হৈচৈ ছোটদের গল্পে মেরী খাতুন

ফুচকার স্বাদে ভালোবাসার গল্প
বার্লো বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মনটা আজ ভীষণ ভারাক্রান্ত। টিফিনের সময় কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না ওদের। গেটের চারপাশ ঘিরে রয়েছে এক অদৃশ্য মন খারাপের চাউনি।
ফুচকা কাকু আজও আসেনি স্কুলের গেটে। প্রিয়ার মনটা ভারী হয়ে আসে। ছুটির পর কিংবা টিফিনে কাকুর হাতের আলুকাবলি, চুরমুর কিংবা ফুচকা না খেলে যেন দিনটাই অপূর্ণ থাকে। ওদের জীবনের এক অংশ হয়ে উঠেছিল কাকু আর তাঁর ফুচকা। কাকুর পরিশ্রম, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা—হাতে পাতলা গ্লাভস, স্বচ্ছ জলে বানানো ফুচকা—সবকিছু মিলে এক ভরসার নাম ছিল সে।
কিন্তু ক’দিন ধরে কাকুর দেখা নেই। স্বাতী বলেছিল, বিকেলে ওদের পাড়াতেও আর আসে না কাকু। স্বাতীর মুখে আরও একটি খবর ছিল—পাড়ার কিছু ছেলে কাকুর দোকান ভাঙচুর করেছে। তারা জেনেছে, ফুচকা কাকু একজন মুসলিম। বলে, “এদেশ নাকি ওদের নয়, ওদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে পাকিস্তানে।” কাকুর ছেলেকে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে তারা। এখন সে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কাকুরা সম্ভবত শহর ছাড়তে চলেছেন।
—”এ মা…! এবার কি হবে! আমরা তাহলে আর কাকুর হাতের ফুচকা খেতে পাবো না?”—সমবেত কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে মেয়েরা।
জয়ীতা চোখ মুছতে মুছতে বলে, “আমার যখন ডেঙ্গু হয়েছিল, কাকুই আমায় রক্ত দিয়েছিল, জানিস তো?”
রিয়া বলে, “আমার পরীক্ষার ফি-এর টাকা চুরি হয়ে গিয়েছিল, টিফিনে কাকু শুনে নিজেই টাকাটা দিয়েছিল আমাকে।”
“আরেকদিন তো দেখলাম মিলির স্কুল ড্রেস ছেঁড়া। পরদিন কেমন একটা নতুন ড্রেস কিনে এনে দিল মিলিকে,”—শ্রেয়ার কণ্ঠে প্রশংসা।
মলি স্মৃতিমেদুর স্বরে বলে, “কাউকে বই, কাউকে পেন-পেন্সিল… কতদিন যে ফাউয়ের ফুচকার পর শুধু টক জল চেয়ে খেয়েছি—একটাও কথা বলেনি কখনও।”
এই বিষণ্ণতা, এই বেদনা থেকে মেয়েগুলো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
হাসপাতাল থেকে ওষুধ আনতে বেরোতেই সেলিম দেখে পুরো স্কুলটাই যেন ছুটে এসেছে সেখানে। ছোট ছোট মেয়েগুলো টিফিনের জমানো পয়সায় ছেলের জন্য ফল কিনে এনেছে। বড়রা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ আনতে ছুটেছে। একে একে সবাই দেখতে চায় কাকুর ছেলেকে।
ভরসার কচি হাতগুলো ঘিরে ধরে সেলিমের ক্লান্ত কাঁধকে। এই দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে সেলিমের।
কে বলে, এই দেশটা ওদের নয়?