গল্পেরা জোনাকি তে মালা মিত্র

গল্প – প্রেম পত্র

প্রিয়তমা
ললিতা, তুমি কেমন আছো? আমি একটু ও ভাল নেই তোমাকে ছাড়া।তুমি ছাড়া আমি ঢেউ বিহীন সাগর,দুচোখ অন্ধকার,আত্মীয় পরিজন কিচ্ছু ভাল লাগে না।সারাক্ষণ মনে হয় তোমার দুই পদ্ম কলিতে মুখ ডুবিয়ে থাকি।যেদিন ছাতের ঘরে তোমার ওষ্ঠ মধু পান করেছি,তারপর থেকে আমি আর আমার মধ্যে নেই,সারাক্ষণ ডুবে আছি…….ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিলেকোটার ঘরে বিকেলে আমরা মগ্ন কজন প্রেম শিক্ষার শিক্ষানবিশ।
ললিতা বলে যাকে সম্বোধন করা হয়েছিল,তার আসল নাম লিপিকা,ললিতা ওর প্রেমিকের দেওয়া নাম। প্রতিদিন লিপি বুকে করে আনত সে সব চিঠি। কোনোচিঠির সঙ্গে লাল গোলাপ দেওয়া থাকত,সুন্দর সুগন্ধি মাখানো সেইসব চিঠি,রঙিন খামে পোরা।
আমাদের কিশোরী বেলার প্রমের পাঠে,এক একটা চিঠি যেন কোটি টাকার সম্পদ।কোটেশনে ভরা সে সব চিঠি।
মনের কোনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল,বিনা প্রেমপত্রে ভালবাসা হয় না।
তখন আমি ক্লাস নাইন,লাল পাড় শাড়ী,দু বেনী দোলানো।
স্কুলের অফ পিরিয়ডে ইন্দ্রানীর প্রেমিকের দেওয়া নিষিদ্ধ চটি বই পড়তাম,নতূন নতূন শব্দ,সে কি উল্লাস!সেকি হাসির ফোয়ারা।কাড়াকাড়ি করে সবাই পড়তাম,এক এক শব্দে যেন ব্রহ্মান্ডের এক এক গ্রহের আবিষ্কার।
স্কুল থেকে ফিরে পোষাক পাল্টে খেয়ে দেয়ে আবার প্রেমের ইস্কুলে লিপিদের চিলেকোঠায় নরক গুলজার,আমি, অহনা, সুমিতা, সৃজা,পম্পা।এক এক দিন উড়ো বন্ধুনীরা রেল কোয়ার্টার এর একেক প্রান্ত থেকে আসত।আহা!সে প্রেম মজলিস্,মহার্ঘ মুজরারাতের কম নয়।সে প্রেমশিক্ষার ইস্কুলে পরতে পরতে খুলে যাচ্ছিল স্বর্গের দ্বার।তোরণদ্বার থেকে দেখা যেত ইন্দ্রপুরীর সাতমহলা।
তবে নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হোত,সবার একেকটা প্রেমিক যুটলো,আমার কপাল ফুটো।
চিলেকোটা বা সিঁড়িঘর মজলিসে এক একদিন একেক বান্ধবীদের প্রেমের চিঠি পড়া হোত,সেকি উত্তেজনা!আবার Break upএর চিঠিতে আমরা সমস্বসরে কেঁদে ভাসাতাম।
দুদিন না যেতেই বন্ধুনীর নতুন প্রেমিকের চিঠি আসত।তখন তার খুশি দেখে কে!
রেলকোয়ার্টাসের আনাচে কানাচে শরৎকালের মেঘের মত প্রেম আসা যাওয়া করত।
গোপন প্রেমের চিঠি,বাড়ির লোক জানলে তো আস্ত রাখবেনা,তাই একেক বন্ধুনির চিঠি সবার হয়ে যেত,একসাথে পড়া লুকোনো কান্নাকাটি হাসাহাসি।
হটাৎ কোনো একলা অবসরে মদনদেব হেঁটে এলেন,দীর্ঘ অবয়ব,প্রশস্থ বক্ষ,ফর্সা একমাথা কালো কোঁকড়ানো চুল নিয়ে,আর কি!মারল তীর।
সে শরাঘাতে দেখা পৃথিবীটা বেমালুম পাল্টে গেল।
তিনি আবার নিত্যনতুন জিন্স টিসার্টে,চুলের বাহার করে বেশ কাপ্তেনী দেখাতেন।
তীর সে তো অজান্তেই ছুঁড়ল,হাবেভাবে প্রেম দেখালেও মুখে স্পিকটি নট্।
আমি রোজই তার আসার অপেক্ষায় থাকতাম,তিনি আবার দাদাদের বন্ধু হয়ে উঠলেন,গান ও গাইত চমৎকার!
