একলা থাকা পাহাড়ি চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে জঙ্গলে শুকনো পাইন ফল আর কাঠ কুড়োতে কুড়োতে। ভীষণ হিংস্র সরু চোখে তাকায় শহুরে ধ্বংস পেরিয়ে আসা পর্যটনের গাড়িগুলোর দিকে। যেন এই গাড়িরাই বয়ে নিয়ে আসছে প্রজাপতির হলুদ শব…
বরফে মোড়ানো লাল, বেগনি রডোডেনড্রনের কফিন সীমান্তের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। এতোটা পথ জার্নি করে করে পতাকার সাদা, সবুজ ও গেরুয়াতে ধুলোবালির প্রহর জমেছে। পাহাড় জুড়ে ঢিমে লয়ে চলা মেঘমল্লারের দল ঢেকে যাচ্ছে কালো পলিউটেড ধোঁয়ায়। ভ্রু কুঁচকে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তাকায় লিমো। সে যদিও জানে আসলে শুধুমাত্র পর্যটনই পাহাড়ের গ্রাম গ্রাম শহরগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবুও বড্ড অপছন্দ তার এই গাড়ির দলকে। পাহাড়ের স্বচ্ছন্দ নিজস্ব জীবনের সুুরে যেন তাল কেটে ঢুকে পড়ছে বারবার একদল বিদেশী মানুষের দল। লিমোর কাছে এই পর্যটকেরা বিদেশীই। একদম ভাল লাগেনা তার এদের এখানে বেড়াতে আসাটা। ক’টা দিনের জন্যে আসবে, আর তান্ডব করে রাস্তাঘাট, জঙ্গলকে খাবারের প্যাকেট, জলের বোতল, মদের বোতলে ক্যানে নোংরা করে যাবে। কেন? কেন হে? আসছো এসো … তবে এমন নোংরা করে চলে যাওয়া কেন শুনি! লিমো সারাটা দিন ঘুরতে থাকে পাহাড়ের ঢালে ঢালে। কাঁধে দুটো ব্যাগ। একটায় পাইনের শুকনো কোন আর বেছে বেছে ওর প্রয়োজনের কাঠ কুড়োয়। অন্যটাতে জমতে থাকে বেড়াতে আসা অতিথিদের তান্ডবের ফলঃশ্রুতি বোতল, খাবারের পরিত্যক্ত প্যাকেট ইত্যাদি। এসব নোংরা বাসি টুকরো খাবারে যদি কোনও পশুপাখি মুখ দেয় দেখতে হবে না আর। অবুঝ বন্যপ্রাণীরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তখন লিমোরই বিপদ। ঘুরে ঘুরে খুঁজেপেতে তাদেরকে সুস্থ করে তুলতে হয়। কেনরে বাপু! আসছো … এসো। এখানে এসে কেন এমন নিয়মভঙ্গ করে যাওয়া!
রোজই সন্ধেবেলায় লিমো তার প্রিয় গিটারটাকে নিয়ে এসে এই কালভার্টে বসে। রাস্তার ওপারে ম্যাগডোলিনার মোমোর দোকান। দু’জনের যত কথা ঐ চোখে চোখেই। ম্যাগডোলিনা মোমো বানায়, চিকেন স্যুপ বানায়। আর উদাস দৃষ্টিতে সোনালী কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকায়। মাঝেমধ্যে আড়চোখে লিমোকে দ্যাখে ভয়ে ভয়ে। খুব রগচটা ছেলে। লিমো তার চেয়ে এক বছরের ছোটই। তবুও তাকেই সে প্রেমিক ভাবে। লিমোও কী তাই ভাবে? এর উত্তর নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ম্যাগডোলিনা। তবুও লিমো যখন স্পেনিশ গিটার নিয়ে গাইতে থাকে, ” touch is ooh la la la
It’s true, la la la
Ooh, I should be running
Ooh, you keep me coming for ya…
Sweat dripping off me
Before I even knew her name, la la la
It felt like ooh la la la
Yeah, no
Sapphire moonlight
We danced for hours…
Tequila sunrise
Her body fit right in my hands, la la la
It felt like ooh la la la, yeah
I love it when you call me señorita”… তখন তার মনে হয়, লিমো ওকে উদ্দেশ্য করেই গাইছে গানটি। এই সেনোরিটা যেন সে-ই। ম্যাগডোলিনা একটি ট্রে’র উপরে ঝকঝকে সাদা হাল্কা পোর্সেলিনের প্লেটে দশ, বারোটা স্টিমড মোমো সাজাতে থাকে। চিকেন স্যুপে বেশ কিছু নুন, আদা, গোলমরিচ, রসুন, পেঁয়াজের পেস্ট মেশানো জলে সেদ্ধ করা নুডলস আর খানিকটা চিকেনও মিশিয়ে দেয়। ছোট ছোট সস পটে লাল লাল তীব্র ঝালের সস রাখে। এক কাপ ভীষণ গরম গ্রীন টি ও প্লেট চাপা দিয়ে নেয়। রাস্তার দু’দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় কোনও গাড়ি আসছে কিনা। গরম মোমো থেকে একরাশ মেঘ উড়ে মিশে যাচ্ছে বাতাসে। লিমোর পাশে কালভার্টে ট্রে’টা নামিয়ে রেখেই সে ফিক করে হেসে ফেলে। হাসলেই ম্যাগডোলিনার ছোট্ট চোখগুলো আরও ছোট্ট হয়ে মিলিয়ে যায়। গালগুলো আরও লাল হয়ে ওঠে। লিমো রেগেমেগে তার হাসির দিকে তাকায়। ভাবখানা এমন যে এখানে হাসির আছে’টা কি!
এপারে দোকানে ফিরে এসে ম্যাগডোলিনা লুকিয়ে লুকিয়ে লিমোর তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে। এসময়টা তার চোখে বৃষ্টি নেমে আসে। লিমো সেই গেল বছরে একজন পুরুষ পর্যটক তার হাত ধরে টান দেয়ার পর থেকে তাকে যেন পাহারা দেয়ার জন্যেই রোজ বিকেলে মোমোর দোকান খোলার সময়ে এসে এখানে বসে থাকে।
সার সার গাড়ি ঢুকছে লাইন দিয়ে এখন…
কোনও গাড়িতে প্রথমবারের মতো পাহাড় দেখতে চাওয়া পাঁচ, ছ’ জোড়া উৎসুক চোখ গিলে খাচ্ছে সবুজ। তো কোনও গাড়িতে পাহাড় ভালবাসা মেয়ে মুকুলিকা ও তারই মতো আরও কয়েকজন চিৎকার দিয়ে গান করছে। চার নম্বর গাড়িটিতে লোকের সংখ্যা কম… ছোট ছোট চোখে দেখে নিলো লিমো সাংপু। এরা জানলা দিয়ে বাইরেও তাকাচ্ছে না। একটি বছর পঁয়ত্রিশের ছেলে একটি শাঁখা পলা পরা, অথচ জিনস, টপ পরা সিঁথিভরা সিঁদুরে লেপটানো ফর্সা মেয়েকে জাপটে ধরে গায়ে বুকে মুখ ঘষছে। সামনের সীটে বসা ড্রাইভারও কিছুই যেন দেখছে না এমন ভাবলেশহীন মুখে স্লো মোশনে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনে।
কী আদিখ্যেতা দেখো!
লিমো একটা পাথরের টুকরো তুলে দিল এক ঢিল গাড়িটিকে লক্ষ্য করে। গেল কাচটা ফেটে। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে লিমোর কাছে এসে চিৎকার দিয়ে বললো, “এ লিমো কি ভয়ো? গ্লাস ভাঙলি কেন ঢিল ছুঁড়ে? ”
— ওরা তোমার গাড়িতে বসে এসব অসভ্যতা করছে কেন?