তখন মান্নাদের স্বর্ণযুগ,সে প্রতিদিনই গাইত প্রাণ ঢেলে,’ক ফোঁটা চোখের জল’,’এইকুলে তুমি আর ওই কুলে আমি’,’ও কেন এত সুন্দরী হল’,’আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’,’আমি যামিনী তুমি শশি হে’,হৃদয় ঢেলে গাইত,আর আমার অমরাবতী বেয়ে সুরধুনীর বানবন্যা।
শেষমেশ বছর খানিক পর,তিনি প্রেমের প্রকাশ করলেন এক দূর্গাপূজোর নবমীতে।
এরপর বয়ে চলল প্রেমের সাম্পান তরতরিয়ে,সে সুখের কথা অনুভব করতে হয়,মুখে বা লিখে বলা যায় না।
ভালই চলছিল লুকোছাপায়,দুঁহুঁ দোঁহায়।
প্রাণের সখীদের কাছে বলার মত আস্ত এক প্রেম কিনেছি,সে গল্পে আমি ওরা,ওরা আমি হয়ে মেতে উঠতাম।
এরপর মনপ্রাণ ঢেলে নিজের বিদ্যেয়,কতক ধার করা সাহিত্যিকদের কোটেশন দিয়ে আমি জম্পেস প্রেম পত্র লিখি আমার প্রেমিক কে,পাঁচবার।
কিন্তু ওমা!একটার ও উত্তর দেয় না কন্দর্প।
শুধু যদি ‘আমি তোমাকে ভালবাসি ‘এই তিনটি শব্দ সে লিখত,তবে এমন মানসিক যন্ত্রণা হোত না,শুরু হোত না সন্দেহের তীর ছোঁড়া।
না বহু বলেও পাওয়া যায়নি অভিপ্রেত চিঠিটি।
ইতিমধ্যে আমি কলেজে পড়ছি,আর চারপাশে লাভবার্ডদের ওড়াউড়ি দেখছি,প্রেমে আমিও হাবুডুবু।
ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে,চিলেকোটা মজলিশ এর লিপিকা ওরফে ললিতা যে বন্ধুনি কে দূতী করে তার প্রেমিক কে চিঠি পাঠাত,সেই পম্পাই এখন লিপিকার প্রেমিকের ললিতা।
পম্পা ও যথারীতি ওর প্রেমপত্র দেখাত,ললিতা সম্ভাসনে সে চিঠি,কেমন হজম হোত না অথচ বলার কিছু ছিল না।
আজ আমাদের মধ্যবয়স,লিপিকা অন্য একজনের সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছে।
এক সখী প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে,লকআপে থাকা কোর্টকেস অনেক কিছুই সৃজার পরিবার করেছে,সুখের কথা সৃজা ও তার প্রেমিক আজো ছানা পোনা নিয়ে দিব্যি সুখে ঘরকন্না করছে।
এবার আমার কথা বলি,বিভিন্ন সময়ে নানান জনের প্রেমপত্র আমি পেয়েছি,যা চাইনি,অথচ যার তিনটি শব্দের জন্য হন্নে হয়ে ঘুরেছি,তা মেলেনি।
আটবছর পুরোনো প্রেমের চক্করে ঘুরে মরেছি।
আমার বিয়ে অন্যকারো সাথে হয়।সংসার অন্য,কিন্তু সেই কিশোরী বেলার প্রেম আড্ডা,প্রেমিক পাওয়া অনাস্বাদিত এক স্বর্গের দ্বার খুলে দিয়েছিল বলাই বাহুল্য।
আজ এত বছর পর একলা হলেই স্মৃতির সেই প্রেমবৃক্ষে জলসিঞ্চন করি,এ এক না ফুরানো চিরন্তন প্রেমশ্পর্শ অনুভব করি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।