—অসভ্যতা হবে কেন? নতুন বিয়ে করেছে তাই হয়তো। ও তুই বুঝবি না। তোর যখন ম্যাগির সঙ্গে বিয়ে হবে তুইও এমনিই করবি। এবারটা মাপ করে দিলাম। আর এমন করবি না। ট্র্যাভেলাররা না এলে খাবো কি আমরা? জানিস না? যা… মাথা ঠান্ডা করে বোস…
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দড়াম করে এক ঘুষি গিয়ে পড়লো ড্রাইভারের মুখে। সেই নব কলেবর শহুরে ছেলেটি গাড়ি থেকে নেমে এসে কখন দাঁড়িয়েছে কেউ খেয়াল করেনি।
—শ্লা! পাঁচশো টাকা বেশি দিয়ে গাড়িতে বসেছি মালটাকে নিয়ে, একটু শান্তিতে রগড় করার উপায় নেই। গাড়ির কাচ ভেঙে দিচ্ছে দেশোয়ালি ভাই। কোথায় খিস্তি দেবে! তা না শালা কাঁধে হাত রেখে শান্তির বাণী দান কচ্ছে। দে আমার সব টাকা ফেরত দে। তোর এই গাড়িতে আর যাবনা।
ড্রাইভার হাতজোড় করে বলতে লাগলো, “সাব মাপ কর দো। বাচ্চা ছেলে। বুঝতে পারেনি।”
লিমো এতক্ষণ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সেই ছেলেটা চোখ থেকে ঢাউশ সানগ্লাসটা খোলার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপরে। দমাদ্দম মারতে লাগলো ছেলেটাকে। ম্যাগডোলিনা, ড্রাইভার সবাই মিলেও তাকে থামাতে পারছে না। শেষমেশ ম্যাগি তাকে জড়িয়ে ধরলো। নিমেষে থেমে গেল লিমো। —ভাল করে দেখ তো ম্যাগি এই শয়তানটাই তোর সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল না?
ছেলেটা তখন কোনওমতে দৌড়ে পালাচ্ছে ওই জায়গাটা থেকে। আর সেই সিঁদুরে মাখামাখি মেয়েটা ম্যাগিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে। ঠকঠক করে কাঁপছে বছর ষোল’র পায়রার মতো মেয়েটা।
—এই মেয়ে কাঁদছো কেন তোমাকে তোমার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে। ভয় পেয়ো না। বললো ম্যাগি।
—না না দিদি। আমাকে ওই পশুটার কাছে আর পাঠিও না। আমাকে কিনে এনেছে ঐ লোকটা। আমার কাকা ওই লোকটার কাছে আমাকে পাঁচ হাজার টাকার বদলে বিক্রি করে দিয়েছে। আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও প্লিজ। আমি তোমার সব কাজ করে দেবো দিদি।
ওরা তিনজন অবাক হয়ে এই ভয়ানক কথাগুলো শুনছিল। লিমো এগিয়ে এলো।
বললো, “তুমি আজ থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। আমরা ছোট্ট একটা বোন পেলাম। কি বলিস ম্যাগি? শোন তোমার ভাবিজির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রোজ একটু মোমো বানিয়ে দিতে পারবে তো আমাকে?”
ম্যাগডোলিনার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল। দূরে দূরে পাহাড়ী গ্রামগুলোতে মঙ্গলদীপের আলো জ্বলে উঠছে।
লিমো … এই গ্রামের কুয়াশা পুরুষ। ভীষণ কাঠখোট্টা টাইপো বিদ্রোহী চলন-বলন তার।
অথচ একটুকরো জোছনা পেলে ওর সমস্ত প্রেম রঙিন মোম হয়ে গলে যাবে। হোম স্টে কটেজের বারান্দায় হেসে উঠবে বুনো ফুলের মতো দুলে দুলে। প্লেটে প্লেটে সেও বেড়ে দেবে প্রেমিকাকে ধোঁয়া ওঠা মোমো আর গরম চিকেন স্টু…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।